উৎসবের দেশ স্পেন

রাতের অন্ধকার, শহরের রাস্তাঘাট ফাঁকা। শেষ বাঁশি শোনার অপেক্ষায় কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। এর মধ্যেই বেজে উঠল রেফারি হাওয়ার্ড ওয়েবের শেষ বাঁশি। রাতের অন্ধকারের বুক চিরে বেরিয়ে এল উল্লাসধ্বনি—ভিভা এসপানা (জয়তু স্পেন)। কেঁপে উঠল মাদ্রিদ, কেঁপে উঠল আসলে পুরো স্পেন। নিশুতি রাতের নীরবতা ভেঙে স্প্যানিশরা সমস্বরে ঘোষণা করল বিশ্বজয়ের বার্তা—‘ওলে-ওলে, চ্যাম্পিয়ন।’
উৎসব-রসদ সাজানোই ছিল। হাওয়ার্ডের শেষ বাঁশি বাজল, হল্যান্ডকে ১-০ গোলে হারিয়ে নিজেদের ফুটবল ইতিহাসে প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পেল স্পেন। সেই উৎসবে পরশু মেতে উঠেছিল গোটা স্পেন। রাতের বুক চিরে ফুটল হাজার হাজার আতশবাজি। আলোকিত হয়ে উঠল স্পেন, নেমে এল আলোকের ঝরনাধারা। লক্ষ-কোটি স্প্যানিয়ার্ডের দু চোখ দিয়ে ঝরল জল। প্রাপ্তির উচ্ছ্বাস ঝরে পড়েছে আনন্দাশ্রু হয়ে।
সবচেয়ে বড় উৎসবটা হয়েছে মাদ্রিদেই। মাদ্রিদের পাসেও ডি কাস্তেল্লানা এভিনিউতে বড় পর্দায় খেলা দেখছিল প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষ। আতশবাজি, ভুভুজেলা, গাড়ির হর্ন বাজিয়ে জয়োৎসব করে তারা। প্রায় সবার হাতেই ছিল স্পেনের লাল-সোনালি পতাকা আর কণ্ঠে ছিল গান—স্প্যানিশ, স্প্যানিশ, আমরা স্প্যানিশ।
শুধু মাদ্রিদেই নয়, বড় পর্দায় খেলা দেখার আয়োজন করা হয়েছিল স্পেনের প্রায় সব কটি শহরে। লাল-সোনালি পতাকায় মুড়ে গিয়েছিল পুরো স্পেন। শহরের রাস্তায় বড় পর্দায় খেলা না দেখে যারা বার বা বাড়িতে বসে খেলা দেখেছে, ম্যাচ শেষে তারা বেরিয়ে এসেছিল রাস্তায়। জয়ধ্বনিতে মুখরিত করেছে চারপাশ।
মাদ্রিদে কাল রাতে তাপমাত্রা ছিল ৩৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। তীব্র গরম সহ্য করেও জয় উদ্যাপন করতে রাস্তায় নেমেছিলেন ১৮ বছর বয়সী রাউল আর ষাটোর্ধ্ব হুলিও। মুখে রং দিয়ে লাল-সোনালি পতাকা আঁকা রাউল হাঁপাতে হাঁপাতেই বললেন, ‘আমরা খুব গর্বিত এবং খুব আনন্দিত। আমরা সবাই ভেবেছিলাম টাইব্রেকারে যাবে, কিন্তু ইনিয়েস্তা আমাদের বাঁচিয়েছেন এই জয়টা আমাদের প্রাপ্যই ছিল।’
স্পেনের ঐতিহাসিক জয়ের ক্ষণে পরশু মিলিয়ে গিয়েছিল সে দেশের ধনী-দরিদ্র আর রাজা-প্রজার ব্যবধান। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী অন্য সবার মতো রাস্তায় নেমে আসেননি, তবে আর দশজন স্প্যানিয়ার্ডের মতো তিনিও উচ্ছ্বাসে প্রগলভ। ‘আমি খুব খুশি এবং আবেগপ্রবণও হয়ে পড়েছিলাম’—রেডিও ক্যাডেনা সারকে বলেছেন স্পেনের প্রধানমন্ত্রী হোসে লুইস রদ্রিগেজ জাপাতেরো।
কাতালোনিয়া ও মাদ্রিদের দ্বন্দ্বের গল্প বহু পুরোনো, বলে শেষ করা যাবে না। রাজনীতি, সংস্কৃতি, ক্রীড়া—সবকিছুতেই সর্বদা বিভক্ত মাদ্রিদ ও বার্সেলোনা। কিছুতেই যেন তারা একমত হতে রাজি না, কণ্ঠে কণ্ঠ মেলাতে রাজি না। অথচ পরশু একটি দিনের জন্য সব বিভেদ দূর হয়ে গেল। মাদ্রিদের সঙ্গে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলল বার্সেলোনার। কাতালোনিয়ান আর মাদ্রিদিয়ানরা একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল, ‘ভিভা এসপানা’।

No comments

Powered by Blogger.