সরকারি প্রকল্পে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি by এএমএম শওকত আলী

প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির কথা অনেকেই বলে থাকেন। এর মানে কি প্রতিষ্ঠানভিত্তিক দুর্নীতি না, অন্য কিছু? সরকারি, আধা সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও দুর্নীতি রয়েছে। অর্থাৎ যে কোনো প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি কমবেশি থাকার বিষয়টি কারও অজানা নয়। দুর্নীতি এককভাবে কখনও হয় না। সরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা গ্রহণের বিনিময়ে বাড়তি অর্থ দিতে হয়। এর কিছু উদাহরণ টিআইবির প্রতিবেদন ছাড়াও সময় সময় মিডিয়ায় উল্লেখ করা হয়। সম্প্রতি সড়ক ও জনপথ বিভাগের দুর্নীতি রোধে দুদক দীর্ঘ তদন্তের পর ২১ দফা সুপারিশ প্রণয়ন করেছে। এ ধরনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কারণ কোনো প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি বন্ধে সে প্রতিষ্ঠানই উদ্যোগী না হলে একমাত্র জেল-জরিমানা করে দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব নয়। কারণ জেল-জরিমানার বিষয়টি বিচারসাপেক্ষ। এ প্রক্রিয়া দীর্ঘ। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, দুর্নীতির মামলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে আসামি প্রমাণের অভাবে মুক্তি পেয়ে যায়। এ জন্য সংশ্নিষ্ট সংস্থাগুলোও একে অপরকে দোষারোপ করে। সংশ্নিষ্ট সংবাদে দেখা যায়, টেন্ডারে উল্লেখ করা শর্ত অমান্য করে অনিয়ম বা দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায়ই নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়। বলা বাহুল্য, এ বিষয়টি কারও অজানা নয়। তবে দুদক বলেছে, এ ক্ষেত্রে জবাবদিহির অভাব রয়েছে। জবাবদিহির অভাবের কথা সরকারি সব প্রতিষ্ঠানের প্রতি প্রযোজ্য। এ ক্ষেত্রে দুদকের সুপারিশ হলো, মনিটরিং ইউনিটের চূড়ান্ত প্রতিবেদন ছাড়া ঠিকাদারের বিল পরিশোধ না করা। চূড়ান্ত বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে সব সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিময়-কানুন রয়েছে। এসব নিয়ম-কানুন কি উপেক্ষা করা হচ্ছে- এ বিষয়ে সঠিক কিছু প্রকাশ করা না হলেও অনুমান করা যায়, চূড়ান্ত বিল প্রদানে শিথিলতা রয়েছে। বৃষ্টি, বন্যাসহ প্রাকৃতিক সুর্যোগ মোকাবেলায় কংক্রিটের সড়ক নির্মাণসহ অন্যান্য সুপারিশ করা হয়েছে। স্মরণ করা যায়, সড়ক নির্মাণে কংক্রিটের ব্যবহার বিষয়ে সরকারের অতি উচ্চ পর্যায়ের সূত্রে জানা গিয়েছিল। এ নিয়ে মিডিয়ায় কিছু বিতর্কও হয়েছিল। ওই সময় এ কথাও জানা যায়, সড়ক নির্মাণ বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা এ প্রস্তাব গ্রহণ না করার পক্ষে অভিমত দিয়েছিলেন। এর পর এ বিষয়ে আর কোনো আলোচনার কথা শোনা যায়নি। যে সুপারিশ অতীতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে, সেই একই সুপারিশ কেন পুনরায় করা হয়েছে, তা বোধগম্য নয়। স্থিরকৃত সিদ্ধান্তের প্রায়শ পরিবর্তন বাঞ্ছনীয় নয়।
একদিকে সড়ক নির্মাণে কংক্রিট ব্যবহারের সুপারিশ, অন্যদিকে বিটুমিনের গুণগত মান নিশ্চিত করা ও পর্যাপ্ত বিটুমিন ব্যবহার করার সুপারিশও করা হয়েছে। দুর্নীতির বিষয়টি নিম্নমানের সামগ্রী অথবা প্রয়োজনের তুলনায় কম সামগ্রী ব্যবহারের সঙ্গে যুক্ত। ঠিকাদাররা সাধারণত কম খরচ করে অধিক লাভ করার জন্য প্রয়োজন অথবা নির্ধারিত পরিমাণের তুলনায় কম বা নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে থাকেন। এ জন্য প্রয়োজন চলমান প্রকল্পের নিবিড় মনিটরিং ও পরিবীক্ষণ। সংশ্নিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব-পরিধির মধ্যে এটা বহুকাল ধরেই রয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে না বা হলেও অনেকটাই দায়সারাভাবে করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জবাবদিহির অভাবের প্রশ্নটি কতটুকু গ্রহণযোগ্য? সড়ক পরিবহনমন্ত্রী স্বয়ং নির্মাণাধীন সড়ক পরিদর্শনে যে সময় ব্যয় করছেন তা সর্বজনবিদিত। অতীতে কিছু ক্ষেত্রে তিনি একাধিক প্রকৌশলীকে দায়িত্বে অবহেলার দায়ে সাময়িকভাবে বরখাস্তও করেছেন। এর পরও এসব প্রশ্ন কেন উত্থাপিত হচ্ছে, তা আরও গভীরভাবে দেখা প্রয়োজন। সড়ক নির্মাণে দুর্নীতি বন্ধের লক্ষ্যে দুটি নতুন ধরনের সুপারিশ সংশ্নিষ্ট সংবাদে দেখা গেছে। এক, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলী দ্বারা চূড়ান্ত মেজারমেন্ট গ্রহণ; দুই, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সামাজিকভাবে নিরপেক্ষ কমিটি গঠন করে মাটি ভরাট কাজের তদারকি। প্রথমোক্ত সুপারিশের গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে পাল্টা যুক্তি দেওয়া সম্ভব। এ ধরনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা কষ্টসাধ্য হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এ ধরনের দায়িত্ব প্রদানের অর্থ হলো প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তাভিত্তিক জবাবদিহি শিথিল করা। