আর কোনো আয়নাঘর থাকবে না, কলঙ্কমুক্ত করতে চাই -মানবজমিনকে ডিএমপি’র ডিবি প্রধান by শুভ্র দেব

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) অফিসে আর কোনো আয়নাঘর থাকবে না। ডিবি’র কলঙ্কিত অধ্যায় শেষ করে সেটিকে পবিত্র করা হবে। যেখানে মানুষ ন্যায়বিচার পাবে। ভুক্তভোগীদের ভরসাস্থল হবে। ডিবি অফিসের নাম শুনলে আর কেউ আতঙ্কিত হবে না। এখানে কোনো নায়িকা-অভিনেত্রী বা সেলিব্রেটিদের সময় কাটানোর জায়গা হবে না। থাকবে না কোনো ভাতের হোটেল। আসামি যে পক্ষেরই হোক না কেন সেও ন্যায়বিচার পাবে। গ্রেপ্তার আসামিদেরও নির্যাতন করা হবে না। ৫ই আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তা রেজাউল করিম মল্লিক। ২০০৬ সালের পর তাকে আর বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ কোথাও দেখা যায়নি। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের অগুরুত্বপূর্ণ পদে তার পদায়ন হয়েছে। বিভিন্ন সময় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গতকাল মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি তার নির্যাতিত  কর্মজীবনের বর্ণনা তুলে ধরেছেন। বলেছেন, ডিবির কার্যক্রম নিয়ে তার পরিকল্পনা।

রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, ২০০৬ সালের পর থেকে আমার উপর যে নির্যাতন, অবিচার, অন্যায়, অবহেলা ও অপমান করা হয়েছে সেটি বলে বুঝানো যাবে না। কেন আমার প্রতি এত নির্যাতন অবিচার করা হয়েছে সেটি আমি নিজেও জানি না। আমাকে তারা এতটাই কষ্ট দিয়েছে আমার বাবা, মা ও বড় ভাইয়ের মৃত্যুর সময় আসতে দেয়নি। এ ছাড়া গ্রামের বাড়িতে তাদের কবর পর্যন্ত গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আমাকে কোনো ছুটি দিতো না। ঢাকায় আসতে দিতো না। পিবিআইয়ের সিলেট বিভাগের দায়িত্বে থাকাকালীন সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ছিল। তখন আমি বিএনপি প্রার্থী আরিফুল হকের পক্ষে কাজ করবো এই ভেবে আমাকে রাতারাতি রংপুরে বদলি করে দেয়া হয়। সিআইডিতে থাকাকালীন অফিসে টানানো বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ছবির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে হেড অফিসে পাঠাতে হতো। দীর্ঘ ১৮ বছর এসব সহ্য করার পর আমরা একটি মুক্ত স্বাধীন দেশ পেয়েছি।

পুরো বাহিনীতে আমার মতো নির্যাতিত অফিসার আছে কিনা আমি জানি না। ১৮ বছর আমাকে ঢাকায় ঢুকতে দেয়া হয়নি। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্থানে পদায়ন করা হয়েছে। শুধু পদায়ন করে শেষ হয়নি। আমাকে নির্যাতন, অত্যাচার, অবহেলা ও অপমান করা হতো। অনেকভাবে নাজেহাল ও লাঞ্ছিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, বহু বছর পর আমার ঢাকাতে পোস্টিং হয়েছে এবং ডিবিতে পদায়ন করা হয়েছে। এত বছর ডিবিতে আসার সুযোগ হয়নি। তবে বিভিন্ন মাধ্যমে দেখেছি ও জেনেছি ডিবির ভয়াবহ চিত্র। ২০০৪ সালে আমিও ডিবিতে চাকরি করেছি। আমরা যে চিত্র রেখে গিয়েছিলাম সেটি এখন পাইনি। পুরোপুরি পরিবর্তন হয়েছে। সবার সহযোগিতায় আমি ডিবির কলঙ্কিত পরিবেশকে পবিত্র একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চাই।

কেন কলঙ্কিত বলছেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা বলছি কারণ অনেকেই দেখেছে ওই সময় ডিবিতে অনেক রকম খারাপ কাজ হতো। আমি খারাপ কাজটাকে প্রশ্রয় দিবো না। এখানে কোনো রকম অন্যায়, অবিচার ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিবো না। ডিবির কর্ম পরিকল্পনা নিয়ে তিনি বলেন, সবেমাত্র যোগদান করেছি। কর্মকর্তারা আসছেন। সবাই চৌকস, দক্ষ। তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে ডিবিকে পুনর্গঠন করে ডিবির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে যা যা করণীয় সেভাবে করার চেষ্টা করছি। পুরাতন মামলার ভবিষ্যত কী হবে? যোগদান করার পরে যে সমস্ত আলোচিত মামলা রয়েছে সেসব নিয়ে কনসার্ন ডিসি ও তদন্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসে সঠিক বিচারের ব্যবস্থা করার জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ নিচ্ছি।

ভিআইপি অনেক আসামি আপনার হেফাজতে আছে তাদেরকে কীভাবে হ্যান্ডেল করছেন এবং তাদের কাছে কী জানতে চাচ্ছেন? জবাবে রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বিভিন্ন ধরনের টিম করে দেয়া হয়েছে। তারা এসে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। অনেক তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে। ওইসব তথ্যের আলোকে তদন্তকারী কর্মকর্তা মামলা পরিচালনা করবেন। আমরা শুধু হত্যা মামলা নিয়েই জিজ্ঞাসাবাদ করছি না। বরং দীর্ঘ সময় তারা যে দুর্নীতি অবিচারসহ অনেক রকম খারাপ কাজে লিপ্ত ছিল। সব বিষয়েই আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করছি।

