রাশিয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ খেলার প্রতিশ্রুতি দিলেন পুতিন

রোববার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভ্লাদিমির পুতিন যে চতুর্থ মেয়াদে প্রেসিডেন্ট ‘নির্বাচিত’ হতে যাচ্ছেন, তা শতভাগ নিশ্চিত ছিল (তার অনানুষ্ঠানিক একটি মেয়াদও ছিল, যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন দিমিত্রি মেদভেদেভ)। রাশিয়া পুতিনের পরবর্তী ছয় বছরের শাসনে প্রবেশ করল এমন একটি সময়ে, যখন বলপ্রয়োগ উপযোগী কোনো আন্তর্জাতিক আইনের অনুপস্থিতিতে একটি বেপরোয়া ঝুঁকি নেয়ার প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন তিনি। পুতিন তার বিগত ছয় বছর কাটিয়েছেন শুটার ভিডিও গেমের একজন খেলোয়াড়ের মতো। তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন সামান্য একটি হ্যান্ডগান নিয়ে- রাশিয়ার ক্ষয়িষ্ণু সামরিক বাহিনীর সংস্কারের প্রচেষ্টায় এবং এ বাহিনীকে কেবল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করার প্রতিজ্ঞায়। তার ছিল একটি বড় অস্ত্রাগার, যদিও সেটা ছিল যুক্তিসঙ্গতভাবেই অস্বীকারযোগ্য। যখন পুতিনের এটি দরকার হতো, তিনি নিজের কাজের জন্য আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও চুক্তির ভাষার ছদ্মাবরণে বড় ধরনের অজুহাত তৈরি করতে পারতেন। নিজের সর্বশেষ মেয়াদজুড়ে পুতিন ও তার আজ্ঞাবাহীরা অনেক কিছুই অস্বীকার করেছেন। যেমন- রাশিয়ার সেনারা ক্রিমিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, রাশিয়া একে সংযুক্ত করতে চায়, পূর্ব ইউক্রেনের বিদ্রোহকে মস্কো প্ররোচিত করেছে এবং সেনা ও অস্ত্র দিয়ে একে সমর্থন জুগিয়েছে, বিদ্রোহী বা খোদ রুশ সেনারা ২০১৪ সালের জুলাইয়ে একটি যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করতে সহযোগিতা করেছে, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট মিত্র বাশার আল আসাদ বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে বোমা, এমনকি রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করেছেন, ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের সময় ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির ওয়েবসাইট হ্যাকের ক্ষেত্রে রাশিয়া কিছু করেছে অথবা কোথাও ফ্রিল্যান্স হ্যাকিং এবং ভাড়াটে অভিযান চালিয়েছে, যুক্তরাজ্যের সাবেক একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে নার্ভ পয়জনের মাধ্যমে বিষপ্রয়োগ করেছে ইত্যাদি অভিযোগ। ওপরের সব বিষয়কে অস্বীকার করে বসে থাকা কঠিন, এমনকি খোদ পুতিনের জন্যও। এটি বলা যাচ্ছে না যে, সব অস্বীকারই উটকো। ট্রাম্প-রাশিয়া সংঘর্ষের রিপোর্টই হোক অথবা যুক্তরাষ্ট্রের অবকাঠামোগত বিষয়াদির হ্যাক করা তথ্য, পুতিনকে বুঝতে হবে যে, তার ও আমেরিকার জনগণের প্রমাণ দেখার অধিকার রয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ওপর অন্ধভাবে বিশ্বাস করা উচিত নয়। পুতিনকে অবশ্য এমনটি আর বেশি সময় করতে হবে না। এখন আর তিনি খেলনা অস্ত্রের ওপর নির্ভরশীল নন, বিপরীতে তিনি পরিচালনা করছেন একটি আধুনিক সামরিক বাহিনী, যারা সবচেয়ে বড় অস্ত্রের মুখোমুখি হওয়ার পরীক্ষা দিয়েছে।
সোভিয়েত আমল থেকে এ ধরনের মুখোমুখি অবস্থার মোকাবেলা করেছে রাশিয়া এবং একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী সামরিক প্রযুক্তিতে নিজেদের উপযুক্ত করেছে। অভ্যন্তরীণভাবে কোনো কিছু পরিবর্তনে অনিচ্ছুক এবং কী করতে গিয়ে কোন ক্ষতিতে পড়তে হয়- অর্থনীতিতে এমন হিসাব-নিকাশের মুখে পুতিন তার আগ্রাসনের বর্তমান খেলা চালিয়ে যাবেন। এমনকি যদি কোনো ক্ষেত্রে রাশিয়া অভিযুক্ত হয়ও, দেশটির ডিফল্ট পদ্ধতি হল অস্বীকার করা এবং কঠোর ও অনড় হয়ে বসে থাকা। দেশটি কোনো তদন্তেই ভালো আস্থা নিয়ে সহযোগিতা করবে না। বিপরীতে ক্রেমলিন চেষ্টা করতে থাকে তদন্তের মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে। যেমনটি তারা করেছে মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট এমএইচ ১৭-এর বেলায় ডাচ সেফটি বোর্ডের তদন্তের ক্ষেত্রে। গোয়েন্দাকে বিষপ্রয়োগের মামলায়ও এখন রাশিয়া তা-ই করার চেষ্টা করছে। এমনকি