উভয় সংকটে আমাদের বিচার বিভাগ by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

আমরা সবাই বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা চাই। রাজনৈতিক দলগুলো  ক্ষমতায় না থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য শোরগোল তোলে। আবার ক্ষমতায় গেলে দেখা যায়, ‘যে যায় লঙ্কায় সেই রাবণ হয়ে যান।’ কোনো কোনো সময় একশ্রেণীর বিচারকের ভূমিকা দেখে মনে প্রশ্ন জাগে তারাও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চান কিনা, নাকি ক্ষমতাসীনদের সন্তুষ্টি করে নিজেদের পদোন্নতি চান?
পাকিস্তানের জন্ম থেকেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ছিল একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রয়াত বিচারপতি কায়ানি তার আত্মকথায় লিখেছেন, ‘কোনো কোনো মামলায় সেটা রাজনৈতিক আর অরাজনৈতিক হোক, রায়দানের আগে আইনমন্ত্রী বা আইন সচিবের কাছ থেকে একটা গোপন চিরকুট পেতাম। তাতে নির্দেশ থাকত কোন পক্ষকে জয়ী করতে হবে। প্রধান বিচারপতি হওয়ার পরও এই চিরকুট পাওয়া বন্ধ হয়নি।’ এটা শুধু বিচারপতি কায়ানির অভিজ্ঞতা নয়, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চিফ জাস্টিস মোরশেদ সাহেব এই চিরকুটের নির্দেশ মানতে না চাওয়ায় তাকে সরকার নানাভাবে নাস্তানাবুদ করেছিল। তাকে দুর্নীতির মামলায় জড়ানোরও ভয় দেখানো হয়েছিল। পাকিস্তানের বিচার বিভাগকে সামরিক সরকারগুলো নানাভাবে ব্যবহার করেছে। গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ যখন নির্বাচিত সরকারকে বরখাস্ত করে গণপরিষদ ভেঙে দেন, তখন গণপরিষদের স্পিকার তমিজউদ্দীন খান সিন্ধু হাইকোর্টে মামলা করেন। সিন্ধু হাইকোর্ট গভর্নর জেনারেলের কাজকে অবৈধ ঘোষণা করেন; কিন্তু পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্ট গভর্নর জেনারেলের পক্ষে রায় দিয়ে তার কাজকে বৈধতা দেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিচার বিভাগ রাজনৈতিক চাপ থেকে অনেকটা মুক্ত হলেও পাকিস্তান আমলের লিগ্যাসি থেকে মুক্ত হতে পারেনি। জিয়াউর রহমানের আমলে বিচার বিভাগের সামান্য স্বাধীনতাও লুপ্ত হয় এবং পাকিস্তানের সেনাশাসকদের কায়দায় বিচার বিভাগকে ব্যবহারের চেষ্টা শুরু হয়। এই সেনাশাসক তার অবৈধ সরকারের কার্যকলাপ বৈধ প্রমাণ করার জন্য প্রথমে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে বসান এবং পরে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করে নিজে রাষ্ট্রপতির পদে বসেন। ফলে বিদেশি কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের মন্তব্য ছিল, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ একসময় সামরিক শাসনের সঙ্গে কোলাবরেশনের দায় থেকে রেহাই পেতে পারে না। বিএনপির খালেদা-সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে কি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে গেছে? না, তা আরও খর্ব করে গেছে। যার পরিণতি, বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচারে দুইজন বিচারপতির বিব্রতবোধ করা। বর্তমানে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের অবস্থা কী?
পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, তারা তাদের স্বাধীনতা নিয়ে উভয় সংকটে আছেন। তাদের স্বাধীন মতামত প্রকাশে সরকার বিরক্ত হতে পারে, এ আশঙ্কা তাদের কারও কারও মধ্যে হয়তো আছে। অন্যদিকে যে বিরোধী দল, বিশেষ করে বিএনপি, যারা সময় বুঝে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার দাবিতে মুখর, তারা তাদের নেতাদের নামে কোনো মামলা হলে তার সুষ্ঠু বিচার যাতে না হয়, সে জন্য রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে। দেশেরবিচার ব্যবস্থাকে তাই এই উভয় সংকটের মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে। দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং তার পুত্র তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির মামলাগুলো আওয়ামী লীগ সরকার করেনি। করেছে আগের এক-এগারোর সরকার। সেই সরকারের কাছে মুচলেকা দিয়ে তারেক রহমান চিকিৎসার নামে কিছুদিনের জন্য বিদেশে যান। আট বছর ধরে দেশে ফিরছেন না। বিচারের সম্মুখীন না হয়ে বিদেশে দীর্ঘকাল পালিয়ে থাকাও এক ধরনের অপরাধ স্বীকার। তাছাড়া তার বিরুদ্ধে আনীত কোনো কোনো মামলায় অপরাধ প্রমাণিত এবং সে জন্য আদালতের দণ্ড তার মাথায় ঝুলছে। বিএনপির নেতাকর্মীরা এই বিচারের তোয়াক্কা করছেন না। তারা দেশে বিদেশে হইচই শুরু করেছেন। তাদের নেতাকে মিথ্যা মামলায় ঝোলানো হয়েছে এবং তার বিচার স্বচ্ছ নয়। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট সংক্রান্ত মামলা কোনো রাজনৈতিক মামলা নয়। গুরুতর দুর্নীতির মামলা। এবং এই মামলা দায়ের করে গেছেন এক-এগারোর সেনা তাঁবেদার সরকার। কিন্তু বিএনপি অভিযোগ তুলছে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। আদালতের বিচারের ওপরও তাদের আস্থা নেই। আদালতে মামলার দিন বেগম জিয়া খুব কমই হাজির হন। যখন হাজির হন, তখন দেখা যায় কয়েক ডজন দলীয় আইনজীবী এবং শতাধিক দলীয় কর্মী নিয়ে আদালতে যান এবং তারা এমন হইচই শুরু করেন, যা আদালত অবমাননার শামিল। বিচারককে ভীতি দেখানোর নামান্তর। এটা অন্য কোনো সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে ঘটে না। কিন্তু বিএনপি তাদের বিরুদ্ধে আনীত রাজনৈতিক মামলা নয়, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মামলাগুলোও বানচাল করার জন্য আদালতে ঢুকে দুর্বৃত্তপনার যে ইতিহাস সৃষ্টি করে চলেছে, তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য এক বড় ধরনের হুমকি। আমাদের বিচারকদের এই হুমকির মধ্যে বসেই বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষা করতে হচ্ছে। আমাদের প্রতিবেশী ভারতে এখন বহু জাঁদরেল রাজনৈতিক নেতা, সাবেক মুখ্যমন্ত্রী, মন্ত্রী এখন দুর্নীতির জন্য অভিযুক্ত হয়ে বিচারে দণ্ডিত হচ্ছেন, জেলে যাচ্ছেন। তাদের দল বলছে না, এগুলো সাজানো মামলা, প্রতিহিংসার মামলা। তারা আদালতে ঢুকে স্লোগান দেন না। সুষ্ঠু বিচারকে প্রভাবিত করতে চান না। অথচ বাংলাদেশে দেখা যায় এর সম্পূর্ণ বিপরীত পরিস্থিতি। সম্প্রতি টেলিভিশন নিউজে বেগম জিয়ার পক্ষের একাধিক আইনজীবীর বক্তব্য শুনে বিস্মিত হয়েছি। তারা বলছেন, জিয়া অরফানেজের ঠিকানা তারা জানেন না। অর্থাৎ কোটি কোটি টাকার তহবিল নিয়ে গঠিত জিয়া অরফানেজের অস্তিত্ব নিয়েই সন্দেহ দেখা দিয়েছে। অথচ বেগম জিয়ার দল এবং আইনজীবীরা তার স্বরে চেঁচাচ্ছেন, এ মামলা সাজানো এবং বিচারে তা প্রমাণিত হয়েছে। যদি তাই হয় তাহলে বিচারকদের রায়ের জন্য অপেক্ষা না করে তারা কেন এ রায় তাদের বিরুদ্ধে যাবে এ আশঙ্কায় দেশে গণঅভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার চালাচ্ছেন? বাংলাদেশে বিচার বিভাগের জন্য- বিশেষ করে উচ্চ আদালতের বিচারকদের জন্য এটা সত্যই উভয় সংকট। ক্ষমতাসীন দল বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চায়। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয়- বিশেষ করে আইনমন্ত্রী তার খবরদারি ছাড়তে রাজি নন। মাঠের বিরোধী দল বিএনপি সবচেয়ে বেশি এখন বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য চেঁচাচ্ছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে অরাজনৈতিক কোনো মামলা হলেও রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ, আদালতে ঢুকে হইচই সৃষ্টি করে বিচারকদের মনে ভয় ঢুকিয়ে তারা সুস্থ ও সঠিক বিচার বানচাল করতে চান।
এ অবস্থায় দেশে স্বাধীন ও সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা গড়ে উঠবে কীভাবে? ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দীর্ঘ বারো বছর ক্ষমতায় থাকার পর নির্বাচনে পরাজিত হয়ে প্রধানমন্ত্রিত্ব হারান। মোরারজী দেশাই নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েই তাকে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য জেলে ঢোকান। তার পাসপোর্ট কেড়ে নেয়া হয়। এটা ছিল রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। কিন্তু এটা নিয়ে কংগ্রেস কোনো হইচই করেনি। তাদের আইনজীবীরা আদালতে ঢুকে গুণ্ডামি করেনি। ইন্দিরা গান্ধী স্বেচ্ছায় তিহার জেলে ঢুকেছিলেন। পরে তিনিই আবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন। বিএনপিকে এসব ইতিহাস শুনিয়ে লাভ নেই। তারা ক্ষমতায় না থাকলে মূষিক। ক্ষমতায় গেলে ব্যাঘ্র। বিচারব্যবস্থা কেন, গণতন্ত্রের কোনো ব্যবস্থাপনারই ধার ধারেন না। তাদের এক নেতা পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আনীত আগরতলা মামলার উদাহরণ টেনেছেন। এটা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির মামলা ছিল না। ছিল রাজনৈতিক মামলা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি পাকিস্তানকে ভাগ করতে চান। তার সঙ্গে সামরিক ও অসামরিক বহু অভিযুক্ত ছিলেন। এ মামলার বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ গর্জে উঠেছিল। কিন্তু খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চুরি ও দুর্নীতির মামলায় দেশের একজন মানুষও গর্জে ওঠেনি। গর্জাচ্ছেন শুধু বিএনপির নেতারা। দেশবাসীকে তারা গর্জানোর জন্য উসকাচ্ছেন। পারবেন কি? দেশে বিচার বিভাগের মর্যাদা ও স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার ব্যাপারে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল উভয় পক্ষকেই আগ্রহী ও সচেতন হতে হবে। দেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও আইনের শাসন যদি নিরাপদ হয়, তাহলে গণতন্ত্র, গণতন্ত্র বলে আমাদের অহেতুক চিৎকার করতে হবে না। আইনের সুষ্ঠু শাসনকে নির্ভর করেই দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে। নইলে গণতন্ত্রের জন্য অহরহ মায়াকান্না কেঁদে কোনো লাভ নেই।

No comments

Powered by Blogger.