সবুজ বন সমৃদ্ধ নগর by ড. মোহাম্মদ কামাল হোসাইন

জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রতি বছর পৃথিবীর ২১ মার্চ আন্তর্জাতিক বন দিবস পালন করা হয়। এ দিবসের মূল তাৎপর্য হলো- পৃথিবীব্যাপী মানুষের মাঝে বনের সংরক্ষণ, উৎপাদন ও বনের মাঝে বিনোদন সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বিভিন্নভাবে দিবসটি পালন করে আসছে। বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব বন দিবস উদযাপন করে। আমরা আশা করি, এ দিবসটির তাৎপর্য বন ও বনের ওপর নির্ভরশীল বিরাট জনগোষ্ঠীর মাঝে নতুনভাবে সচেতনতা সৃষ্টি করবে। এ বছর 'সবুজ বন সমৃদ্ধ নগর' প্রতিপাদ্য নিয়ে আজ পৃথিবীব্যাপী আন্তর্জাতিক বন দিবস পালিত হচ্ছে। সাধারণভাবে আমরা বলে থাকি, একটি দেশের ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ বজায়কল্পে দেশের আয়তনের ২৫ ভাগ এলাকায় বন থাকা উচিত। পৃথিবীর স্থলভাগের তিন ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ প্রায় চার বিলিয়ন হেক্টর এলাকায় বন আছে। অন্যদিকে বন উজাড়ও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। অর্থাৎ প্রতিদিন পৃথিবীতে বন উজাড় হচ্ছে ৩৫,৬০০ হেক্টর, যা বছরে দাঁড়ায় ১৩ মিলিয়ন হেক্টর। বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী মাথাপিছু বনভূমির পরিমাণ ০.৬ হেক্টর, যা ১৯৬০ সালের তুলনায় মাত্র অর্ধেক বনভূমি। অবশ্য বাংলাদেশে মাথাপিছু এ বনভূমির পরিমাণ মাত্র ০.০১৭ হেক্টর। বন বিভিন্নভাবে আমাদের জীবনে অসীম অবদান রাখে। পৃথিবীপৃষ্ঠে বনরাজি আছে বলেই পৃথিবী নামক গ্রহটা জীবজগৎ ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। এ ছাড়া সুস্বাধু খাবার পানি ধারণ, শোধন ও জমাকরণ, বায়ুমণ্ডলের পরিবেশ উন্নয়ন, কাঠ-পাল্পসহ বিভিন্ন কারখানার কাঁচামাল সরবরাহ, ঔষধি উদ্ভিদসহ ঔষধ শিল্পে কাঁচামাল সরবরাহ, কার্বন ডাই-অক্সাইড শোধনপূর্বক অক্সিজেন সরবরাহ ছাড়াও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যমান বনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
উষ্ণমণ্ডলীয় বনাঞ্চলে পৃথিবীর ৭০ শতাংশের বেশি জীববৈচিত্র্য বিরাজমান। পৃথিবীতে প্রায় ১৬০ কোটি মানুষ তাদের জীবন-জীবিকায় কোনো না কোনোভাবে বনের ওপর নির্ভরশীল। এ ছাড়া ৬০ মিলিয়ন আদিবাসী সম্পূর্ণরূপে জীবন-জীবিকা নির্বাহে বনের ওপর নির্ভরশীল। আরও ২৫০ মিলিয়ন উপজাতি বন এলাকায় জুম চাষের মাধ্যমে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। বন ও বনজসম্পদ পৃথিবীর প্রায় মানুষের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। অনেকের জীবন-জীবিকার উৎস, সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপনের জন্য নির্মল পরিবেশ, বন্য পশুপাখির নিরাপদ আবাসস্থল তৈরিসহ সাম্প্রতিক সময়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলার জন্য বন ও বনভূমির অবদান অপরিসীম। বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল একটি দেশ। দেশের আয়তন ১৪.৭৫৭ মিলিয়ন হেক্টর। দেশটির আবহাওয়া উষ্ণমণ্ডলীয় এবং বর্ষা ও শুকনো মৌসুম পৃথকভাবে বিরাজ করে। আয়তনের দিক দিয়ে বাংলাদেশ ছোট হলেও ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ একসময় জীববৈচিত্র্যে প্রাচুর্যময় ছিল। