স্টেডিয়ামের দোকান ভাড়া দুর্নীতিতে রাজস্ব বঞ্চিত সরকার

সবকিছুর দাম বাড়ে, বাড়ে না শুধু জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) আওতাধীন দেশের বিভিন্ন স্টেডিয়ামের দোকান ভাড়া। বিস্ময়করভাবে দোকান ভাড়া একবার কমানোও হয়েছিল। গত ৩২ বছরে প্রতি বর্গফুট দোকান ভাড়া বেড়েছে মাত্র ১১-১২ টাকা। দেশের বিভিন্ন ক্রীড়া স্থাপনায় থাকা ১ হাজার ৭৪টি দোকান ও স্থাপনা থেকে এনএসসি ভাড়া নিচ্ছে প্রতি বর্গফুট সর্বোচ্চ ২৬ টাকা ৭০ পয়সা। বর্তমান বাজারমূল্যের তুলনায় এই ভাড়া প্রায় ২০ গুণ কম হওয়ায় দোকান ভাড়া থেকে বাস্তবসম্মত রাজস্ব আয় করতে পারছে না এনএসসি।

বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ২৯৬টি দোকান বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ দেয়া আছে। গত ১২ই সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সরজমিন স্টেডিয়াম পরিদর্শনে গিয়ে দোকান ভাড়ার হার ও এনএসসি’র রাজস্ব আয়ের এই অসামঞ্জস্য খুঁজে পান। পরে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেয়া এক পোস্টে তিনি লিখেন, ‘মনে হচ্ছে, আমাকে কেউ দুর্নীতির মহাসাগরে ছেড়ে দিয়েছে।’ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সারা দেশের ১০৭৪টি দোকান ও স্থাপনা থেকে ভাড়া বাবদ এনএসসি আয় করেছে ৭ কোটি ৩০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। বাস্তব বাজারমূল্যে ভাড়া পেলে যেটা হতে পারতো আরও কয়েক গুণ বেশি। এনএসসি’র আয়ের প্রধান উৎসই যেখানে দোকান ভাড়া, সেখানে একশ্রেণির বরাদ্দপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বিশেষ সুবিধা দিতে তারা নিজেরাই আয়ের পথ বন্ধ করে রেখেছে। বিনিময়ে পকেট ভারী করছে নিজেদেরও। স্টেডিয়ামের দোকান বরাদ্দ দেয়ার দায়িত্ব এনএসসি’র পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের। তিন বছর পরপর কমিটি গঠন করে ভাড়া পুনর্মূল্যায়ন করার নিয়ম। এই কমিটি যাচাই-বাছাই করে নতুন ভাড়ার হার অনুমোদনের জন্য এনএসসি’র চেয়ারম্যান যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রীর কাছে পাঠায়। জানা গেছে, অনেক সময় এনএসসি চেয়ারম্যান বর্ধিত ভাড়ার অনুমোদন দিলেও দোকান মালিক সমিতির চাপে পড়ে তা আর করা যায়নি। তবে সেই বর্ধিত ভাড়ার প্রস্তাবও কখনো বাস্তব বাজারমূল্যে হয়নি। বিস্ময়করভাবে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম কমপ্লেক্সের দোকান ভাড়া কমানো হয়েছিল। বিষয়টি জানিয়ে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সাবেক পরিচালক উইং কমান্ডার (অব.) মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘১৯৯৪ সালে আমি পরিচালক থাকাকালে প্রতি স্কয়ার ফিটে এনএসসি ভাড়া বাবদ পেতো ২ টাকা ৪ আনা। ওই সময়ের বাজারব্যবস্থা অনুযায়ী ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছিল। কিন্তু ওবায়দুল কাদের ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে এসে সে ভাড়া প্রায় অর্ধেক করে দিয়েছিলেন। সাদেক হোসেন খোকা ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালে প্রতি স্কয়ার ফিটের ভাড়া ৩০ টাকা করা হয়েছিল। এভাবে বিগত সরকারগুলোর আমলে মনগড়াভাবে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। যে কারণে রাষ্ট্র রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে।’ এনএসসি’র কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের জন্য বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম কমপ্লেক্সের মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামের একটি দোকান বরাদ্দ করা হয়; ওই দোকান থেকে ভাড়া বাবদ প্রাপ্ত অর্থ তহবিলে যুক্ত হয়। কিন্তু স্টেডিয়ামের দোকানমালিক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দাবি, এনএসসি’র কাছে ভাড়ার অর্থ যায় না; এমন দোকান সংখ্যা তিনটি! স্টেডিয়ামের পাশেই তিন তলাবিশিষ্ট সুইমিংপুল কমপ্লেক্স এবং বাংলাদেশ ভলিবল ও কাবাডি স্টেডিয়ামে দোকান বরাদ্দ নিয়েও নয়/ছয় হয়েছে বলে জানালেন- এনএসসি’র অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘স্টেডিয়াম এবং বিভিন্ন ক্রীড়া স্থাপনায় দোকান নির্মাণের পর সব সরকারের আমলেই এখান থেকে সুবিধা নিয়েছে মন্ত্রণালয় এবং এনএসসি’র কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের কর্মচারীও। এ সংক্রান্ত যে চুক্তি করা হয়েছে, সেগুলো গোলামি চুক্তি।’ ওই কর্মকর্তা দাবি করেন, বিভিন্ন ক্রীড়া স্থাপনার দোকানগুলোর ভাড়া সঠিকভাবে আদায় করা হলে দেশের ক্রীড়া কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সরকারের কাছ থেকে কোনো অর্থ নেয়ার প্রয়োজন নেই। বরং এখান থেকে ভিন্ন খাতে অর্থ নেয়া যাবে বলে জানান- অবসরপ্রাপ্ত ওই কর্মকর্তা। এজন্য দ্রুতই অসামঞ্জস্য দূর করতে বর্তমান বাজারমূল্য মাথায় রেখে নতুন করে চুক্তির বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.