যেভাবে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করতে চেয়েছিল সিআইএ এবং মোসাদ

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূটিকে ধ্বংস করে দিতে একটি কম্পিউটার ভাইরাস ব্যবহার করেছে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। এ জন্য তারা ছেড়ে দিয়েছিল স্টাক্সনেট নামে একটি মেলওয়্যার। এটি সাধারণ কোনো মেলওয়্যার ছিল না। সাইবার অস্ত্র হিসেবে এটি ছিল অত্যাধুনিক। এ খবর দিয়েছে অনলাইন এনডিটিভি। এতে বলা হয় ২০০৯ সালের জুন মাস। তখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল তেহরানের রাজপথ। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মীর হোসেন মুসাভির বিরুদ্ধে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজয়ী হয়েছেন মাহমুদ আহমাদিনেজাদ। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, নির্বাচনে জালিয়াতি করা হয়েছে। তাদের একজন নেদা আগা-সুলতান নামের একজন নারী। তিনি যোগ দিতে যাচ্ছিলেন প্রতিবাদে। তাই বিক্ষোভের স্থান থেকে কিছুটা দূরে তিনি গাড়ি পার্কিং করছিলেন। গাড়ি থেকে একপর্যায়ে বেরিয়ে আসেন। কারণ এসি কাজ করছিল না। গাড়ি থেকে বের হতেই স্নাইপারদের গুলি এসে বিদ্ধ হয় তার বুকে। তিনি মারা যান। যখন রাজধানী তেহরানে এই ঘটনা ঘটছিল তখন সেখান থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দক্ষিণে নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনায় উদ্ভট সব ঘটনা ঘটছিল। নাতাঞ্জ হলো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। নেদা মারা যাওয়ার ঠিক কয়েকদিন পরে সিআইএ একটি স্থাপনার বিরুদ্ধে সাইবার অপারেশনের অনুমোদন দিয়েছিল বলে খবর পাওয়া যায়। এই অপারেশনে স্টাক্সনেট নামে একটি অত্যাধুনিক মেলওয়্যার প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয় সাইবার জগতে। এই সাইবার অস্ত্র সরাসরি ইরানের হার্ডওয়্যারকে সংক্রমিত করে। কয়েক বছর ধরে এই মেলওয়্যার তৈরি করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল সহযোগিতার ভিত্তিতে এই সাইবার অস্ত্র তৈরি করেছে। এটাকে বলা হয় বিশ্বের প্রথম ডিজিটাল অস্ত্র।

ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামোতে স্টাক্সনেটের উপস্থিতি নতুন ছিল না। কারণ, তাদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর ধরে বিঘ্ন সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে নতুন যে স্টাক্সনেট তৈরি করা হয়েছিল তার উদ্দেশ্য ছিল সুনির্দিষ্টভাবে পারমাণবিক স্থাপনাকে ধ্বংস করে দেয়া। কয়েক বছর আগে স্টাক্সনেটের উন্নয়ন ও উৎপাদন শুরু হয়েছিল। এর কাজ শুরু হয়েছিল ২০০০-এর দশকের শুরুর দিকে। ওই সময় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে পশ্চিমাদের সঙ্গে ইরানের উত্তেজনা ছিল তুঙ্গে। তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে উদ্বিগ্ন ছিল তখনকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রশাসন। তাই তারা এই কর্মসূচির গতি টানতে অপ্রচলিত পদ্ধতির চেষ্টা চালাতে থাকে। তাই ‘অলিম্পিক গেমস’ কোড নামে নতুন একটি ছদ্মবেশী অপারেশনের জন্ম হয়। এই উদ্যোগে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতার ভিত্তিতে জড়িত হয় সিআইএ, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ এনএসএ এবং ইসরাইলের মোসাদ। তাদের উদ্দেশ্য, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সফলতাকে বিঘ্নিত করতে একটি ডিজিটাল অস্ত্র তৈরি করা। আগেই বলা হয়েছে, স্টাক্সনেট কোনো সাধারণ মেলওয়্যার নয়। সাইবার অস্ত্রের ক্ষেত্রে একটি অপ্রত্যাশিত পরিশীলিত ডিজাইন অনুসরণ করা হয় এক্ষেত্রে। সিমেন্স স্টেপ-৭ সফটওয়্যারকে টার্গেট করে এই মেলওয়্যার। কারণ, এই সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয় শিল্প বিষয়ক যন্ত্রপাতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে। বিশেষ করে ইরানের নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনার সেন্ট্রিফিউজকে এক্ষেত্রে টার্গেট করা হয়। ইউরোনিয়াম সমৃদ্ধ করতে এই সেন্ট্রিফিউজ অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। এটি কাজ করে উচ্চগতিতে। ফলে যথাযথভাবে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে যথার্থভাবে কাজ করে এমন সফটওয়্যার দরকার হয়। টিনেসির ওক রিজে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার একটি নমুনা তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্র। ইরান টের পাবে না বা তারা ধরতেও পারবে না- এমন উপায়ে স্যাবোটাজ করে কীভাবে এই কর্মসূচিকে বন্ধ করা যায় সেই চেষ্টা চলতে থাকে। ফলে ২০০৭ সালে স্টাক্সনেটের প্রথম সংস্করণ ছাড়া হয়। টার্গেট করা হয় সেন্ট্রিফিউজকে। ভাল্বের ভেতর দিয়ে যে চাপ প্রকাশ পায় তা বন্ধ করে এই আক্রমণ চালানোর চেষ্টা হয়। তাতে ইউরেনিয়াম গ্যাস কঠিন আকার ধারণ করবে। সেন্ট্রিফিউজগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে এবং এর ফলে নিজে থেকেই ওই স্থাপনা ধ্বংস হয়ে যাবে। এয়ার-গ্যাপ ব্যবহার করা হয়েছিল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে। এর অর্থ হলো ওই স্থাপনার নেটওয়ার্ক ছিল বন্ধ। এ জন্য স্টাক্সনেটকে ইউএসবি ড্রাইভ ব্যবহার করে একটি এজেন্টের মাধ্যমে প্রবেশ করানোর চেষ্টা হয়। এই মেলওয়্যার একবার প্রবেশ করিয়ে দিলে তা নিজে থেকেই কাজ করতে থাকে। কিন্তু তাকে কেউ শনাক্ত করতে পারবে না। তবে কার্যকারিতা সত্ত্বেও প্রথমদিকে স্টাক্সনেট শুধু ইরানের কর্মসূচিকে ধীরগতির করতে সক্ষম হয়। তারা পুরোপুরি স্যাবোটাজ করতে পারেনি। জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকরা আরও আগ্রাসী একটি সংস্করণের স্টাক্সনেট তৈরি করেন। এটি দ্রুততার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সিস্টেম থেকে তথ্য চুরি করতে পারে। এয়ার-গ্যাপ থাকার পরও কাজ করতে পারে। সেন্ট্রিফিউজগুলোকে নতুন করে প্রোগ্রামিং করে তাকে ধ্বংস করে দিতে পারে।

নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনার কোনো এক ব্যক্তির মাধ্যমে স্টাক্সনেট নামের নতুন সংস্করণের প্রবেশ ঘটানো হয়। দ্রুততার সঙ্গে তা সেখানকার নেটওয়ার্কে ছড়িয়ে পড়ে। এর আগ্রাসী তৎপরতা অনিচ্ছাকৃত পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। এক পর্যায়ে তা নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনার বাইরেও পুরো ইরানে এমনকি বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। স্টাক্সনেট অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়িয়ে পড়ছে এটা বুঝতে পেরে সিআইএ সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা তাদের এই অপারেশন অব্যাহত রাখবে, যাতে নাতাঞ্জে তা গোপন অবস্থায় থাকে। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান সিম্যানটেক শনাক্ত করে ফেলে স্টাক্সনেটকে। এই মেলওয়্যার নিয়ে তারা বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র আশাহত হয়। কারণ, ইরানও দ্রুত বুঝতে পারে এই সাইবার হামলার কথা। পারমাণবিক কর্মসূচিকে সুরক্ষিত রাখতে তারা পদক্ষেপ নেয়। স্টাক্সনেটের আক্রমণের ফলে যে ক্ষতি হয়েছে তা সত্ত্বেও পারমাণবিক কর্মসূচি অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দেয় ইরান।

স্টাক্সনেট যে ছিল তা প্রথম প্রকাশ্যে আসে ২০১০ সালের জুনে। ওই সময় ইরানের একটি কম্পিউটারে মেলওয়্যারের একটি অস্বাভাবিক ভাইরাস শনাক্ত করে বেলারুশের সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক একটি প্রতিষ্ঠান। সেখানে পাওয়া কোড নিয়ে গবেষণা শুরু করে দেন সারা বিশ্বের সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা। এর জটিলতা এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে পেরে তারা বিস্মিত হন।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে স্টাক্সনেটের ক্ষতিকর প্রভাব ছিল উল্লেখ করার মতো। তবে তা তাৎক্ষণিক বিপর্যয়ের মতো নয়। ২০০৯ সালের মধ্যে নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনায় ইরান প্রতিষ্ঠা করেছিল কমপক্ষে ৭০০০ সেন্ট্রিফিউজ। তবে তার মধ্যে শুধু এক হাজার সেন্ট্রিফিউজকে আক্রান্ত করতে সক্ষম হয় স্টাক্সনেট। এর ফলে ইরান তাৎক্ষণিকভাবে অস্থায়ীভিত্তিতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কাজ স্থগিত করে। ক্ষতিগ্রস্ত সরঞ্জাম সরিয়ে ফেলে। পারমাণবিক কর্মসূচি কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত বিলম্ব করে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.