অচিরেই কাটবে গোলের খরা

বিশ্বকাপ ফুটবলের চলন্ত আসরের তৃতীয় দিনের দ্বিতীয় খেলাটি এইমাত্র শেষ হয়েছে। আমার একদা-প্রিয় দল রাশিয়াকে প্লে-অফ ম্যাচে হারিয়ে এবারের বিশ্বকাপে উঠে আসা সার্বিয়াকে ১-০ গোলে পরাজিত করে আফ্রিকার অন্যতম আশার প্রদীপ আমার কবিবন্ধু ওকাইয়ের ঘানা (দ্র: আফ্রিকার চিঠি/দূর হ দুঃশাসন) তার বিজয়পথের প্রথম বাধাটি অতিক্রম করল। প্রথমার্ধ গোলশূন্যভাবে শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয়ার্ধের শেষ দিকে পাওয়া পেনাল্টি কিক বা জরিমানাশট থেকে দিনের একমাত্র গোলটি সুসম্পন্ন করেছেন মিস্টার Asamoy Gyan। প্রতিপক্ষের মরণজালে বল ছোঁয়াতে পারার কল্যাণে মুহূর্তের মধ্যে বিশ্বখ্যাতি অর্জনকারী ওই তরুণের নামটির বাংলা উচ্চারণ ঠিক কী হবে, বলতে পারছি না। অসোময় জ্ঞান? নাকি অসময় জিয়ান—? উপাধিটা মনে হচ্ছে জ্ঞান-ই হবে। তা আমার মতো অগুণী মানুষের নামের শেষে যদি গুণ থাকতে পারে, তো বিশ্বকাপ ফুটবল খেলায় অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জনকারী একজন ফুটবলারের নামের শেষে জ্ঞান শব্দটা তো যুক্ত হতেই পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে শব্দটির উর‌্যাস নিয়ে। ওই সংস্কৃত শব্দটি ঘানায় গেল কীভাবে? ভারতের স্পিনার প্রজ্ঞান ওঝার নামটি মনে পড়ছে। প্রজ্ঞান স্বীকৃত জ্ঞানীও নন, সাপে কাটা মানুষের চিকির‌্যাসা করার বৈদ্যও তিনি নন। অথচ একই সঙ্গে তিনি জ্ঞানী ও কৃত্তিবাস ওঝার মতো ওঝাও বটে। পৃথিবীতে কত রকমের নাম আর কত রকমের পদবি যে আছে মানুষের! বিশ্বকাপের খেলা যত সামনে গড়াবে, এ রকম আরও কত অদ্ভুত নামের সঙ্গে যে আমাদের পরিচয় ঘটবে! গর্জনশীল ৩২ দলের প্রথম রাউন্ড শেষেই আমরা সেই চমর‌্যাকার নামের তালিকাটি পাব।
ঘানাকে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই জয়ের আনন্দ উপহার দেওয়া ওই তরুণ জ্ঞানী তো বটেই। ফ্রান্সের বিশ্বকাঁপানো স্ট্রাইকার প্লাতিনিকেও আমি পেনাল্টি মিস করতে দেখেছি। সেখানে প্রচণ্ড স্নায়ুচাপের মধ্যেও এতটুকু বিচলিত না হয়ে ঘানার ‘অসোমান জ্ঞানী’ [ওসমান গনি নয়তো?] মহাশয় সার্বিয়ার গোলরক্ষককে যেভাবে বোকা বানালেন, ওর লম্বা চুল আর কটা হলুদরঙের জার্সির দম্ভকে যেভাবে পরাভূত করলেন, তার অকুণ্ঠ প্রশংসা না করে উপায় কী? এমন দৃপ্ত পায়ে ওই শটটা তিনি নিলেন, আই-কন্টাক্টের মধ্যে এমনই ছলনা ছিল তার যে কামানের গোলার মতো ধেয়ে আসা বলটির গতিমুখের বিপরীত দিকে ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া সার্বিয়ান গোলরক্ষকটির আর কিছুই করার ছিল না।
তৃতীয় দিনের প্রথম ম্যাচটিতে আলজেরিয়ার বিরুদ্ধে সম্পাদিত স্লোভেনিয়ার একমাত্র গোলটিকে যদি গোল বলে মানি, তাহলে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আমেরিকার পাওয়া গোলটিকেও আমলে নিতে হয়। ওই দুটো গোল নিয়ে বেশি কথা না বলাই ভালো। শুধু প্রার্থনা করব, এ রকম না চাহিতে পাওয়া গোল দিয়ে যেন বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্তপর্বের কোনো গুরুত্বপূর্ণ খেলার সমাপ্তি না ঘটে।
চলমান বিশ্বকাপ ফুটবলে গোলের খরা তৃতীয় দিনেও অব্যাহত রয়েছে। তিন দিনের সাত খেলায় এ পর্যন্ত মোট গোল হয়েছে নয়টি। শুধু এক গোলের ন্যূনতম ব্যবধানে নয়, একাধিক গোলের ব্যবধানে জয় বলেও যে একটা কথা আছে, এশিয়ার মাটির প্রদীপ দক্ষিণ কোরিয়া দক্ষিণ-আফ্রিকায় অনুপস্থিত থাকলে, জানি না, আমাদের সে কথা স্মরণ করিয়ে দিত কে?
এই লেখা যখন শেষ করে এনেছি, তখন আমার টিভিতে অস্ট্রেলিয়া ও জার্মানির মধ্যকার দিনের শেষ-খেলার প্রথমার্ধ শেষ হয়েছে। গত বিশ্বকাপখ্যাত পোডলস্কি আর ক্লোসার দেওয়া জোড়া গোলের সুবাদে জার্মানি অস্ট্রেলিয়াকে দৃপ্ত পায়ে মাড়িয়ে চলেছে। প্রথমার্ধের খেলা দেখে মনে হলো, মাইকেল বালাককে দলের বাইরে রাখার দুর্বলতা জার্মানি কাটিয়ে উঠেছে। দ্বিতীয়ার্ধের খেলায় ভিন্ন কিছু ঘটবে বলে মনে হয় না। মনে হচ্ছে, বিশ্বকাপ ফুটবলে গোলের খরাও অচিরেই কাটবে।
সর্বশেষ তথ্য: বিশ্বকাপের আট নম্বর ম্যাচটিকে প্র্যাকটিস ম্যাচে পরিণত করে জার্মানি শেষ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়াকে ৪-০ গোলে হারিয়েছে।
এই লেখাটি আমি উর‌্যাসর্গ করছি আমার অকালপ্রয়াত দুই বন্ধু—চলচ্চিত্রকার বাদল রহমান (৬২) এবং ক্যাপ্টেন (অব.) জিয়াউদ্দিনের (৬০) স্মৃতির উদ্দেশে। মাত্র এক দিনের ব্যবধানে আমি আমার এই দুজন ক্রীড়াপাগল বন্ধুজনকে হারিয়েছি।

No comments

Powered by Blogger.