দাপটের ইসরায়েল, মুক্তির ফিলিস্তিন by ফারুক ওয়াসিফ

এক গ্রাম্য ইহুদি তরুণের যুদ্ধের ডাক এসেছে। বিদায় দেওয়ার সময় মা তাঁকে বলছে, ‘বাবা, বেশি পরিশ্রম করবি না। একটা করে তুর্কি মারবি আর জিরিয়ে নিবি।’ তখন ছেলেটা বলছে, ‘কিন্তু তুর্কিরা যদি আমাকে মারে?’ মা তো অবাক, ‘তোকে মারবে কেন, তুই তাদের কী ক্ষতি করেছিস?’ এই হলো সাধারণ ইসরায়েলি মনস্তত্ত্ব। জবরদখলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন থেকেই প্রতিবেশীর প্রতি ঘৃণা তাদের চালিকাশক্তি। ইসরায়েলের যা ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ আর আমেরিকার তা-ই ‘জাতীয় নিরাপত্তা’র অধিকার। ইসরায়েলের পুঁজি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি গণহত্যার প্রতি সহানুভূতি আর আমেরিকার পুঁজি ৯/১১-এর ঘটনার অজুহাত। তাদের এই আগ্রাসী ‘অধিকারের’ বলি অন্য রাষ্ট্রের স্বাধীনতা এবং নিজ দেশের সংখ্যালঘুদের জীবন। ইসরায়েলের জনসংখ্যার পনের শতাংশ আরব এবং তারা সেখানকার দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। ফিলিস্তিনের ৬০ ভাগ এলাকা, মিসরের গোলান উপত্যকা এবং জর্ডানের ভূখণ্ড দখল করে এবং লাগাতারভাবে আরব হত্যা চালিয়েও ইসরায়েল হলো ‘শান্তির নায়ক’! শুধু ইহুদিদের জন্য প্রতিষ্ঠিত এই রাষ্ট্রের আদর্শিক ভিত্তি ইহুদিবাদ যা কার্যত বর্ণবাদ। তা সত্ত্বেও ইসরায়েল গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার আর হামাস-হিজবুল্লাহ-ইরান মৌলবাদী! কী বিচিত্র এই দুনিয়ার নিয়ম।
গাধা যখন মোট বয় তখনও যেমন গাধা, যখন বোঝা নামিয়ে রাখে তখনও সে গাধা। ইসরায়েলের কাছে যুদ্ধ ও শান্তির অর্থ একই: দাপট জারি রাখা। মিডিয়ায় কুৎসা রটানো, তারপর অবরোধ এবং শেষে আগ্রাসন, এই হলো ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা। এভাবেই গত ৬২ বছরে ফিলিস্তিনী অঞ্চলকে টুকরো টুকরো করে গ্রাস করা হয়েছে। আজকের ফিলিস্তিন যেন দেয়াল দিয়ে ঘিরে বানানো এক বিরাট ছাদখোলা কারাগার। ২০০৭ সাল থেকে গাজাকে অবরুদ্ধ করে ভাতে-পানিতে মারার কাজ চলছে। তাতেও হার না মানায় রাসায়নিক বোমায় দেড় হাজার মানুষ হত্যাসহ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় সেখানকার অধিকাংশ ভবন। বেছে বেছে চলছে ‘টার্গেটেড কিলিং’। বিদেশের মাটিতে গুপ্তঘাতক লেলিয়ে ফিলিস্তিনি নেতাদের হত্যাও বন্ধ নেই। প্রতিটি ঘটনায় জাতিসংঘের ভূমিকা হয়েছে যাত্রার বিবেকের মতো— ঘটনার পরে তিনি আসেন এবং কিছু নীতিকথা শুনিয়ে নীরব হয়ে যান। আজ অবধি জাতিসংঘের কোনো প্রস্তাবই ইসরায়েল মানেনি।
যখন আরব সরকারগুলো ব্যর্থ, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ইসরায়েলের প্রতি পক্ষপাতী, তখন বিভিন্ন দেশের শান্তিবাদী কর্মীরাই প্রতিবাদের নৈতিক দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। ২০০৭ সালে থেকে চলছে ‘বয়কট ইসরায়েল’ আন্দোলন। অজস্র মানুষ ইসরায়েলি পণ্য কেনা বন্ধ করে সর্বাত্মক বর্জনের ডাক দিয়েছে। ফিলিস্তিনের সংহতির বিস্তার তাই আশার লক্ষণ। গাজামুখী ‘ফ্রিডম ফ্লোটিলা’ বা ‘মুক্তির নৌ-কাফেলা’ এই অহিংস আন্দোলনেরই ফসল। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু মানবাধিকারকর্মী, লেখক-সাহিত্যিক ও নোবেলজয়ী এতে সামিল হন। এর মাধ্যমে তাঁরা ইসরায়েলি অমানবিকতার দিকে বিশ্ববাসীর নজর কাড়তে চেয়েছিলেন। নয়জনের আত্মদানের মাধ্যমে মুক্তির সেই কাফেলা শতভাগ সফল হলো। ফ্রিডম ফ্লোটিলার আয়োজকরা জানিয়েছে, অচিরেই আরও বড় জাহাজবহর নিয়ে আবার তারা গাজার দিকে রওনা হবে।
