এই অস্থিরতার শেষ কোথায়?

ক্যাম্পাস থেকে পাহাড়। অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা সর্বত্র। এটা অবশ্য চলছে দেড় মাস ধরেই। একের পর এক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে। সর্বশেষ সংযোজন পাহাড়। সেখানকার অশান্তির পেছনে বাইরের সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত করেছেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ। বলেছেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বাইরে থেকে ষড়যন্ত্র হচ্ছে।’ এর আগে পোশাকখাতে অস্থিরতা তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে হামলায় বহিরাগতদের যোগ দেয়ার বিষয়টি ছিল স্পষ্ট। তবে একদল পোশাক কারখানা মালিকের ভূমিকাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। কিছু কারখানায় বেতন বকেয়া রাখা হয়েছিল, হচ্ছে। এর আগে সচিবালয়ে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করেছিল আনসার সদস্যরা। পরে সেখানে ছাত্রদের যেতে হয়। পুলিশ এখনো পুরোদমে কাজ করছে না। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, পুলিশের পুরোদমে কাজ শুরু করতে আরও সময় লাগবে। নানা দিক বিবেচনায় সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। প্রশাসনেও একধরনের স্থবিরতা রয়েছে।

এখন সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে পার্বত্য অঞ্চলের বিষয়টি। এরইমধ্যে সেখানে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। যদিও গতকাল পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে এসেছে। পাহাড় বরাবরই স্পর্শকাতর স্থান। এ অঞ্চলে নিরাপত্তা সংকটও দীর্ঘ দিনের। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে কেউ সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছে কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গতকাল স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফের বক্তব্যের পর সে আলোচনা আরও তীব্র হচ্ছে। শনিবার রাঙ্গামাটিতে রাজনৈতিক দল ও আঞ্চলিক দলের নেতাসহ নিরাপত্তা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা বলেন, ‘পাহাড়ি-বাঙালিদের ঘটনাগুলোতে দেশের বাইরের শক্তি ও পতিত স্বৈরাচারের ইন্ধন রয়েছে। আমরা সমপ্রীতি চাই। কিন্তু জানি না কোথায় ছন্দপতন হচ্ছে। ছন্দপতনের বিষয়ে সবাই একটি বাক্য উচ্চারণ করেছে; সেটি হলো ষড়যন্ত্র। বাইরে থেকে একটি ষড়যন্ত্র হচ্ছে, আমাদের এই সমপ্রীতি নষ্ট করার জন্য। এর পেছনের ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করা হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়েও ব্যাপক আলোচনা চলছে। এরইমধ্যে সরকার এবং প্রশাসন কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। কয়েকজন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত ঘটনায় একজন সাবেক ছাত্রলীগ নেতার নাম এসেছে। শেখ হাসিনার পতনের দেড় মাস পরও ক্যাম্পাসগুলো এখনো পুরোমাত্রায় সচল হয়নি। এই পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাসগুলো কী প্রক্রিয়ায় চলবে- তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় প্রাথমিকভাবে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখনো অবশ্য প্রকাশ্যে এ ব্যাপারে কোনো ঘোষণা দেয়া হয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে সর্বত্রই একধরনের অস্থিরতা রয়েছে। যেকোনো বড় গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লবের পর এটা নজিরবিহীন নয়। আর বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার দেড় দশকের বেশি সময় টানা ক্ষমতায় ছিল। দলটির এক শ্রেণির নেতারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। অভিনব পরিস্থিতিতে আত্মগোপনে চলে গেলেও তাদের অর্থ তাদের কাছেই রয়েছে। সে অর্থ দিয়ে তারা নানা রকম অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছেন। শাসনামলের পুরোটা সময়ই আওয়ামী লীগ সরকার পুলিশকে ব্যবহার করে বিরোধীদের আন্দোলন দমন করে। জুলাই আন্দোলনেও পুলিশ চরম শক্তির ব্যবহার করে। এক হাজারের বেশি আন্দোলনকারী এসময় নিহত হন বলে বিভিন্ন রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে। নিহতদের তালিকা অবশ্য এখনো চূড়ান্ত হয়নি। কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় পুলিশের ওপর মানুষের ক্ষোভ তৈরি হয়। ৫ই আগস্ট থানায় থানায় হামলা হয়। এরপর একযোগে সব পুলিশ সদস্য থানা ছেড়ে চলে যান। পৃথিবীর ইতিহাসে যা নজিরবিহীন। গেল দেড় মাসে পুলিশে নানা রদবদল হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত পুলিশকে পুরোদমে কার্যকর করা যায়নি। এ সুযোগও কেউ কেউ নেয়ার চেষ্টা করছেন।  প্রশাসনসহ সর্বত্র কয়েকটি স্তরে বিগত সরকারের সুবিধাভোগী ব্যক্তিরা রয়েছেন। যে কারণে রদবদল করেও খুব বেশি লাভ হচ্ছে না। একজন উপদেষ্টা প্রশ্ন তুলেছেন, শুধু সংস্কার করলেই কি হবে? সংস্কার কার্যকর করবেন কারা? এ ছাড়া, কিছু কিছু ক্ষেত্রে রদবদলের গতিও মন্থর। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের ‘দলীয় অনুগত খতিব’কে এত দিনেও পরিবর্তন না করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গত শুক্রবার সেখানে যে অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘাত হয় তার জন্য এই ধীরে চলা নীতিকে দায়ী করছেন কেউ কেউ।
এরইমধ্যে জুলাই হত্যার বিচার ট্রাইব্যুনালে করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রসিকিউশন টিম গঠন করা হয়েছে। পুনর্গঠন করা হয়েছে তদন্ত সংস্থা। তবে এ বিচার শুরু হলে সরকারকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জেই পড়তে হবে। আওয়ামী লীগের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। সেখানে বেশ কিছু মতামতের আভাস পাওয়া যায়। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রনেতাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান রয়েছে। আওয়ামী লীগের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান অক্টোবরে খোলাসা হতে পারে বলে একটি সূত্র আভাস দিয়েছে।
বাংলাদেশ ঘিরে আন্তর্জাতিক রাজনীতিও সক্রিয় রয়েছে। দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দুনিয়া সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে, শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। তার প্রতি ভারতের নিরঙ্কুশ সমর্থনের বিষয়টি সবারই জানা। এটিও বাংলাদেশের আগামী দিনের যেকোনো হিসাবে থাকবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিস্থিতির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বাড়ছে। তবে আরও অনেক চ্যালেঞ্জ তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.