ডিবি অফিসে প্রায়ই নায়ক-নায়িকা, মডেল, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা আসা-যাওয়া করতেন-আপনার আমলে কী তাই হবে? জবাবে তিনি বলেন, এই ধরনের কিছু  হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ডিবিকে মানুষের আস্থা ও ভালোবাসার স্থান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। এখানে কোনো রকম অন্যায় অবিচার, নায়ক-নায়িকা, কোনো সেলিব্রিটি এসে সময় কাটানোর জায়গা হবে না। আমি যতদিন দায়িত্ব পালন করবো ন্যায়নীতি ও সততার মধ্যে দিয়ে দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করবো। যারা ভুক্তভোগী এবং অসহায় তাদের কথা শুনবো। তাদেরকে কী রকম আইনগত সহযোগিতা দেয়া যায় সেটি  দেখবো।

একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসাবে ডিবির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদের কর্মকাণ্ড নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছি হারুনের আমলে অনেক অপকর্ম হয়েছে। তার সঙ্গে আমি কখনো চাকরিও করিনি, দেখাও হয়নি। আমি চেষ্টা করবো আমার মতো করে সুন্দর পরিবেশে, আইন মোতাবেক, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কাজ করে যাবো।
ডিবিতে আয়না ঘর ছিল, জনমনে এ নিয়ে একটা কৌতুহলও ছিল। ৫ই আগস্টের পর মানুষ সেটা দেখতেও এসেছিল। আপনার সময়ে কী সেরকম কিছু থাকবে? তিনি বলেন, এখানে কোনো আয়নাঘর, বাতিঘর কিছুই থাকবে না। আমি জনগণের সেবা করার জন্য এসেছি। আমাকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সেটিই করবো। এখানে আয়নাঘরের মতো কোনো ঘর নাই। যারা এখানে কর্মরত আছেন তারা সবাই সচেতন। আয়নাঘর বা অন্য কিছু এখানে খুঁজেও পাবেন না। আমরা স্বাভাবিক কার্যক্রম করছি।

ডিবির নাম শুনলে আগে একটা আতঙ্ক বা ভীতি বিরাজ করতো জনমনে, আপনি কী পারবেন সেটি দূর করতে? জবাবে রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, আমি ডিবিকে নির্যাতন কেন্দ্র নয় সেবাকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলতে চাই। ডিবি থাকবে মানুষের আশা ভরসার স্থল। এখানে আতঙ্কের কিছু নাই। আমি সেটাকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে যাবো যাতে মানুষের সেবা করতে পারি। সেবাটাই হচ্ছে আমাদের মূল লক্ষ্য।

বিএনপিসহ বিরোধী ঘরানার রাজনীতির সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তাদেরকে তুলে এনে ব্যাপক নির্যাতন মারধর করা হতো- আপনিও কী ওই পথেই হাটবেন? জবাবে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার বলেন- আমরা স্বাভাবিক যে জিজ্ঞাসাবাদ সেটিই করছি। অন্য কোনোকিছুই এখানে করা হয় না। যথাযথভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রাজনৈতিকভাবে তারা সম্মানীয়। আমরাও তাদেরকে সম্মান দিয়ে যাচ্ছি।
হারুনের ভাতের হোটেল আলোচিত ছিল, আপনি সেটাকে কীভাবে দেখেছেন?  আবার চালু হওয়ার সম্ভাবনা দেখেন কিনা? এ বিষয়ে রেজাউল করিম বলেন, প্রশ্ন-ই উঠে না। এখানে ভাতের হোটেল, চায়ের হোটেল, কফির হোটেল, চাইনিজ হোটেল কিছুই থাকবে না। আশ্বস্ত করে বলতে পারি সরকার আমাকে যতদিন রাখবেন ততদিন সার্বিকভাবে যে সকল কাজ হওয়ার কথা আমি সেভাবেই করে যাবো। সাধারণ মানুষ যেন সুবিচার পায়, অন্যায় জুলুম থেকে বাঁচতে পারে সেটি নিশ্চিত করা হবে। এমনকি আমিও আইনের ঊর্ধ্বে না। কোনো কর্মকর্তা যদি আইন লঙ্ঘন করে, তারা যদি কোনো দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবো। হারুনের ভাতের হোটেলের ভিডিও প্রচার নিয়ে বলেন, একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসাবে এটা তার কাজ ছিল না। চাকরি জীবনে আমরা কখনো দেখিনি, কখনো করিনি। এ রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হইনি। এটা আমার কাছেও ভালো লাগেনি। কখনো করা উচিত না।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন নিয়ে তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের জন্য স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়েছে। এজন্য আমি ছাত্র আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছে তাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। পাশাাশি যারা এখনো চিকিৎসাধীন আছেন তাদের সুস্থতা কামনা করছি। অনেকের মায়ের কোল খালি হয়েছে, স্বামীহারা হয়েছেন তাদের কষ্টের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসাবে আমরা যাকে পেয়েছি তিনি সারা বিশ্বের গর্ব। ওনার নেতৃত্বে দেশকে সুন্দর ও স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এনে সারা বিশ্বে বাংলাদেশ মর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিতি পাবে। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসাবে যিনি রয়েছেন তিনি অত্যন্ত সজ্জন, সৎ ব্যক্তি। তিনি যেরকম নির্দেশনা দিবেন সেভাবে কাজ করবো। ওনার নেতৃত্বে অল্পদিনেই আমরা ঢাকা মহানগরে সৃশৃঙ্খল পরিবেশ নিয়ে আসছি। পুলিশের সকল কর্মকাণ্ডে গতি ফিরেছে।

mzamin


No comments

Powered by Blogger.