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিজস্ব দায়িত্ব পালন করে এ ধরনের কাজ করা সঙ্গত কি-না, তাও ভেবে দেখা প্রয়োজন। দ্বিতীয় সুপারিশটিও যৌক্তিক নয় বলে মনে হয়। কারণ এ ধরনের কাঠামো স্থানীয় সরকার পর্যায়ে ষাটের দশক থেকে চালু করা হলেও সম্প্রতি এ ধরনের কমিটির সততা অথবা কার্যকারিতা প্রশ্নাতীত নয়। এছাড়া রয়েছে অন্য একটি প্রশ্ন। সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকল্পের আকার বৃহৎ। কিছু প্রকল্পে ঠিকাদারের কাজ মানসম্পন্ন ও সঠিক সময়ের মধ্যে শেষ করার বিষয়টি পরিবীক্ষণের জন্য আলাদা কারিগরি পরামর্শক নিয়োগ করতে হয়। অতীতে অনেক প্রকল্পে এটা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। এসব প্রকল্পের জন্য আলাদা স্থানীয় কমিটি করার প্রয়োজন বা অবকাশ নেই। অন্যান্য সুপারিশের ক্ষেত্রে বলা যায়, সুপারিশের আলোকে নতুন কোনো নীতিমালা করার যে বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, তার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, প্রকল্প শুরু করার আগে যে নিয়ম-কানুন মানার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তার সব ক'টি পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ও বিধিতে বলা আছে। এ আইন ও বিধি মানা বাধ্যতামূলক। এর বাইরে কোনো নিয়ম-কানুন চাপিয়ে দেওয়া যৌক্তিক নয়। তবে দুদকের প্রতিবেদনে অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ঠিকাদার প্রকৌশলীর যোগসাজশে দুর্নীতি হচ্ছে। যোজসাজশের বিষয়টি অবশ্য নতুন কিছু নয়। যে কোনো দুর্নীতির ঘটনায় দুই পক্ষের সম্মতির প্রয়োজন। তবে সম্মতি যাতে সহজে পাওয়া যায় তার জন্য প্রভাবশালী ঠিকাদারের চাপ প্রধান কারণ হিসেবে দুদক চিহ্নিত করেছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের সূত্রমতে, রাজনৈতিক ঠিকাদারদের দৌরাত্ম্য আর নির্মাণ মেরামতে গলদের কারণে সড়ক টিকছে না। এর বিপরীতে সুপারিশ কী, তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা কঠিন। অথচ রাজনৈতিক প্রভাবই প্রকল্পে দুর্নীতির অন্যতম প্রধান উৎস। রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয়টি সর্বজনবিদিত হলেও এর যে কুফল, তা বন্ধ করার জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ কখনও দৃশ্যমান নয়। সড়ক ও জনপথ ছাড়াও অন্যান্য সরকারি বা আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান বিষয়ে মিডিয়ায় এ ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাওরে বাঁধ নির্মাণে দলীয় প্রভাব শীর্ষক খবরে এ বিষয়টি ৫ মার্চ দৃশ্যমান ছিল। হাওরে বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির কথা গত বছরই জানা গিয়েছিল। বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ১৫৪টি হাওরের বোরো ধান নষ্ট হয়। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তিন লাখ ২৫ হাজার ৯৯০ জন কৃষক। এ বছর যাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি না হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়। এ সত্ত্বেও অনুসন্ধানের মাধ্যমে যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে তা হলো- এক. নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাঁধের কাজ শেষ হয়নি এবং দুই. কৃষকের আড়ালে কাজে যুক্ত হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। পত্রিকান্তরে জানা যায়, দুদক অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধে ২৫টি দল গঠন করেছে। এ দলগুলো কাজ শেষ করলে বহু তথ্য জানা যাবে। তবে সিংহভাগ তথ্য অনেকেরই অজানা নয়। প্রয়োজন শুধু অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। আইনি দৃষ্টিকোণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব দুদকের। এ কথা আংশিকভাবে সত্য। কারণ দুদক তদন্তসাপেক্ষে মামলা শুরু করলে দুদকের দায় শেষ। কিন্তু অনিয়ম ও দুর্নীতি যাতে না হয়, তার জন্য প্রশাসনিক কার্যক্রম শক্তিশালী করার বিকল্প নেই। সব ধরনের সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান এ লক্ষ্যে কাজ করলে দুদকের দায়িত্ব সহজতর হবে। এ জন্য প্রয়োজন মন্ত্রণালয়ভিত্তিক রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও কার্যকর সহায়তা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.