মানসম্মত শিক্ষা by প্রফেসর মো: আবু নসর

যে শিক্ষা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বোধসম্পন্ন জ্ঞানের বিকাশ ঘটায় এবং যার মাধ্যমে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নৈতিক মূল্যবোধের প্রসারলাভ করে সেটাই হলো মানসম্মত শিক্ষা। অন্য কথায়, যে শিক্ষা শিক্ষার্থীদের আবেগিক, বুদ্ধিমত্তা ও সৃজনশীলতার চর্চায় দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে সম্ভাব্য ও যোগ্য করে তোলে, সেই শিক্ষাই হলো মানসম্মত শিক্ষা। যে শিক্ষা মনুষ্যত্ব বিকাশে গতিশীলতা আনে, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করে নতুন প্রজন্মকে জাগ্রত করে সেই শিক্ষাই মানসম্মত শিক্ষা। যে শিক্ষায় সুষ্ঠু প্রক্রিয়া ও অভিজ্ঞতার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় এবং অনুসন্ধানমূলক ও অনুশীলমূলক জনঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করে নিজের জ্ঞান, দৃষ্টিভঙ্গি ও দক্ষতার বিকাশ ঘটায়, সেই শিক্ষাই মানসম্মত শিক্ষা। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে সুষ্ঠু পরিবেশে দক্ষ শিক্ষক দ্বারা শিক্ষার্থীদের উপযোগী, হৃদয়গ্রাহী ও গ্রহণযোগ্য শিক্ষাদান নিশ্চিত করা হয়, যা শিক্ষণকে আরো সহজ করত : বৈষম্য দূরীকরণে সাহায্য করে, পরিবর্তন, দক্ষতা ও জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করে এবং যে শিক্ষায় জাতীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে সেটাই হলো মানসম্মত শিক্ষা। যেকোনো জাতির উন্নতি ও অগ্রগতির মূলমন্ত্র হলো শিক্ষা অর্থাৎ সুশিক্ষা। সুশিক্ষা দ্বারাই একটি জাতি সাফল্যের মণিকোঠায় পৌঁছাতে পারে। বাংলাদেশে শিক্ষার মানের পরিবর্তন না ঘটায় সাফল্য পরিলক্ষিত হচ্ছে না। শিক্ষা খাতে অদক্ষতা ও অপচয় পরিলক্ষিত হওয়ায় শিক্ষার কাক্সিক্ষত মান অর্জনে আমরা পিছিয়ে পড়েছি।
শিক্ষার্থী ও পরীক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিমাণগত মানের উন্নতি হলেও গুণগতমানের উন্নতি হয়নি। পরিমাণগত শিক্ষার পাশাপাশি গুণগত শিক্ষাতেও শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করা উচিত। তাহলে বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে পারবে। কোনো ক্ষমতায়নের ঊর্ধ্বে থেকে স্কুল-কলেজগুলোকে তার নিজস্ব গতিতে স্বাধীনভাবে চলতে দেয়া উচিত। মেধাবীদের পরিবর্তে অযোগ্যদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিলে কখনো শিক্ষার গুণগত মানের উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও শিক্ষার মান উন্নয়নে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়নি। আমরা অনেকে মনে করি, দেশে শিক্ষার বৈপ্লবিক প্রসার ঘটেছে। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার প্রসার আর মানসম্মত শিক্ষা এক নয়। কারণ প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ও নীতি দ্বারা আমরা আমাদের সন্তানদের আলোকিত মানুষ ও দেশপ্রেমিক করতে ব্যর্থ হয়েছি। সন্তানদের প্রকৃত মানবসম্পদে পরিণত করা যাচ্ছে না। তাই মানসম্মত শিক্ষাসহ শিক্ষার গুণগত মানের উন্নয়ন নিয়ে প্রগতিশীল সমাজ চিন্তিত। কারণ প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় মানব উন্নয়নের স্থলে আর্থিক উন্নয়নে সম্পৃক্ত হয়ে নৈতিকতাবর্জিত শিক্ষিতশ্রেণী গড়ে উঠছে। ফলে সর্বস্তরে আলোকিত দেশপ্রেমিক, নিঃস্বার্থবাদী, আদর্শবাদী সৎ ও মহৎ মানুষের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ দেশের মানুষ তাদের নিজস্ব রুচি, সৃজনশীলতা, মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধসহ নিজস্ব সংস্কৃতি হারিয়ে অপসংস্কৃতিতে আকৃষ্ট হয়ে মানবসম্পদের উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাই নৈতিক মূল্যবোধকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে শিক্ষাব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখতে হবে। এ কারণে দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাকে তার গুণগত মানোন্নয়নে আরো অধিক শক্তিশালী করতে হবে। এখানে উল্লেখ্য, মানুষ্যত্ব বিকাশে নৈতিক শিক্ষার বিকল্প নেই। অবশ্য বর্তমানে সরকার সবার জন্য নৈতিক শিক্ষা নিশ্চিতসহ মানসম্মত সার্বজনীন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে যা প্রশংসার দাবিদার। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা অনেকটা রেজাল্টনির্ভর, মেধানির্ভর নয়। জিপিএ ৫ বা এ প্লাস হলো মেধার স্মারক। অথচ ভালো রেজাল্টের চেয়ে মেধাবী যাচাই (Talent Hunt) অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা তারাই হবে আগামী দিনের প্রকৃত সৃজনশীল মানুষ। মেধাবী শিক্ষার্থী গড়ে তুলতে হলে মানসম্মত শিক্ষা বা শিক্ষার গুণগতমান, ভালো মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষকদের নৈতিকতা ও সৃজনশীলতা এবং অভিভাবকদের বাস্তবভিত্তিক যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গিও নিশ্চিত করতে হবে। মানসম্মত শিক্ষার অগ্রগতিতে শিক্ষকদের যোগ্যতা, দক্ষতা, সার্থক প্রাণবন্ত, প্রাঞ্জল, চমৎকার উপস্থাপনা কৌশল ও প্রয়োগিক গুণাবলির প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত। শিক্ষকদের অধিকতর উত্তম শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করতে হবে। যিনি শ্রেণীতে কেবল আলোচনা করেন তিনি মধ্যম বা মাঝারি শিক্ষক, যিনি শ্রেণীতে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণসহ আলোচনা করেন তিনি উত্তম শিক্ষক; আর যিনি শ্রেণীতে হাতে-কলমে শিক্ষাদানসহ আলোচনা করেন তিনি অতি উত্তম বা অধিকতর উত্তম শিক্ষক। আর অভিভাবকমণ্ডলী, ব্যবস্থাপনা কমিটি, সর্বস্তরের সুধীরা, শিক্ষানুরাগী ও গুণীজন যারা শিক্ষাকার্যক্রমকে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করেন তারাই হলো মহান শিক্ষক। তবে শিক্ষকদেরই ব্যক্তিত্ব প্রজ্ঞা ও দিকনির্দেশনার দ্বারা শিক্ষার্থীরা উৎসাহিত হয়। অতি উত্তম শিক্ষক সঙ্কটে ব্যাহত হচ্ছে মানসম্মত উচ্চশিক্ষা।
শিক্ষার উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জন করা এবং অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে প্রকৃত জীবন গড়ে তোলা। জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়া গলদপূর্ণ হলে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎও মুখ থুবড়ে পড়বে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম, পর্যাপ্ত যোগ্য শিক্ষক, গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য প্রচুর সুযোগ ও মূল্যায়ন পদ্ধতি ইত্যাদি উপাদানগুলো অপরিহার্য। গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো- সন্তোষজনক সংখ্যক সুশিক্ষক। কারণ সুশিক্ষকদের দ্বারা শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করা যায়। শিক্ষকতা কেবল একটি চাকরি নয় বরং একটি মহান পেশা। সর্বদা ন্যায়নীতির প্রশ্নে আপসহীন মূর্তপ্রতীক। শিক্ষার্থীদের মনন, মেধা, আত্মশক্তির বিকাশ, তাদের সাফল্যের গোপন তথ্য, সক্ষমতা ও সম্ভাবনা, জ্ঞানের গভীরতার পরিশীলন, উন্নয়ন ও প্রসার সাধনে শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। একজন শিক্ষককে তাই অতি উত্তম শিক্ষক হতে হবে। