দুই দলের দুই গোল, জিতল তবু হল্যান্ড

ক্যামেরাটা সব সময় তাঁকে ধরতে পারেনি। কিন্তু তিনি, ডাচ ফুটবলের ‘ভাগ্যবিড়ম্বিত’ রাজপুত্র ইয়োহান ক্রুইফ ধূসর রঙের স্যুট পরে মাঝেমধ্যেই উঠে পড়ছিলেন ভিআইপি গ্যালারির আসন থেকে। ১৯৭৪ সালে জার্মান আর ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টাইনরা ডাচদের শিরোপা-স্বপ্ন ভেঙে দেওয়ার পর থেকেই তাঁর মধ্যে এই ছটফটানি। বয়ে বেড়ান একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা।
হল্যান্ড দলকে খেলতে দেখলে, তাদের খেলায় কোনো খামতি চোখে পড়লে সেই যন্ত্রণা যেন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এবার দেখা গেল তিনি উঠে দাঁড়িয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত বাতাসে ছুড়ে দিলেন। আর ঠিক সেই সময়েই জয়ের রাস্তাটা পেয়ে গেল ডাচ দল। সেটি অবশ্য আত্মঘাতী গোলে।
বাঁ প্রান্ত থেকে ডাচ দলের আসা একটি ক্রস রুখতে গিয়ে সিমন পোলসেন হেড করলেন, সেটিই বরং বিপদ বাড়াল। ঢুকে গেল জালে। দায় শুধু তাঁর একার নয়। তাঁর হেড গিয়ে লেগেছিল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সতীর্থ ডিফেন্ডার ড্যানিয়েল অ্যাগারের পেছন দিকে। তাতে বদলে গিয়েছিল বলের গতিপথ। আর এই আত্মঘাতী গোলেই বিরতির ঠিক পরপরই, ৪৬ মিনিটে প্রথম গোলের দেখা পেয়ে গেল হল্যান্ড। গ্যালারির কমলা রঙের সমুদ্রে তখন উথালপাথাল ঢেউ। আর তাতে অদৃশ্যভাবে দুই ফোঁটা অশ্রু মিশে গেল পোলসেনের।
এর পর থেকেই ডেনমার্কের কাছ থেকে খেলাটা চলে যেতে থাকে হল্যান্ডের পায়ে। মাঝমাঠে মার্ক ফন বোমেল আর তাঁর ওপরে ওয়েসলি স্নাইডারের কল্যাণে মাঝেমধ্যেই তীরের ফলার মতো আক্রমণ হানছিল ডাচরা। কিন্তু সেগুলো গোলে রূপান্তরিত হচ্ছিল না। পালের্মোর সিমন কায়ের ও লিভারপুলের ড্যানিয়েল অ্যাগার—এই দুই ডিফেন্ডারের গড়ে তোলা দেয়ালে প্রতিহত হয়ে ফিরছিল। এর মধ্যে রাফায়েল ফন ডার ভার্টকে অবশ্য গোলবঞ্চিত করলেন ড্যানিশ গোলকিপার টমাস সোরেনসেন। রবিন ফন পার্সির পাসে যে দুর্দান্ত শটটি নেন রিয়াল মিডফিল্ডার, সেটি বাতাসে ঝাঁপিয়ে বের করে দেন তিনি।
এ পর্যন্ত খেলাটি ছিল অনেকটা ঘুমপাড়ানিয়া। জোহানেসবার্গের শীতের সঙ্গে সেটি বেশ মানিয়ে যাচ্ছিল। ৬৭ মিনিটে ফন ডার ভার্টের বদলি হিসেবে নেমে এলজেরো ইলিয়া এসেই খেলাটা পাল্টে দিলেন। গতি আনলেন। রিয়াল থেকে বয়ে আনা ভন ডার ভার্টের বিষণ্নতা কাটিয়ে দিলেন। লিভারপুল ফরোয়ার্ড ডির্ক কিউটের পা থেকে আসা ৮৫ মিনিটের গোলটি তাঁর নামের পাশেও বসতে পারত। আগুয়ান গোলরক্ষক সোরেনসেনকে কাটিয়ে মাটিঘেঁষা যে শট নিয়েছিলেন ইলিয়া, সেটি পোস্টে লেগে ফিরে আসে। কিন্তু ড্যানিশ ডিফেন্ডাররা বলের কাছে পৌঁছানোর আগেই আসল কাজটা করে ফেলেন ডির্ক কিউট। ছোট্ট টোকায় পাঠিয়ে দেন জালে (২-০)।