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ৫৭০০ সপুষ্পক উদ্ভিদ বিদ্যমান ছিল। কিন্তু দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, পরিবেশ বিপর্যয়কারী উন্নয়ন কার্যক্রম, বন উজাড়, প্রাকৃতিক সম্পদের অধিক আহরণ, আবাসস্থল ধ্বংস, আগ্রাসী প্রজাতির আগমন, বনায়নে দেশি প্রজাতি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের প্রতি কম গুরুত্ব দেওয়া প্রভৃতি আমাদের দেশের বনজসম্পদ হ্রাসে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। সরকারি হিসাবমতে, বাংলাদেশের মোট ভূমির ১৭.৫ শতাংশ (অর্থাৎ ২.৫৩ মিলিয়ন হেক্টর) বনভূমি হিসেবে চিহ্নিত থাকলেও আসলে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ ৮.০ শতাংশের বেশি নয়। দেশে মোট বনভূমির পরিমাণ ২.৫৩ মিলিয়ন হেক্টর এবং জনগণের মাথাপিছু বনভূমির পরিমাণ ০.০১৭ হেক্টর, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। দেশে বন বিভাগ নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ ১.৫৩ মিলিয়ন হেক্টর হলে ও অশ্রেণিভুক্ত রাষ্ট্রীয় বনাঞ্চল এবং গ্রামীণ বনের আয়তন যথাক্রমে ০.৭৩ মিলিয়ন হেক্টর ও ০.২৭ মিলিয়ন হেক্টর।
বিস্তৃতি, প্রতিবেশ ও অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশের বনাঞ্চলকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। পাহাড়ি বন, শালবন ও উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বন (সুন্দরবন)। পাহাড়ি বন দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে; শালবন দেশের মধ্যাঞ্চলে এবং সুন্দরবন দেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত। প্রাকৃতিক বন ছাড়াও সারাদেশে বসতবাড়ির আশপাশে, নদীর পাড়ে, খালের ধারেও বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা বিদ্যমান। আমরা এই বৃক্ষ আচ্ছাদিত বনকে গ্রামীণ বন বা বসতভিটা সংলগ্ন বন বলে থাকি। দেশে গ্রামীণ বনের পরিমাণ প্রায় ০.২৭ মিলিয়ন হেক্টর। তুলনামূলকভাবে গ্রামীণ বনের পরিমাণ কম হলেও দেশের মোট সরবরাহকৃত চেরাই কাঠের ৭০ শতাংশ এবং জ্বালানি কাঠ ও বাঁশের ৯০ শতাংশ গ্রামীণ বন থেকে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত বিষয় জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশসহ কিছু নিম্নাঞ্চলের সম্ভাব্য বিপর্যয় সংক্রান্ত বেশ কিছু আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে বনায়ন ও অবশিষ্ট বনাঞ্চল সংরক্ষণে বন বিভাগ কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বন আইন সংশোধন করা হয়েছে। স্থানীয় দরিদ্র জনগণের অংশগ্রহণকল্পে বন বিভাগ সামাজিক বনায়ন এবং সংরক্ষিত বনে সহ-ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে পতিত, প্রান্তিক ও ধ্বংসপ্রাপ্ত বনভূমিতে বনজসম্পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। পৃথিবীর স্থলভাগের মাত্র ২ শতাংশ এলাকায় সব শহর ও নগর অবস্থিত হলে ও নগরবাসীরা পৃথিবীর সব প্রাকৃতিক সম্পদের ৭৫ শতাংশই ব্যবহার করে থাকে। বর্তমানে পৃথিবীর জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ লোকই নগরে বসবাস করে এবং যে হারে নগরায়ন বর্ধিত হচ্ছে তাতে ধারণা করা হয়, আগামী ২০৫০ সালের মধ্যেই পৃথিবীর ৭০ শতাংশ জনসংখ্যা শহর ও নগরে বসবাস করবে। এই বিপুল জনসংখ্যার সুস্থভাবে বসবাসের