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মেধাহীনদের দখলে। ফলে মেধার মর্যাদায় তারা প্রাধান্য হারিয়েছে। শিক্ষক নিয়োগেও মেধাহীনরা দলীয় ও আর্থিক বিবেচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে। ফলে শিক্ষার মান ধীরে ধীরে অধঃগতিতে অর্থাৎ নিচে নেমে যাচ্ছে। অতি উত্তম শিক্ষকেরাই এ অবস্থার পরিবর্তন করতে পারেন। শিক্ষকেরা তাদের নিজস্ব নৈতিকতা নিয়েই শিক্ষকতায় আসেন। শিক্ষকতায় আসার পর শিক্ষকদের নৈতিকতা সৃষ্টি হয় না, বরং শিক্ষকতায় আসার পর নৈতিকতা পরিশীলিত করা প্রয়োজন। শিক্ষকতার মধ্যে আত্মোৎসর্গের আদর্শ থাকতে হবে। এ পেশায় প্রচুর অর্থ উপার্জন কাম্য নয়। যেহেতু শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। কয়েকজন বাণিজ্যিক শিক্ষকের জন্য পুরো শিক্ষকসমাজ তথা শিক্ষকতা পেশা অবমূল্যায়িত হতে পারে না। সব ধরনের কোচিং, প্রাইভেট সেন্টার বন্ধ না করলে কোচিংবাণিজ্য রোধ করা সম্ভব হবে না। কোচিং সেন্টার চালানো কেবল শিক্ষকতার নৈতিকতা পরিপন্থীই নয়, বরং জ্ঞানপাপেরও শামিল। তাই প্রাইভেট ও কোচিং নয়, আত্মবিশ্বাস ও অনুশীলনই জরুরি ও যথেষ্ট। শিক্ষায় কোচিং ভাইরাস মানসম্মত শিক্ষার অন্তরায়। কোচিং বাণিজ্য বন্ধে সরকার কর্তৃক প্রণীত ও গৃহীত নীতিমালা সত্যই প্রশংসনীয়। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যেই সরকার নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। এখন দরকার বাস্তবায়নের। শিক্ষাকে অনুৎপাদনশীল ও অলাভজনক খাত মনে না করে প্রকৃত মেধাবী জাতি গড়ে তোলার প্রয়োজনেই যোগ্য শিক্ষকদের সম্মানজনক জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা প্রদানে পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়নসহ শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়কারণও দীর্ঘ দিনের মানবিক দাবি। কারণ শিক্ষার প্রধান নিয়মক হচ্ছেন, শিক্ষকেরা। প্রসঙ্গত, মানসম্মত শিক্ষার প্রতিবন্ধকতার মধ্যে সঠিক শিক্ষানীতির বাস্তবায়নের অভাব, প্রতিকূল সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, দক্ষত, যোগ্য, মেধাবী ও উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব, সঠিক পাঠ্যসূচির অভাব, কারিকুলামে নৈতিক, ধর্মী ও মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত না হওয়া, প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব, অবাধ প্রাইভেট ও কোচিংবাণিজ্য, শিক্ষকদের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার অভাব, শিক্ষার উপকরণ ব্যবহার না করা, পাঠ পরিকল্পনা ও উপযোগী শিক্ষাদানের অভাব, অভিভাবকদের সচেতনতার অভাব প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। শিক্ষার বিষয়বস্তুসহ পাঠ্যক্রম ডিজিটাল হলে মানসম্মত শিক্ষার প্রতিবন্ধকতা হ্রাস পাবে এবং কোচিংবাণিজ্য ও কোচিং সেন্টারও বন্ধ হবে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যবস্থাপনা কমিটি, ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সমিতি, সব শিক্ষানুরাগীসহ সর্বস্তরের সুধী ও গুণীজনদের শিক্ষার সব কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হতে হবে। মানসম্মত শিক্ষার জন্য দরকার দক্ষ ও মানসম্মত শিক্ষক।

No comments

Powered by Blogger.