দিনবদলের সংগ্রামে সাফল্য by নূহ-উল আলম লেনিন

বর্তমান মহাজোট সরকারের প্রথম বছর পূর্ণ হলো। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ‘দিনবদলের সনদ’-এর মূল বিষয়টি হচ্ছে ইতিবাচক পরিবর্তনের অঙ্গীকার। দিনবদলের তাগিদ উত্সারিত হয়েছে দেশের বাস্তবতা থেকে। গণতন্ত্র, সুশাসন ও ক্ষুধা-দারিদ্র্য-নিরক্ষরতামুক্ত সুস্থ-সচ্ছল-মানবিক জীবন গড়ে তোলার জন্য এ দেশের মানুষ দীর্ঘদিন সংগ্রাম করেছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অনুপস্থিতি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা এবং হেরে গেলে সংসদ বর্জন ও সংসদকে অকার্যকর করা একটা ক্রনিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশবাসী এ সমস্যা-সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।
মানুষ কম দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তথা চাল, ডাল চেয়েছে; চেয়েছে গ্যাস-বিদ্যুতের নিশ্চয়তা, আয়-রোজগারের ব্যবস্থা, জীবন-জীবিকা, চলাফেরার নিরাপত্তা, ঘুষ, দুর্নীতির অবসান। মানুষ চেয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো সাংঘর্ষিক রাজনীতির বদভ্যাস ত্যাগ করুক, সংসদ কার্যকর হোক—সর্বোপরি নেতা-নেত্রীরা নিজেদের পুরোনো অভ্যাস, ধ্যান-ধারণা, আচার-আচরণ-পরিবর্তন করুক। মানুষ বদলালে, নেতা-নেত্রীরা বদলালে রাজনীতি বদলাবে। রাজনীতি বদলালে দেশ বদলাবে, দিন বদলাবে।
আওয়ামী লীগ সংসদ নির্বাচনে দিনবদলের এ অঙ্গীকারই করেছে। সরকারের আপেক্ষিকভাবে বড় কিছু সাফল্যের কথা বলার আগে আমি আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব নিজেদের বদলানোর যে সচেতন চেষ্টা করছেন, সেদিকে একটু আলোকপাত করতে চাই।
উদাহরণটা আজ একজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখব। তিনি শেখ হাসিনা। নিজের উপলব্ধি থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেকে বদলের দুঃসাধ্য সাধন করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনা ছিল, তিনি অসতর্ক মন্তব্য ও অসহিষ্ণু আচরণ করেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল অতিকথন দোষ ও প্রগলভতার। গত এক বছরে শেখ হাসিনা নিজেকে এ অভিযোগ থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। দ্বিতীয়ত, তিনি ছাত্রলীগ বা যুবলীগের একাংশের বাড়াবাড়িকে প্রশ্রয় দেননি। তিনি ছাত্রলীগের ‘সাংগঠনিক নেত্রী’র অবাস্তব অবস্থানটি ত্যাগ করেছেন। নতুন প্রজন্ম গত নির্বাচনে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যাশায় শেখ হাসিনাকে যে সমর্থন জানিয়েছে, তাদের কাছে নিজেকে পরিবর্তিত নেতা হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করছেন তিনি। শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার বিপরীতে রাজনীতি থেকে নিজের সন্তান ও রক্তসম্পর্কের পরিবারকে দূরে রেখেছেন। ‘পরিবারতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস থেকে বিরত রয়েছেন। কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা বিতর্কিত দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিদের মন্ত্রিসভা এবং দলের নেতৃত্ব থেকে বাদ দিয়েছেন। ঝুঁকি নিয়ে হলেও তিনি পুরোনোদের বাদ দিয়ে একটা নতুন নেতৃত্বের দল গড়ে তোলার সাহস করেছেন। নেতৃত্বে নারীর অংশগ্রহণ বাড়িয়েছেন।
সর্বোপরি, গত এক বছরে শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার বাংলাদেশে একটা সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের কারচুপির নির্বাচনের পর বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াত জোটের সন্ত্রাসীরা আওয়ামী লীগের কর্মী, সমর্থক ও সংখ্যালঘুদের ওপর যে রক্তাক্ত প্রতিশোধ গ্রহণ করে দেশব্যাপী সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল, শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের কর্মীদের তা থেকে বিরত রেখেছেন। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটলেও বাংলাদেশে এখন কোনো রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও হানাহানি নেই।
দেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে সব স্থায়ী কমিটি গঠিত হয়েছে। বিরোধী দলও আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পেয়েছে। সংসদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন, স্থানীয় সরকার আইন প্রণয়ন, মানবাধিকার আইন-২০০৯ প্রণয়ন ও মানবাধিকার কমিশন গঠন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে চাকরির বয়সসীমা দুই বছর বৃদ্ধি প্রভৃতি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিরোধী দল সংসদে যোগদান করলে সংসদ কার্যকর হওয়া ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সংহত হওয়ার সুযোগ পেত।