জন্য পরিকল্পিত নগরায়নে টেকসই উন্নয়ন অপরিহার্য। দ্রুত কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে আমাদের শহুরে জীবনযাত্রায় ইতিমধ্যেই ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও সবুজের আবরণ সৃষ্টির লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই অনেক দেশে নগর বনায়ন বিষয়টি সমাজের অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আমাদের শহরের রাস্তার পাশে, গোল চক্কর, পতিত জমি, স্কুল, কলেজ বা অন্যান্য অফিসের খালি জায়গাসহ খালপাড়, জলাভূমিতে নগর বনায়নের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। এসব বনায়নে সরাসরি আমাদের খাদ্য, কাঠ, জ্বালানি সরবরাহ ছাড়া ও পরিস্কার পানি, জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধি, মাটির ক্ষয় রোধ, ছায়া প্রদান, শব্দ ও বায়ুদূষণ কমানোসহ নগরবাসীর মানসিক ও চিত্তবিনোদনে অপরিসীম ভূমিকা রাখে। পরিকল্পিত পার্ক গড়ে তোলা হলে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম, সামাজিক যোগাযোগের সরাসরি মিলনস্থানসহ ছেলেমেয়ে ও প্রবীণদের খেলাধুলা ও হাঁটাহাঁটির তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হবে এই পার্ক। আমাদের কোলাহলময় শহরজীবনে গাছপালা, বায়ু ও শব্দদূষণ তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমাতে সক্ষম।
আমরা বর্তমানে পরিকল্পিত নগর বাদ দিয়ে সুরম্য অট্টালিকা, দোকান, মার্কেটসহ রাস্তা-ফুটপাত দখলে ব্যস্ত আছি। তবে নগর বনায়নের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অর্থ এবং যথাযথ জায়গা পাওয়া। এই বিপুল জনসংখ্যার সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য অবশ্যই সবুজ নগরীর বিকল্প কিছু নেই আমাদের। এ ছাড়াও বাড়িঘরের ছাদে ছাদ বাগান, বিল্ডিংয়ের লন, সিঁড়ি, গ্যারেজ ও সম্ভাব্য খালি জায়গার প্রাপ্যতার আলোকে প্রজাতি নির্বাচন করা হলে সবুজের ছোঁয়া আমাদের হাতে চলে আসবে। এই সবুজায়নে যেসব বাধা বিবেচনায় রাখতে হবে- ১. সবুজায়নের জন্য সীমিত জায়গা; ২. গাছপালা জীবিত থাকা ও বৃদ্ধির জন্য অনেকাংশে প্রতিকূল আবহাওয়া ও স্থান; ৩. যথাযথ প্রজাতি নির্বাচনের সীমাবদ্ধতা ও উন্নত চারার অভাব; ৪. গাছপালা লাগানো ও পরিচর্যা বিষয়ে অনেকের অনাগ্রহ ও জ্ঞানের অভাব ও ৫. সঠিক পরিচর্যার অভাব ইত্যাদি। সবচেয়ে বড় কথা, এখনও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পতিত ভূমিসহ বন বিভাগের ন্যাড়া এলাকাগুলো বনায়নে নিয়ে আসা হলে দেশের বনজসম্পদ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে। শহর ও শহরতলির প্রতিটি খালি জায়গায় স্থান উপযোগী উদ্ভিদ প্রজাতি নির্বাচন করে লাগানো হলে আমাদের রাষ্ট্র এই নগরজীবনকে অনেক বেশি আরাম, আনন্দদায়ক ও স্বাস্থ্যসম্মত করে গড়ে তুলবে বলে আমাদের বিশ্বাস। একটি বড় ছায়া প্রদানকারী গাছ তাপমাত্রা ৩-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমাতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের অভিমত। এ ছাড়াও গাছপালা শহরের পরিবেশ দূষণ কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। আজ আন্তর্জাতিক বন দিবসে সে প্রত্যাশাই ব্যক্ত করি।
অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম

No comments

Powered by Blogger.