নোবেলজয়ী নারীরা by শায়লা রুখসানা

বিশ্বজুড়ে আজ উদ্যাপিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শতবর্ষ। বিশ্বের সর্বাধিক সম্মানজনক পুরস্কার নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন অনেক নারী। নোবেল পুরস্কার প্রবর্তনের দুই বছর পরই এই সম্মানজনক পুরস্কার পান একজন নারী। তিনি মাদাম কুরি। এখন পর্যন্ত সব বিভাগে ৪১ জন নারী নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে সাহিত্যে পেয়েছেন ১২ জন নারী।
এঁরা হলেন সুইডেনের সেলমা লগারলোফ, ইতালির গ্রাজিয়া ডেলেড্ডা, নরওয়ের সিগরিড আন্ডসেট, যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল এস বাক, চিলির গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল, জার্মানির নেলি স্যাক্স, আফ্রিকান-আমেরিকান নাদিন গর্ডিমার, যুক্তরাষ্ট্রের টনি মরিসন, পোল্যান্ডের বিসলোবা সিমবোর্স্কা, অস্ট্রিয়ার আলফ্রেড জেলিনেক, ব্রিটিশ ডরিস লেসিং ও জার্মানির হেরটা মুয়েলার।
এঁদের মধ্যে চারজনের জীবন ও কর্ম নিয়ে খানিকটা আলোকপাত করা হলো।
সেলমা লগারলোফ: ১৯০৯ সালে সাহিত্যে প্রথমবারের মতো নোবেল জয় করেন কোনো নারী। তিনি হলেন সুইডেনের সেলমা লগারলোফ। ১৮৫৮ সালে জন্ম নেওয়া সুইডিশ এই লেখিকা সেই সময়েও লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। শিশুদের জন্য লেখা তাঁর দ্য ওয়ান্ডারফুল অ্যাডভেঞ্চারস অব নিলস বইয়ের জন্য অনেক বেশি বিখ্যাত। তিনি প্রায় ১০ বছর ধরে স্কুলে পড়িয়েছেন। সেখান থেকেই তাঁর গল্প বলার স্বচ্ছন্দ অভ্যাসটি গড়ে ওঠে বলে মনে করা হয়। স্কুলে শিক্ষকতার সময়ই প্রথম উপন্যাস লেখেন। এরপর লেখালেখিবিষয়ক এক প্রতিযোগিতায় তাঁর বইয়ের প্রথম অনুচ্ছেদটি জমা দিলে পুরো বইটি লেখার প্রস্তাব পান। ভাবাই যায় না, বইয়ের একটি অনুচ্ছেদ থেকে পুরো বই লেখার প্রেরণা! বইটির জন্য অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়ায় এ ঘটনাটি তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যয় করতে তিনি তাঁর নোবেল পদক এবং স্বর্ণপদক ফিনল্যান্ড সরকারের কাছে পাঠিয়ে দেন। ৮১ বছর বয়সে ১৯৪০ সালে মারা যান সেলমা লগারলোফ।
পার্ল এস বাক: চীনের কৃষকদের জীবনের আখ্যান নিয়ে এবং নিজের আত্মজীবনীমূলক রচনার জন্য ১৯৩৮ সালে নোবেল জয় করেন পার্ল এস বাক। ১৮৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম ভার্জিনিয়ায় জন্ম। তিন মাস বয়সের সময় পার্ল এস বাকের পরিবার চলে যায় চীনে। সেখানেই একটানা ১৪ বছর কাটান তিনি। জিনজিয়াং প্রদেশে বড় হন পার্ল।
প্রথম উপন্যাস ইস্ট উইন্ড-ওয়স্ট উইন্ড। ১৯৩১ সালে দ্বিতীয় উপন্যাস দ্য গুড আর্থ প্রকাশিত হয়। এ বইটি প্রকাশের পর টানা দুই বছর সর্বোচ্চ বিক্রির বইয়ের রেকর্ড ধরে রাখে। পুলিত্জার পুরস্কারও পেয়ে যান এ বইয়ের জন্য। প্রথম মার্কিন নারী হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান তিনি। শিশুসাহিত্য, নাটক, গল্প, উপন্যাস, কবিতা যেমন লিখেছেন, তেমনি চীনা সাহিত্যের প্রচুর অনুবাদ করেছেন।
পরে তিনি স্থায়ীভাবে ফিরে যান যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে লেখালেখির পাশাপাশি তিনি মানবাধিকারকর্মী হিসেবে কাজ করেন। বিশেষ করে নারীদের অধিকার রক্ষায় তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন। পার্ল এস বাক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠান এশিয়ার বিভিন্ন দেশের কয়েক হাজার শিশুর জীবনযাপনের জন্য অর্থনৈতিক সুবিধা দেয়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রিন হিলস ফার্ম এখন ঐতিহাসিক স্থানের তালিকার একটি। ১৯৭৩ সালে ৮১ বছর পূর্ণ করার ঠিক দুই মাস আগে তিনি মারা যান।
ডরিস লেসিং: ইরানে জন্ম নেওয়া ব্রিটিশ নাগরিক ডরিস লেসিং সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান ২০০৭ সালে। তাঁর বাবা ছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন। আর মা সেবিকা। ডরিস লেসিং বিচিত্র সব পেশায় জড়িত ছিলেন। স্কুলিং শেষ করার পর তিনি একজন নান হিসেবে জীবন শুরু করেন। এরপর টেলিফোন অপারেটর, অফিস সহকারী এবং স্টেনোগ্রাফারের কাজও করেন। এরই মধ্যে শুরু করেন সাংবাদিক হিসেবে ক্যারিয়ার। এ সময় প্রকাশিত হয় তাঁর কিছু ছোটগল্প। অতঃপর লেখালেখিতেই নিজেকে সঁপে দেন। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়ে পরমাণু অস্ত্ররোধী আন্দোলনে অংশ নেন।
দ্য গ্রাস ইজ সিঙ্গিং নামের প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালে। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত দ্য গোল্ডেন নোটবুক তাঁর জন্য সত্যিকারের সাফল্য নিয়ে আসে।
হেরটা মুয়েলার: সর্বশেষ ২০০৯ সালে সাহিত্যে নোবেল পান জার্মান লেখক হেরটা মুয়েলার। হেরটা মুয়েলার ছোটগল্প দিয়ে লেখকজীবনের শুরু করেন। ১৯৫৩ সালে রুমানিয়ায় জন্ম। জার্মান ও রুমানিয়ান সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। একটি কারখানায় অনুবাদকের কাজ করতেন। গোয়েন্দা পুলিশের সোর্স হওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তাঁকে অনুবাদকের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এরপর তাঁকে নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতেও অপদস্থ হতে হয়। তবু থেমে যাননি তিনি। মুয়েলার তাঁর লেখায় রুমানিয়ার স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার বলে রুমানিয়ার সমালোচকেরা তাঁর প্রতি বিরূপ।

No comments

Powered by Blogger.