বাংলা ভাষার ব্যাকরণ তৈরি হবে কবে -আমার ভাষা আমার একুশ by সৌরভ সিকদার

বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে হাজার বছরেরও আগে এটা যেমন সত্য, তেমনি অবিশ্বাস্য আরেকটি সত্য হচ্ছে, বাংলা ভাষার নিজস্ব কোনো ব্যাকরণ নেই। সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণের ক্রাচে ভর দিয়েই আমরা এতটা পথ পার হয়ে এসেছি। অথচ আমাদের শিশুরা বিদ্যালয়ে গিয়ে ব্যাকরণের সংজ্ঞা শিখেছে, ‘যে বিদ্যা পাঠ করিলে ভাষা শুদ্ধ করে লিখিতে, পড়িতে ও বলিতে পারা যায় তাকে ব্যাকরণ বলে।’ প্রকৃতপক্ষে, আমাদের শিক্ষার্থীরা এসব ব্যাকরণ পাঠ করে ভাষা শুদ্ধভাবে শেখে না, তারা অধিকাংশ আঞ্চলিক উচ্চারণে কথা বলে এবং বানান শুদ্ধ লিখতে পারে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষার প্রভাবে শিশুপাঠ্য ব্যাকরণগুলোও স্বাবলম্বী হতে পারেনি; এমনকি সেখানে ভাষার প্রমিত রূপ বিষয়ে ব্যবহারিক বা প্রায়োগিক কোনো জ্ঞান লাভের সুযোগ নেই। ব্যাকরণবিদ জ্যোতিভূষণ চাকী লিখেছেন, ‘এত দিন গ্রামার বলতে শুধু লেখার ব্যাপারটাই বোঝাত, এখন নব্য-ব্যাকরণ বলতে মুখের ভাষার ব্যাকরণই বোঝায়।’ কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এখনো পর্যন্ত চলিত বাংলায় বা মুখের ভাষার উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যাকরণ রচিত হয়নি। প্রচলিত ব্যাকরণ বাংলা ভাষায় কোন কোন ধ্বনি আছে তা উল্লেখ করলেও ‘এ’ ধ্বনি কখন ‘এ্যা’ উচ্চারিত হবে তা শেখায় না, আমাদের প্রতিদিনের ভাষায় ক্রিয়াপদ বা বাক্যের যে রূপান্তর ঘটছে তার বিশ্লেষণ নেই।
বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় ব্যাকরণ ও অভিধান রচনা শুরু হয় ইউরোপীয় ধর্মযাজক, বণিক ও আগন্তুকদের হাতে প্রথমে ইংরেজিতে, পরে বাংলায়। ১৭৪৩ সালে পর্তুগিজ ফাদার মনোএল দা আস্সুম্পসাঁও রোমান হরফে প্রথম বাংলা ব্যাকরণ রচনার সূচনা করলেও প্রথম পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ রচনা করেন ১৭৭৮ সালে হ্যালহেড। উনিশ শতকের শুরু থেকে ধরলে ২০০ বছরেরও অধিক কাল ধরে উইলিয়াম কেরি বা মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের ‘ভাষাকথাক্রম’ (১৮১০)-এর পর কম করে হলেও কয়েক হাজার ব্যাকরণগ্রন্থ রচিত হয়েছে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে। কিন্তু সেগুলো বাংলা ভাষার গতি-প্রকৃতি-বৈশিষ্ট্য যতটা না ধারণ করেছে, তার চেয়ে বেশি সংস্কৃত কারক-বিভক্তি-সন্ধিতে বন্দী হয়েছে।
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বাংলা ভাষার ব্যাকরণ বিষয়ে বলেন, ‘পৃথিবীর প্রত্যেক ভাষার আঞ্চলিক ও প্রমিত রূপ থাকে। শিক্ষক প্রমিত রূপ ব্যবহার করেন এবং শেখান। আমাদের বাংলায় প্রমিত রূপ আছে; কিন্তু দুর্ভাগ্য, ক্লাসে শিক্ষক আঞ্চলিক ভাষায় পড়ান, এমনকি বাংলা ব্যাকরণও। ফলে শিক্ষার্থীর ভাষাজ্ঞান প্রমিত হয় না। স্বাধীনতার আগে শহীদ মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীরা মোটামুটি ভালো একটি ব্যাকরণ তৈরি করেছিলেন। টেক্সট বুক বোর্ডের এই ব্যাকরণ পরে অন্যরা নষ্ট করেছে। সত্যি বলতে কি, বাংলা ভাষার নিজস্ব ব্যাকরণ তৈরি হয়নি, শিশুপাঠ্য তো নয়ই। আমাদের ধ্বনি, ধ্বনির উচ্চারণ, ধ্বনি ও লিপির সম্পর্ক, প্রমিত ও আঞ্চলিক ভাষার পার্থক্য, উচ্চারণ, বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি শেখার উপযোগী ব্যবহারিক ব্যাকরণ রচনা খুবই জরুরি। বাংলা ব্যাকরণ হবে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানসম্মত। ভাষার প্রমিত রূপটি শিক্ষার্থীদের শেখার উপযোগী। অনেক পরে হলেও বাংলা একাডেমী কাজটি শুরু করেছে। আর এ পর্যন্ত রচিত ব্যাকরণের মধ্যে আমি সুনীতি কুমারের ‘ভাষা-প্রকাশ বাংলা ব্যাকরণ’কে সেরা মনে করি।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের কাছে বাংলা ব্যাকরণ একটি নিরস ও ভীতিপ্রদ বিষয়। সে কারণে তারা ব্যাকরণ পড়ে ভাষার অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা শেখে না, শূন্য বিভক্তি প্রয়োগের দৃষ্টান্তের জন্য মুখস্থ করে ‘পাগুটাদীপতি’। টেক্সট বুক বোর্ড বিষয়টি নিয়ে ভেবেছে সে প্রমাণ এখনো আমরা পাইনি।
অনেক দেরিতে হলেও ২০০৯ সালে এসে বাংলা একাডেমী ‘বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’ তৈরিতে হাত দিয়েছে দুই বাংলার গবেষক-ভাষাবিদদের নিয়ে। এবার হয়তো আমরা সংস্কৃত ব্যাকরণের আঁচল ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারব। শহীদ মুনীর চৌধুরী বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাষার অস্তিত্ব প্রকৃতিবাদ অভিধানের ভেতর নয়, বাঙালির মুখে।’ সেই মুখের ভাষার ব্যাকরণ এবং শিশু-কিশোরদের জন্য ব্যাকরণের আনন্দপাঠ এ মুহূর্তে বাংলা ভাষায় খুব জরুরি।
সেই ১৮৮৫ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘প্রকৃত বাংলা ব্যাকরণ একখানিও প্রকাশিত হয় নাই।...বাংলা ব্যাকরণের অভাব আছে, ইহা পূরণ করিবার জন্য ভাষাতত্ত্বানুরাগী লোকের যথাসাধ্য চেষ্টা করা উচিত।’ ১০০ বছরেরও অধিক সময় পার হলেও আমরা এখনো বাংলা ব্যাকরণ রচনা করতে পারিনি। আশা করি, বাংলা একাডেমী এই লজ্জা থেকে বাংলাভাষীদের এবার মুক্তি দেবে।
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.