নিগেল ডি জংয়ের বদলি নেমেই ডেমি ডে জিউ ব্যবধান ৩-০ প্রায় করেই ফেলেছিলেন। তাঁর প্লেসিং শট বাঁচিয়ে আত্মঘাতী গোলের পাপস্খলন করেছেন পোলসেন।
বাছাইপর্বে ডেনমার্ক পর্তুগালের গ্রুপ থেকে সবার আগে টিকিট পেয়েছিল বিশ্বকাপের। হল্যান্ড ৮ ম্যাচের সব কটিতে জিতে এসেছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। ওরা লাল, এরা কমলা। দুই ‘ভাইকিংয়ের’ লড়াইটা জমবে বলে ধরে নিয়েছিল প্রায় সাড়ে ৮৩ হাজার দর্শক। কিন্তু সে রকম কিছুই হলো না। না দেখা গেল ডাচদের সেই শিল্পিত ফুটবল, না পাওয়া গেল ধীরস্থির শান্ত স্বভাবের ড্যানিশদের ‘মনের আনন্দে’ খেলা ফুটবল।
ড্যানিশরা প্রথমার্ধের সামান্য নড়াচড়ার পর শেষে একেবারে সেধিয়ে গেল খোলসের মধ্যে। তাদের আশা ছিল, আর্সেনালের বেন্টনার। কিছুই করতে পারলেন না তিনি।
খেলা শেষে ড্যানিশ কোচ মর্টেন ওলসেন বললেন প্রথমার্ধের খেলার কথা, ‘প্রথমার্ধে আমাদের খেলাটা ভালো হয়েছে। ওই সময়ই গোল করে ফেলা উচিত ছিল আমাদের।’ যে কাজটা উচিত ছিল, সেটা তো হয়ইনি, উল্টো হলো আত্মঘাতী গোল। পোলসেন সম্পর্কে প্রশ্ন করলে ড্যানিশ কোচ নীরব হয়ে গেলেন। খানিক পর বললেন, ‘কোনো মন্তব্য নয়।’ তবে এখনই সব শেষ হয়ে গেছে বলে মনে করছেন না ওলসেন।
ওড়ার আকাশটা এখনো তাঁর জন্য খোলা রইল। তবে স্বীকার করে গেলেন ক্যামেরুন আর জাপানের বিপক্ষে জিততে হবে। জয়টা খুব সহজ অবশ্য নয়। দক্ষিণ আফ্রিকার এই উঁচু ভূমির মতোই তা কঠিন।
ম্যান অব দ্য ম্যাচ স্নাইডারও সকার সিটির গ্যালারির মতো নিজেদের খেলায় নিজেই তৃপ্ত হতে পারেননি। তিনি নিজে ইন্টার মিলানে যা দেখিয়েছেন এ মৌসুমে, তার কিছু মেলে ধরেছেন। কিন্তু কোথায় সেই ডাচ ফুটবল? কোথায় গতি, কোথায় আক্রমণের ঢেউ?
‘হ্যাঁ, আমরা ভালো খেলতে পারিনি। প্রথমার্ধটা কঠিন ছিল। তবে প্রথম ম্যাচে জেতাটাই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জয় নিয়ে ফিরেছি। তবে দেখি, সামনের ম্যাচগুলোয় কী করতে পারি আমরা’—স্নাইডার কথাগুলো বললেন বটে, তবে মনে হলো জোর করে বলা। সুন্দর ফুটবল এখনো সোনার হরিণ হয়েই থাকল এ পর্যন্ত। সামনে কি ধরা দেবে সেই হরিণ?
ইতিহাসের কমলা রঙের পাতায় দাগ দিতে পারবে হল্যান্ড?

No comments

Powered by Blogger.