শেখ হাসিনা অত্যন্ত সাহস, প্রজ্ঞা ও দক্ষতার সঙ্গে বিডিআর বিদ্রোহ মোকাবিলা করে রাষ্ট্রনায়কোচিত নজির স্থাপন করেছেন। বিডিআর বিদ্রোহ ও আইলার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের যথেষ্ট শক্তি ক্ষয় হয়েছে এবং দেশ পুনর্গঠনের কাজ ব্যাহত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সরকারের পাঁচটি অগ্রাধিকারের বিষয় চিহ্নিত করা হয়েছিল। এ পাঁচটি ক্ষেত্রেই সরকারের কমবেশি সাফল্য রয়েছে। সরকার দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি রোধ করে চাল-আটাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। মূল্যস্ফীতির হার ১০ দশমিক ৮২ শতাংশ থেকে বর্তমানে ৪ দশমিক ৬৯ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। বিশ্বমন্দার অভিঘাত সত্ত্বেও আমাদের রপ্তানি-আয় ১০ দশমিক ৩১ শতাংশ এবং রেমিট্যান্স ২২ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বকালের রেকর্ড ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে রাজস্ব আদায়ের হার বেড়েছে ১২ দশমিক ৮৭ শতাংশ, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৬ শতাংশে উন্নীত হবে।
দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে উঠছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠা গেছে। এ ক্ষেত্রে কৃষি, বিশেষত খাদ্য উত্পাদন বৃদ্ধি বড় রকমের অবদান রেখেছে। বিশ্বব্যাংক ও দাতা দেশগুলোর চাপ উপেক্ষা করে সার, ডিজেল, বিদ্যুত্ ও অন্যান্য উপকরণে ভর্তুকি বৃদ্ধি, দুই দফায় সারের দাম কমানো, পাঁচ লাখ হেক্টর জমি নতুন করে সেচের আওতায় আনা প্রভৃতির ফলে বোরো ও আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনে সরকার অনেক সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়িত করেছে। ফলে এ বছর মঙ্গা বা দুর্ভিক্ষের কথা শোনা যায়নি। প্রণীত হয়েছে সংশোধিত পিআরএসপি।
একটি প্রগতিশীল শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে। বইয়ের গুদামে আগুন লাগানো এবং নানা অন্তর্ঘাত সত্ত্বেও সরকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে বছরের শুরুতেই বিনামূল্যে ১৯ কোটি বই বিতরণের ব্যবস্থা করেছে। এবারই প্রথম প্রায় ২০ লাখ প্রাথমিক শিক্ষার্থী পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে। দেশে নতুন ১৩ হাজারের ওপর কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করা হচ্ছে।
বিদ্যুত্ ও জ্বালানি সমস্যার সমাধান সময়সাপেক্ষ এবং সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ। সরকার এক বছরের বিদ্যুত্ উত্পাদন ৫০০ মেগাওয়াট এবং নতুন কূপ খননের মাধ্যমে ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্পাদন বাড়িয়েছে; যদিও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। তবে বিদ্যুত্, গ্যাস ও কয়লা উত্পাদন বাড়ানোর বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সরকার ইতিমধ্যে সরকারি দপ্তরে কম্পিউটারায়ন, অটোমেশন যেমন শুরু করেছে, তেমনি ই-গভর্নেন্স, ই-কমার্স, ই-হেলথ, ই-ব্যাংকিং প্রভৃতি ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
পরিবেশ বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কোপেনহেগেনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থ ও প্রস্তাব তুলে ধরেছেন। এ ছাড়া সরকারের বহুমুখী উদ্যোগের ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ তার হূত গৌরব ফিরে পেতে শুরু করেছে।
আওয়ামী লীগ সরকার বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত বিচার সম্পন্ন করায় একদিকে জাতি যেমন কলঙ্কমুক্ত হবে, অন্যদিকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত হবে। সর্বশেষ কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ টিআইয়ের বিচারে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের কলঙ্ক থেকে বের হয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে।
বস্তুত সরকারের সাফল্যের পাল্লাই ভারী। আর পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত একটি সরকারের মাত্র এক বছরের কর্মকাণ্ড দিয়ে তার সাফল্য-ব্যর্থতা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। বর্তমান সরকারের মধুচন্দ্রিমা শেষ। আগামী বছরটি হবে আরও চ্যালেঞ্জিং। মানুষ এবার প্রকৃত উন্নয়ন ও তাদের জীবনে দিনবদলের ছোঁয়া দেখতে চাইবে।
নূহ-উল আলম লেনিন: প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

No comments

Powered by Blogger.