এই শ্রদ্ধাঞ্জলি বরং প্রতিবাদ বলেই গণ্য হোক by ফারুক ওয়াসিফ

বড় রাজনীতিবিদ না হলে এ দেশে অনেক কৃতী মানুষের জন্ম বা মৃত্যুতিথি অনেক সময় অগোচরে আসে, আর অগোচরেই চলে যায়। কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকীও তাই নীরবে এল, নীরবেই চলে গেল। গতকাল, অর্থাত্ ১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারি তারিখে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।
তাঁর মৃত্যুর কথা মনে হলে যমুনার কালো ঘোলা জলের কথা মনে আসে। সেবারও জানুয়ারির শুরুতে বেজায় শীত পড়েছিল দেশে। সেই শীতের মধ্যে কফিনে শায়িত লেখকের সঙ্গে আমিও উঠে পড়ি গাড়িতে। গাড়ি মানে অ্যাম্বুলেন্সে। সেটি যাবে বগুড়ায়, লেখকের জন্মস্থানে। তখনো যমুনা সেতু হয়নি, আরিচা দিয়েই ফেরি পারাপার হতো। সন্ধ্যার মুখে ফেরি ছাড়ে। নদীপথে দুই-আড়াই ঘণ্টা লাগে ওপারের নগরবাড়ী ঘাটে পৌঁছাতে।
অন্ধকার হয়ে এলে একসময় উঠি ফেরির একদম ওপরের বসার জায়গাটায়। সেখানে তখন এক প্রান্তে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোট ভাই অধ্যাপক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস একা বসে চরাচরের দিকে তাকিয়ে আছেন। এক পাশে ফেরির রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াই। নদীর ওপরের আবছা দৃশ্যপটে শোক, স্মৃতি আর অচেনা নানান অনুভূতি যেন কুয়াশার মধ্যে রূপ পাওয়ার চেষ্টা করছে। অন্ধকারের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না বলে, কিংবা শোকে মানুষের মাথা সর্বদা নিচু হয়ে আসে বলে আমিও নিচে নদীর বয়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ফেরির আলোর কিছুটা আভা নদীর পানিতে ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে আলোড়ন তুলে বাংলা ভাষার এক প্রতিভাধর লেখকের লাশ বহন করে ফেরিটি চলেছে। অন্ধকারে কালো দেখানো সেই পানির দিকে তাকিয়ে হঠাত্ একটি কথা ঝিলিক দিয়ে উঠল মনে: উত্তরের সন্তান ইলিয়াস সেই খানে ফিরে যাচ্ছেন, যার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে যমুনা-বাঙ্গালী আর করতোয়া নামের তিনটি নদী। যমুনা দিয়ে গেলে বাঙ্গালী নদীতে মেশা যায়, বাঙ্গালী দিয়ে গিয়ে পড়া যায় সেই কাত্লাহারের বিলে—খোয়াবনামা-র জগতে। সেই কাত্লাহারের বিল, যার পাশে বসে পোড়াদহের মেলা, যেখানে একদা আখড়া গেড়েছিল ফকির মজনু শাহ আর ভবানী পাঠকের ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের বেশুমার ঘোড়সওয়ারেরা। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের স্মৃতিবিজড়িত স্লোক আর গাথায় ভরপুর যমুনা তীরের জেলে-মাঝি-চাষাভুষা মানুষের জীবনকে আশ্রয় করেই বেড়ে উঠেছে ইলিয়াসের মহাকাব্যিক উপন্যাস খোয়াবনামা। এই সেই যমুনা, তাঁর চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসের গ্রামীণ চরিত্ররা যার বুক থেকে ঘোড়ার খুরধ্বনি শুনতে পায়। কী অদ্ভুত কাকতাল, সেই যমুনা বেয়ে বেয়েই কবর পেতে ফিরে চলেছেন জন্মের আশ্রয়ে।
সেদিন তাঁর লাশের পাশে বসে মনে হয়েছিল, তাঁর এই ফেরার সঙ্গে সাহিত্যিক হিসেবে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সৃষ্টির লক্ষ্যের একটা সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সুখ-স্বপ্ন-দুঃখ-হতাশা-সংগ্রাম আর আপসে গড়া আটপৌরে জীবনের সম্পর্কটি ধরতে চেয়েছেন তিনি তাঁর উপন্যাস দুটিতে। ক্ষুদ্র, তুচ্ছ মানুষের জীবনের শক্তি ও সৌন্দর্য যে অপার সম্ভাবনা ধরে, তাকে তিনি সাহিত্যের মধ্যে নির্মোহভাবে ফলিয়ে দেখান। তাঁর চিলেকোঠার সেপাই তাই একদিকে ঢাকা শহর, অন্যদিকে উত্তরবঙ্গের যমুনাপারের সমাজে একাত্তরের পূর্বপ্রস্তুতির আভাসগুলো চিনিয়ে দেয়। তাঁর খোয়াবনামা একদিকে তেভাগা আন্দোলন, আর আরেক দিকে পাকিস্তান আন্দোলনের মাঝখানে পড়া গ্রামীণ জীবনস্পন্দনের দাগগুলো কাহিনির আদলে এঁকে দেখায়।