অহিংস প্রতিবাদের নৈতিক শক্তিকেই ইসরায়েলের বেশি ভয়। এসব ক্ষেত্রে ইসরায়েলের নীতি হলো সামরিক আক্রোশে এমন দৃষ্টান্ত তৈরি করা যাতে ভবিষ্যতে কেউ চ্যালেঞ্জ করার সাহস না পায়। অথচ ফ্রিডম ফ্লোটিলায় সন্ত্রাসী ছিল না, হামাস সদস্য ছিল না; তাঁরা ছিলেন বিভিন্ন দেশের শান্তিবাদী নাগরিক। তাঁরা গাজার ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য খাবার, শিশুদের জন্য দুধ, ওষুধ আর আশ্রয়হীনের জন্য বাড়ি বানানোর সামগ্রী নিয়ে যাচ্ছিলেন। তারপরও ৭০০ শান্তিবাদী কর্মীর সাতটি জাহাজের বহরকে গাজা উপকূল থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে আন্তর্জাতিক জলসীমায় বাধা দেওয়া হয়। কমান্ডোরা হেলিকপ্টার থেকে জাহাজে নেমে নির্বিচার গুলি চালিয়ে নয়জনকে হত্যা করে। এই খবরে দুনিয়ায় শোরগোল ওঠে। যেসব আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সমর্থনে ইসরায়েল বিশ্ব জনমতকে ধোঁকা দিচ্ছিল, তারাও চক্ষুলজ্জায় নিন্দায় শামিল হয়। লন্ডনে ১০ হাজার মানুষ প্রতিবাদ করে। খোদ ইসরায়েলের রাজধানীতে রাস্তায় নামে পাঁচ হাজার শান্তিবাদী। খেয়াল করার বিষয়, প্রতিবাদের দিক থেকে আরবের স্বৈরশাহীগুলোর থেকে বেশি সোচ্চার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও ইউরোপীয় নাগরিক সংগঠনগুলো। তুরস্ক একে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বলে অভিযুক্ত করে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনে। বিশ্বব্যাপী আওয়াজ ওঠে, গাজা অবরোধ তুলে নাও। নিহত নয় তুর্কি হয়ে ওঠেন কোটি মানুষের বীর, পান শহীদি মর্যাদা। ।
আন্তর্জাতিক আইনে এটা জলদস্যুতা, যুদ্ধাপরাধ ও যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। এই কাজ সোমালীয়রা করলে বলা হতো জলদস্যুতা, ভেনেজুয়েলা বা ইরান করলে হতো ‘অসভ্যতা’। প্রতিকারে ন্যাটোর হামলা ছিল অনিবার্য। অথচ পরিহাস হচ্ছে, নিরাপত্তা পরিষদ কেবল একটি ‘নিরপেক্ষ তদন্তের’ প্রস্তাব করেছে এবং যথারীতি ইসরায়েল তা নাকচ করে দিয়েছে। ন্যাটো চুক্তির মূল কথাই হচ্ছে, সদস্য কোনো রাষ্ট্র আক্রান্ত হওয়া মানে সবাই আক্রান্ত হওয়া। তুরস্ক ন্যাটোভুক্ত হয়েও সুবিচার না পাওয়ায় আমেরিকার সঙ্গে তার সম্পর্কেরও অপূরণীয় ক্ষতি হলো। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ২০০৮ সালে বলেছিলেন, তাঁদের চার শত্রু হলো ফিলিস্তিনের হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ আর ইরান ও সিরিয়া। এখন সেই তালিকায় তুরস্কও যোগ হলো। ইতিমধ্যে ভেনেজুয়েলা, নিকারাগুয়া ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক বাতিল করেছে। ইসরায়েল বহুকাল এমন বেকায়দায় পড়েনি।
ইসরায়েল হলো এক হাতলহীন তলোয়ার। শত্রু ও মিত্র উভয়ের জন্যই তা একারণে বিপজ্জনক। দাপট ছাড়া অন্য কোনো উপায় তার জানা নেই। ফ্রিডম ফ্লোটিলায় হামলায় যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন মহাবিব্রত। ইরান আক্রমণের সাজানো ছকটা এতে কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেল। বারাক ওবামা এই বেয়াড়াপনাকে সহজভাবে নেবেন না। এর আগে নিষেধ সত্ত্বেও পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন চালিয়ে যাওয়া নিয়ে ওবামা অপমানিত বোধ করেন। জবাবে যুক্তরাষ্ট্র সফররত ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে রীতিমতো অপদস্থও করা হয়। কিন্তু সামনেই কংগ্রেস নির্বাচন। এ সময়ে প্রভাবশালী ইহুদি লবিকে তিনি চটাবেন না। আশাবাদীদের ধারণা, কংগ্রেসে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত হওয়া মাত্রই ইসরায়েলের ওপর চাপ বাড়াবেন ওবামা। ওবামার দোলাচল হলো, ইসরায়েলকে চাপ দিলে দেশের ভেতর থেকে তাঁর ওপর চাপ বাড়ে আর না করলে বাকি দুনিয়ায়, বিশেষ করে আরব ও মুসলিমরা ক্ষিপ্ত হয়।