অন্য দেশের দিকে তারা অভিযোগের আঙুল তুলছে, যারা কিনা এ হামলায় রাসায়নিক ব্যবহার করতে পারে। এখন এটিও স্পষ্ট, যে কোনো ধরনের প্রমাণের পাহাড়ই অস্বীকারের মাধ্যমে দমিয়ে ফেলা যায় না। সেগুলো কেবল তখনই পরিত্যক্ত হবে, যখন পুতিন সিদ্ধান্ত নেবেন যে এগুলোর আর প্রয়োজন নেই। যেমন ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে ২০১৫ সালে রাষ্ট্রীয় টিভির ডকুমেন্টারিতে পুতিনকে নায়ক হিসেবে মহৎ করে তুলে ধরা হয়। যে কোনো ক্ষেত্রে অস্বীকার করা রাশিয়ার একটি রীতি হয়ে পড়েছে এবং এ কারণে একে হালকা করে দেখলে তাতে আস্থা রাখা যায় না, এমনকি খারাপ কাজের প্রমাণ হারিয়ে গেলেও। যে কোনো বিষয়কে অস্বীকার করার ক্ষেত্রে রাশিয়া নিশ্চিন্ত এজন্য যে, অনেক রুশ নাগরিক বিশ্বাস করেন রাশিয়াকে কলঙ্কিত করতে পশ্চিমা বিশ্বের সম্মিলিত চেষ্টা রয়েছে। তারা এটি বিশ্বাস করে কারণ, অন্যথায় নিজেদের দেশের বিষয়ে তাদের লজ্জিত হতে হবে এবং তা তীব্রভাবে অস্বস্তিকর। অস্বীকারগুলোকে বিশ্বাসের পাশাপাশি পশ্চিমাদের প্রতি রাশিয়ার খোঁচা দেয়া, ঐতিহাসিক অঞ্চল দখল করে নেয়া অথবা বিশ্বাসঘাতকদের শাস্তি ভাগ করে দেয়ার কারণে গর্ববোধও করে এই মানুষগুলো। এটি একটি মানসিক বিরুদ্ধবাদিতা, যা তৈরি করা সহজ হয়েছে কম অংশগ্রহণ এবং রাষ্ট্রীয় টিভির গৌরব ও ভোগান্তির অসম্ভব সমন্বয় সাধনের চেষ্টার মাধ্যমে। পুতিন জানেন, তিনি যা বলেন সমসাময়িক অন্য বিশ্বনেতারা তা বিশ্বাস করেন না। তাই বাকি বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়ার সরকারি যোগাযোগ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পারস্পরিক মৌখিক নয় (নন-ভারবাল)। একপাক্ষিক এ যোগাযোগের উদাহরণগুলোর মধ্যে আছে, যুক্তরাষ্ট্রের দিকে রকেট উড়ানোর উসকানিমূলক ভিডিও, যা এ মাসের শুরুতে নিজের স্টেট অব দ্য নেশন বক্তব্যে পুতিন ব্যবহার করেছেন; সরাসরি বিমান হামলা ও সেনা মুভমেন্ট এবং আরও আছে সাইবার হামলা ও গুপ্তহত্যার মতো বিষয়। শুক্রবার ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের সরকারি বন্ড বিক্রিও একটি নন-ভারবালের লক্ষণ, যদিও এটি একেবারে ভিন্ন ধরনের। তবে এতে করে সব ধরনের বিশৃঙ্খলা সত্ত্বেও বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবে এখনও রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বাসযোগ্যতা রয়েছে বলে প্রমাণিত হয়। পুতিন বলছেন তিনি পশ্চিমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চান- তার নিজের পরিভাষায়। তারপরও কিছু আস্থার প্রয়োজন রয়েছে এবং পুতিন কীভাবে এটি জয় করে এগিয়ে যান, তা দেখার বিষয়। বিভিন্নভাবে প্রকাশ যে, বড় আকারে হোক বা ছোট, তিনি পশ্চিমাদের সঙ্গে প্রকৃতপক্ষে কোনো ধরনের অংশীদারিত্ব চান না। সম্ভবত এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল তার তৃতীয় মেয়াদে। এটিই একদিক থেকে তার চতুর্থ মেয়াদকে নিশ্চিত করেছে। যদি পুতিন বিভিন্ন ধরনের আগ্রাসন সত্ত্বেও পার পেয়ে যেতে থাকেন, যদি সোভিয়েত ইউনিয়েনের পতনের পর থেকে যাওয়া কোনো বিধান দেশটি বড় সামরিক শক্তি হিসেবে অন্য কোনো দেশে প্রয়োগ না করে, যদি রাশিয়ার সরকারি ও বেসরকারি কোম্পানিগুলোর অর্থনৈতিক ক্ষতি গত ৬ বছরের মতো সীমিত পরিমাণের মধ্যেই থাকে এবং যদি পশ্চিমাদের বাইরে তুরস্ক, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ও চীন গঠনমূলকভাবে রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করতে থাকে, তাহলে পুতিনের গ্রহণযোগ্যতা বজায় থাকবে। তার উত্তরসূরিরা শিক্ষা নেবে যে, আপনি যদি শক্তিশালী হন বা ঝুঁকি নিতে সাহসী থাকেন, তবে হিংসা কোনো অপরাধ নয়। তবে যদি ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপের কারণে পুতিন হোঁচট খান, যদি রাশিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র সমস্যা আরও তীব্র হয় এবং যদি দেশটি একঘরে হয়ে পড়ে, তাহলে পুতিন ক্ষমতায় থাকাকালীনই তার উত্তরাধিকারী নিয়ে কৌতূহলোদ্দীপক লড়াই শুরু হতে পারে।
গালফ নিউজ থেকে অনুবাদ : সাইফুল ইসলাম
লিওনিড বারশিডস্কি : ব্লুমবার্গের প্রাবন্ধিক, রাশিয়ার সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.