নিম্নবর্গীয় অবহেলিত মানুষের জীবনে প্রেম, আশা, উত্পাদন ও সংগ্রামের লীলা চলে। সেই লীলায় লীলায়িত মানুষ মিথ, বিশ্বাস, উপকথা আর গালগল্পের মধ্য দিয়ে যেকোনো বীরের নয়, নায়কের নয়; আসলে নিজেদেরই কথা বলে। বিদেশি সাহিত্য পড়া চোখে, বহুকাল ইংরেজের শাসনে থাকা আধুনিকতার বোধে, খামাখা বাঙালি বনাম মুসলমানিত্বের বিতর্কের ঘোরে এই সত্য ভুলে যাওয়া হয়েছিল। বাজারি সাহিত্যের উত্পাত এড়িয়ে, নিজেকে নিয়ে মেতে থাকার মধ্যবিত্তসুলভ ভাবালুতার দোষ কাটিয়ে সেই ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রবাহিত ইতিহাসে বাংলাদেশের মূল জীবনধারাটি শনাক্ত করেন। সেই জীবন নিম্নবর্গীয় মানুষের জীবন। খোয়াবনামার তমিজ-ফুলজান আর চিলেকোঠার সেপাই-এর হাড্ডি খিজির-চেংটুরা সেই জীবনধারারই প্রতিনিধি। হীনম্মন্যতায় ভোগার রোগ না থাকলে মানতে হবে, এ দুটি উপন্যাস নিবিড়ভাবে দেশীয়, কিন্তু একই সঙ্গে বিশ্বসাহিত্যের এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
আরেকভাবে দেখলে, স্বপ্নের পাকিস্তান যে অচিরেই মাটির সানকির মতো বাঙালি মুসলিম কৃষকের মাটিতেই গুঁড়িয়ে গেল, তার আখ্যান খোয়াবনামা। আবার চিলেকোঠার সেপাই-এর পুরান ঢাকার হাড্ডি খিজির কিংবা যমুনা পারের লড়াকু চেংটুরা জানিয়ে দেয়, সামনে যে লড়াই আসছে সেখানে নিম্নবর্গের মানুষের মুক্তির আশা ভদ্রলোক মধ্যবিত্তদের জাতীয়তাবাদে পূরণ হওয়ার নয়। দ্বিতীয় স্বপ্নভঙ্গের সেই আখ্যান হয়তো আমরা পেতে পারতাম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর লিখতে চাওয়া উপন্যাসটিতে। দুর্ভাগ্য যে, তার আগেই ক্যানসার এসে তাঁকে থামিয়ে দিল।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্পগুলো কাঁদায় না, চটিয়ে দেয়। মনকে অবশ না করে জাগিয়ে দেয় এবং বিষণ্ন করে। সত্তর ও আশির দশকের বিক্ষুব্ধ সময়জুড়ে তিনি উপন্যাসের দেশে ফেরার নকশা আঁকছেন, প্রবন্ধে খুঁজে দেখছেন সংস্কৃতির সেতুটা যে ভেঙে গেল, তাকে জোড়া লাগাবার কী উপায়? প্রবন্ধগুলো শেখায়, নিছক আর্ট করায় বাহাদুরির কিছু নেই। জনগণের জীবনধারার নিজস্ব গতি-দুর্গতির হিসাব বাদ রেখে যত কেতাবই ঘাঁটা হোক, তা অসার। ডায়রিতে লেখেন, ‘এ রকম ইতর মধ্যবিত্ত বোধহয় দুনিয়ার আর কোনো দেশে নেই, এখানে রাজনীতি মানে প্রতারণা আর হারামিপনা, ন্যূনতম মর্যাদাবোধ থাকলে এখানে রাজনীতি করা অসম্ভব। দেশের মানুষ সম্বন্ধে ভাসা ভাসা ধারণা নিয়ে দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে ঘেউ ঘেউ করা হলো এখানকার বুদ্ধিজীবীদের সার্বক্ষণিক তত্পরতা। বিজ্ঞানে ডিগ্রি পাওয়া মানুষ এখানে ব্যবসা করে ধর্ম নিয়ে। টাকার লোভে, সামাজিক প্রতিষ্ঠার লোভে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পারে না হেন কম্ম নেই। ভালো লাগে না...। দিনে দিনে অসহ্য হয়ে উঠছে এখানকার পরিবেশ...।’ এমন যার মনোভাব, দলে-বলে ভারী হয়ে উপেক্ষা করা যায়। আমাদের বিধ্বস্ত সমাজের ওপর সরের মতো ভাসতে থাকা কর্তাব্যক্তিরা সেই কাজটি করতে মোটেই শরমিন্দা হননি। বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিকের মৃত্যুদিবসে এই শ্রদ্ধাঞ্জলি বরং প্রতিবাদ হিসেবেই গণ্য হোক।

No comments

Powered by Blogger.