সবার ওপরে ফোরলান

সোনার বলটা পেলেন সেমিফাইনাল থেকে ফিরে যাওয়া এক নায়ক, ডিয়েগো ফোরলান। অবাক হচ্ছেন? জার্মানির অ্যাকুয়ারিয়ামে সাঁতার কাটতে থাকা অক্টোপাস পলের দ্বারস্থ হলে হয়তো এমন হোঁচট খেতে হতো না। তাকে তো শুধু যেকোনো ম্যাচের বিজয়ী দলের নাম বলতে বলা হয়েছিল। সে ঠিক ঠিক বলে দিয়েছে। সোনার বল কে জিতবে, এটা জানতে চাইলেও কি সঠিকটাই বলতে পারত? কে জানে, এখানেই হয়তো বড় ভুলটা করত পল। সোনার বলের বিচারটা হয়েছে সাংবাদিকদের ভোটে। সাংবাদিকদের মতিগতির আঁচ পাওয়া বড্ড কঠিন কাজ।
সাংবাদিকদের সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার ‘গোল্ডেন বল’ পেয়েছেন উরুগুয়ের অধিনায়ক ডিয়েগো ফোরলান। পেয়েছেন ২৩.৪ শতাংশ ভোট। হল্যান্ডের ওয়েসলি স্নাইডার ২১.৪ ভোট পেয়ে জিতেছেন রুপার বল। আর যাঁর হাতে আপনি সোনার জুতা ও সোনার বল ওঠা দেখার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন, সেই ডেভিড ভিয়া ১৬.৯ শতাংশ ভোট পেয়ে ব্রোঞ্জ-বল বিজয়ী।
স্পেনের বিশ্বজয়ের এই নায়ক কোথাও শীর্ষস্থানে নেই। চারজনের সঙ্গে যৌথভাবে পাঁচ গোলের মালিক হলেও ভিয়া পেয়েছেন রুপার জুতা। সোনার জুতার মালিক জার্মানির ২০ বছর বয়সী তরুণ টমাস মুলার। হুন্দাই সেরা যুব খেলোয়াড়ের পুরস্কার পেয়েছেন প্রত্যাশিতভাবেই। সবাইকে চমকে দিয়ে জিতলেন অ্যাডিডাস সোনার জুতাও। ব্রোঞ্জ-জুতা বিজয়ী হল্যান্ডের ওয়েসলি স্নাইডার।
ফিফা এবার থেকে একটা নিয়ম চালু করেছে। শীর্ষ গোলদাতাদের গোলসংখ্যা সমান হয়ে গেলে একটা মানদণ্ডে ব্যবধান তো গড়তে হবে। এ কারণেই দেখা হয়েছে, গোল করার পাশাপাশি কতগুলো গোলে অবদান আছে। সেখানেও সমতা থাকলে বিবেচিত হবে কত কম সময় খেলে এই গোল। এখানে পরিষ্কার ব্যবধানে সবাইকে ছাড়িয়ে মুলার। পাঁচটি গোল করেছেন, সতীর্থকে দিয়ে করিয়েছেন তিনটি। পাঁচ গোলের অন্য তিন মালিক ভিয়া, স্নাইডার ও ফোরলানের ক্ষেত্রে গোলে সহায়তা মাত্র একবার করে। কিন্তু এই তিনজনের মধ্যে ভিয়া আবার খেলেছেন সবচেয়ে কম সময়—মোট ৬৩৪ মিনিট। স্নাইডার ও ফোরলান খেলেছেন ৬৫২ ও ৬৫৪ মিনিট করে।
ভিয়ার কি মন খারাপ? তাঁর ভেলায় ভেসে স্পেন গেল ফাইনালে। গোল করার পর উসাইন বোল্টের ভঙ্গিতে ছুটে এসে মাটিতে দুই হাঁটু গেড়ে ছেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া শরীরটাকে বানিয়ে ফেললেন ‘সিগনেচার মোমেন্ট’, আর তিনিই সবচেয়ে বড় দুটি ব্যক্তিগত পুরস্কারের তালিকায় নিচের দিকে! দলের সঙ্গে জয়োৎসবে মেতে থাকা ভিয়াকে দেখে কে বলবে এই ভিয়ার মন খারাপ! অধিনায়ক ইকার ক্যাসিয়াস সুখের কান্নার স্রোত থামিয়ে তাঁকেই তো জড়িয়ে ধরলেন আগে।