ইহুদিদের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন হলোকস্ট। পরের বিপর্যয় হলো ১৯৪৮ সালে উগ্র ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা। প্রতিবেশীদের দাবিয়ে রেখে শত্রুপরিবৃত অবস্থায় ইসরায়েল আখেরে টিকতে পারবে না। তার উচিত ছিল মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন-ব্রিটেনের স্বার্থের পাহারাদারি না করে আরবদের সঙ্গে নিজেদের ভাগ্যকে মিলিয়ে নেওয়া। ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আঠারো বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই পরামর্শই তৎকালীন ইহুদিবাদী নেতাদের দিয়েছিলেন। ১৯৩০ সালে ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘লন্ডনে বসে ব্রিটিশ সরকার আর ইহুদিবাদী নেতাদের কোনো সমঝোতাই ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান আনবে না। ইহুদিদের সাফল্য সম্পূর্ণত আরব-ইহুদি সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল। ... ফিলিস্তিনে ইহুদিবাদী নেতারা যদি ইহুদিদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থকে আরবদের থেকে আলাদা করে ফেলে, তাহলে পবিত্র ভূমিতে কুৎসিত সহিংসতা ছড়িয়ে পড়বে।’ (ইংরেজি থেকে অনুবাদ লেখকের, সূত্র: Writtings of Rabindranath Tagore: A miscellany, Sahitta Akademi)
কবির ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে। দুর্ভাগ্য ইহুদিদের, কারও সুপরামর্শেই তারা কান পাতেনি। আজ তারা এমন এক রাষ্ট্রের নাগরিক, যে রাষ্ট্রটি হিটলারের জার্মানির মতো আপাদমস্তক দম্ভ আর ঘৃণায় আসক্ত। ফিলিস্তিনিদের দুর্ভাগ্য ততোধিক। পাশ্চাত্য ইহুদিদের তাড়িয়ে-পুড়িয়ে চালান করে আরবভূমিকে অশান্তি আর বঞ্চনার বৈশ্বিক মঞ্চ বানিয়ে ছেড়েছে। ফিলিস্তিনিরা যেন একসময়কার নির্যাতিত ইহুদি আর ইসরায়েল হলো একসময়কার ইহুদি নিধনকারী হিটলারি রাষ্ট্রের ভূত।
ইউরোপ থেকে অভিবাসী হওয়া ইহুদিরা নয়, ফিলিস্তিনের সত্যিকার মালিক ফিলিস্তিনিরাই। হাজার হাজার বছর যাবত তারা সেখানে বাস করে আসছে। সম্প্রতি এক ইসরায়েলি অধ্যাপক প্রমাণ করেছেন, ইসরায়েলের ইহুদিরা আদতে এক জাতি নয় এবং বাইবেলের যুগে ফিলিস্তিন থেকে ইহুদিদের নির্বাসিত হওয়ার মিথটিরও কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। এই ইহুদিদের বেশির ভাগই পূর্ব ইউরোপের খাজারীয় জাতি থেকে আসা আশকেনাজি জনগোষ্ঠীর লোক। (সূত্র: Sholmo Sand: The Invention of Jewish People) তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ সোলমো স্যান্ড দাবি করেছেন, বর্তমানের ফিলিস্তিনিরাই আদি সেমেটীয় হিব্রুভাষীদের উত্তরাধিকারি। এই ইতিহাস ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের অস্তিত্বের ন্যায্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
ইসরায়েলের ভবিষ্যত আরবের জনগণের সঙ্গে শান্তি ও সহযোগিতার মধ্যেই নিহিত। ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের ন্যায্য ভূমিবণ্টনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান শুধু আরবের নয়, বিশ্বশান্তিরও শর্ত। তা যতদিন না আসবে, ততদিন ফিলিস্তিন হয়ে থাকবে বৈশ্বিক অশান্তির স্নায়ুকেন্দ্র।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.