আমরা কতটা সুখী by এমদাদুল হক সরকার

মহাভারতের শ্লোক ৬৯-৭০-এ রয়েছে : যক্ষ যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করেন, সব প্রশংসনীয় বস্তুর মধ্যে সেরা কোনটি? সব ধনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কোনটি? সব প্রাপ্তির সেরা কোনটি? সব সুখের শ্রেষ্ঠ কোনটি? উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেন, দক্ষতা শ্রেষ্ঠ প্রশংসনীয় বস্তু। সব ধনের সেরা ধন বিদ্যা। সব প্রাপ্তির সেরা সুস্বাস্থ্য। আর সব সুখের শ্রেষ্ঠ সুখ সন্তুষ্টি। গতকাল ২০ মার্চ ছিল আন্তর্জাতিক সুখ দিবস। সুখ দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন) থেকে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। ২০১২ সাল থেকে জাতিসংঘ এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে আসছে। ২০১৭ সালের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট অনুযায়ী কয়েকদিন আগে পঞ্চমবারের মতো প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় এবার শীর্ষ অবস্থানে আছে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ নরওয়ে। প্রতিবেশী দেশ ডেনমার্ককে পেছনে ফেলে এবার তালিকার এক নম্বরে উঠে এসেছে দেশটি। আর ১৫৫টি দেশের মধ্যে সুখী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ১১০তম। সুখ হল মনের একটি অবস্থা বা অনুভূতি, যা ভালোবাসা, তৃপ্তি, আনন্দ বা উচ্ছ্বাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। জৈবিক, মানসিক, মনস্তাত্ত্বিক, দার্শনিক ও ধর্মীয় দিক থেকে সুখের সংজ্ঞা নির্ধারণ এবং এর উৎস নির্ণয়ের চেষ্টা করা হয়েছে। সঠিকভাবে সুখ পরিমাপ করা অত্যন্ত কঠিন। তাহলে কিসের ওপর ভিত্তি করে এ হ্যাপিনেস রিপোর্ট করা হয়? প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের সুখী দেশের তালিকাটি তৈরি করতে ছয়টি মানদণ্ডকে বিবেচনায় নেয়া হয়। এ ছয়টি মানদণ্ড হল মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি, স্বাস্থ্যকর জীবনের প্রত্যাশা, স্বাধীনতা, উদারতা, সামাজিক সমর্থন এবং দুর্নীতিবিহীন সরকার ও ব্যবসা। বাস্তবে আমরা কি সুখী? সুখের মানদণ্ডগুলোর দিকে একটু তাকানো যাক। সুখের প্রথম মানদণ্ড জিডিপি। আমাদের দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দীর্ঘদিন ৫ থেকে ৬ শতাংশের ঘরে আটকে থাকার পর ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে তা ৭ শতাংশের ঘরে উঠে এসেছে। এ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। নিঃসন্দেহে এটি সুখকর। দ্বিতীয় মানদণ্ড স্বাস্থ্যকর জীবনের প্রত্যাশা। রাজধানী ঢাকা আর নাগরিক সমস্যা সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে বহু আগেই। ঢাকাকে ভাবা হয় দুনিয়ার সবচেয়ে অপরিচ্ছন্ন মেগাসিটি। দুর্বিষহ যানজট, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি সংকট, পয়ঃনিষ্কাশনের জটিলতা, দুর্গন্ধময় ও বিষাক্ত বাতাস, দূষিত পরিবেশ, ঘনবসতি, ভেজাল খাবার, ব্যয়বাহুল্য, লাগামহীন বাসাভাড়া, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ইত্যাদি নানা সমস্যায় দিশেহারা এ নগরবাসী। সেই সঙ্গে মশা ও ছিনতাইকারীর উৎপাত তো রয়েছেই। বাঙালি বেশ উদার হলেও সুখের অন্যান্য মানদণ্ড সামাজিক সমর্থন, দুর্নীতিবিহীন সরকার ও ব্যবসানুকূল পরিবেশের দিক দিয়ে আমাদের অবস্থা হতাশাজনক। লাগামহীন শেয়ারবাজারে আজ আগুন তো কাল ধস। দুর্নীতি নেই এমন কোনো ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়া কঠিন। সংখ্যালঘু হামলা, ধর্মীয় উসকানি আর ব্লগার ও লেখকের ওপর হামলা দিন দিন বাড়ছে। তবে এতকিছুর পরও বিশ্বে বাংলাদেশের নতুন পরিচয় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এখন আর বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত ৪৭ দেশের তালিকায় নেই। আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হয়ে আসার সব শর্ত পূরণ করে এখন উন্নয়নশীল দেশ হতে চলেছি। আমরা চাই এ প্রক্রিয়া যতটা সম্ভব মসৃণ হোক এবং এজন্য সম্ভাব্য সবকিছুই করতে হবে। আশা করি একদিন আমরাও সবচেয়ে সুখী দেশে পরিণত হব।
এমদাদুল হক সরকার,শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.