২০০৬-এর এ রকম এক জুলাইয়ের রাতেই এই ট্রফিটি গিয়েছিল ইতালির অধিকারে। পরশু খেলা শুরুর আগে সেটি সকার সিটি স্টেডিয়ামে নিয়ে এলেন ফ্যাবিও ক্যানাভারো। শেষবারের মতো ট্রফিতে চুমু খেয়ে ইতালি অধিনায়ক তা রেখে দিলেন মাঠের এক কোনায়। নতুন বিজয়ী কোনো অধিনায়কের অপেক্ষায়। ঠিক এমন সময় কোত্থেকে এক পাগল-দর্শক ছুটে এসে হাত দিতে চাইল ট্রফির গায়ে। কিন্তু কঠিন কঠোর প্রহরা পেরিয়ে ট্রফির গায়ে হাত দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তার পূরণ হয়নি। প্রহরীদের আঘাতে আগেই সে ভূপাতিত। আর তারপর ট্রফিটা আর মাঠের মধ্যে রইল না। যেমন সেটি সাজানো ছিল গত ২০০৬ ফাইনালে বার্লিনের মাঠে। কে জানে, অতিরিক্ত সতর্কতা থেকে ফিফাও তাই পুরস্কারের মঞ্চটা গ্যালারিতে সরিয়ে নিয়ে গেল কি না! ওই মঞ্চেই ভিয়া নাচলেন শাকিরার গানের তালে তালে। ওই মঞ্চেই স্পেনের সর্বোচ্চ বিশ্বকাপ গোলের মালিক জয়ধ্বনি তুললেন, ‘ভিভা এস্পানা, ভিভা এস্পানা।’ মন খারাপ হবে কেন তাঁর? স্পেনকে বিশ্বসেরার গৌরবে ভাসাতে যে অবদান রেখেছেন, সেটাই তো তাঁর পুরস্কার। তবে ফুটবল পৃথিবীর রংটা যে আগামী চার বছরের জন্য লাল-হলুদ হয়ে গেল, তাতে ভিয়াও নিমিত্ত মাত্র। স্পেনকে তো জেতাল বার্সেলোনা।
বিশ্বজয়ের পুঁজি ৮ গোলের সব কটিই করেছেন বার্সেলোনার তিন খেলোয়াড়। ভিয়া ৫টি, ইনিয়েস্তা ২টি, ১টি পুয়োল। যে মাঝমাঠটা স্পেনের বিজয়ের চালিকাশক্তি হয়ে থাকল, সেখানে কারা ছিলেন মূল সেনাপতি? জাভি, ইনিয়েস্তা, বুসকেটস।
ফাইনাল শুরুর আগে মিডিয়া সেন্টারে এসে আর্জেন্টিনার ১৯৭৮ বিশ্বকাপ জয়ের মারিও কেম্পেস ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, স্পেনই জিতবে। কেন জিতবে? তাঁর বিশ্লেষণ, এই স্পেন বার্সেলোনার স্পেন। বার্সেলোনার ফুটবলকে হারানো কঠিন।
খেলা শেষে আর্জেন্টিনার সাংবাদিকেরা ‘ভিভা এস্পানা’ না বলে স্লোগান তুললেন, ‘ভিভা বার্সেলোনা’। আরে, এ তো বার্সেলোনার জয়! মেসি নেই, আর্জেন্টিনা পারেনি, মেসির বার্সেলোনা তো জিতেছে! হল্যান্ডের এক নায়কই হল্যান্ড-বধের অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন প্রতিপক্ষের হাতে—ইয়োহান ক্রুইফ। এ তো তাঁরই হাতে গড়া বার্সেলোনা।
হায় রে, হতাশা কিংবা আত্মতৃপ্তি কত সুড়ঙ্গ খুঁজে নিতে পারে! অবশ্য ভিয়া কিংবা স্পেনের আনন্দ এই সুড়ঙ্গ নিশ্চয়ই খুঁজছে না। তাদের আকাশটা ১১ জুলাই রাত থেকে অনেক বড় হয়ে গেছে।

No comments

Powered by Blogger.