সমাধান বের করতে হবে সু চিকেই by স্যার জন জেনকিন্স

পুলিশ পোস্টে স্বঘোষিত রোহিঙ্গা যোদ্ধাদের রক্তক্ষয়ী হামলা এবং তার জবাবে সেনাবাহিনীর ব্যাপক ও নির্মম অভিযানের পর গত আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যা ঘটেছে তা নিয়ে লিখেছি। নিজেদের ও পরিবারের সদস্যদের ওপর নানা ধরনের নির্যাতনের ফলে তখন থেকেই ভীত-সন্ত্রস্ত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশমুখী ঢল নামে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা সাত লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে।
মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের স্পষ্ট প্রমাণ থাকার পরও দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রথম স্টেট কাউন্সিলর ক্রমাগত সব কিছু অস্বীকার করে গেছেন এবং এই কুকর্মের সহায়তাকারী হিসেবে নিকৃষ্ট নজির স্থাপন করেছেন। আমার সর্বশেষ কথায় ব্যাখ্যা করেছি, কেন এসব অভিযোগকে মিথ্যা মনে করি। আমি মনে করি, এসব অভিযোগ অবহেলার প্রতিফলন অথবা মিয়ানমারের ইতিহাস না বুঝতে পারা এবং ক্ষমতার শেকড়ে থাকা সেনাবাহিনীর সাথে মুখোমুখি হতে সু চির ক্ষমতা সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝির বহিঃপ্রকাশ।  সবকিছুর পরও, সু চি রাখাইন পরিস্থিতির ওপর জাতিসঙ্ঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের রিপোর্ট অনুমোদন করেছেন। ওই রিপোর্টের সূচনা বক্তব্যে সু চি পরিকল্পিতভাবে পুলিশ পোস্টে পরিকল্পিত হামলার বিষয়টিকে খুবই হালকাভাবে তুলে ধরেছেন। এরপর ওই রিপোর্টে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে, সে অনুযায়ী যেন যৌক্তিক সমাধানে পৌঁছানো যায় এবং সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ বৈরী মনোভাব, রোহিঙ্গাদের প্রতি বিরূপ জনমত এবং দেশের বাইরে থেকে অব্যাহত সমালোচনার প্রেক্ষাপটে সু চি নিজেই আন্তর্জাতিক পরামর্শক সভা গঠন করেছেন। গত সপ্তাহে সাবেক প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের সময়কালের একজন কর্মকর্তা এবং নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের গভর্নর, জ্বালানিমন্ত্রী ও জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত বিল রিচার্ডসন রাখাইনে তার প্রথম সফরে পরামর্শক সভার বৈঠকে যোগ দিয়ে পরিস্থিতির উন্নয়নের ব্যাপারে হতাশা প্রকাশ করেছেন এবং একই সাথে পদত্যাগ করে এ বিতর্ক আরো উসকে দিয়েছেন। গণমাধ্যম ফলাও করে প্রচার করায় এ ঘটনা মানুষের ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করেছে এবং সু চি আরেক দফা ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হলেন। এমনকি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে রিচার্ডসন বলেন যে, তিনি মনে করেন মিয়ানমারের শেষ ভরসা একমাত্র সু চি। বিগত সপ্তাহে লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল রোডে যখন পায়চারী করছিলাম, পূর্ব লন্ডন মসজিদের বাইরের জনবহুল মার্কেটে দেখলাম রোহিঙ্গাদের জন্য বহু সাহায্য তোলার বাক্স এবং সাধারণ মানুষ এতে ব্যাপক সাড়া দিচ্ছে। আমি বুঝতে পারলাম, এই ইস্যু তাদের মনে কতটা দাগ কেটেছে। এটাও ভেবেছি, এই ইস্যুর বাস্তবতা অনুযায়ী জাতিগত চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের কতটা সম্মিলিত উদ্যোগ নেয়া এবং একটি সমাধানে পৌঁছাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কতটা ভূমিকা পালন করা উচিত। রিচার্ডসনের সমালোচনা করেছেন ওই সভার আরেক সদস্য, দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী রোয়েল্ফ মেয়ের। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘মিস্টার রিচার্ডসন মন্তব্য করতে খুব বেশি সময় নেননি। আমার মনে হয়, এটা ঠিক হয়নি এবং তার জন্য এমন মন্তব্য শোভনীয় হয়নি। আমাদের দেয়া পরামর্শ সরকার ভালোভাবেই শুনেছে এবং গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। এসব পরামর্শ বাস্তবায়নে আমরা তাদের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবো।’ এ পরামর্শ সভার প্রধান, থাইল্যান্ডের সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী সুরাকিয়ার্ত সাথিরাথাই তার দলের প্রথম রাখাইন সফর নিয়ে সাংবাদিকদের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘আমরা কফি আনান কমিশনের ৮৮টি সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য মিয়ানমার সরকারকে পরামর্শ দিয়েছি।
আইনের শাসন এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার ব্যাপারে জোর দিয়েছেন স্টেট কাউন্সিলর। আমার মনে হয়, সামনে এগিয়ে যাওয়ার এটাই সঠিক পথ।’ পরামর্শ সভা নিয়ে রিচার্ডসনের সমালোচনার বিষয়ে তিনি বলেন, তাদের খোলা মন নিয়ে আসতে হবে এবং বাস্তবায়ন পরিষদের সাথে এক সুরে কথা বলতে হবে। ইউনিসেফের নির্বাহী উপ-পরিচালক জাস্টিন ফরসিথ বৃহস্পতিবার বিবিসিকে বলেন, শরণার্থীদের পক্ষ থেকে রোমহর্ষক ও গ্রহণযোগ্য অভিযোগ পাওয়ার পরও আমাদের মনে রাখতে হবে, রাখাইনে যা হচ্ছে তার পেছনে সু চি নন, কাজ করছে সেনাবাহিনী। একই কথা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ধারাবাহিক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। উপরিউক্ত ব্যক্তিদের কথা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই সমালোচকদের এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির স্থিতিশীল ও মানবিক সমাধান খুঁজে না পাওয়ার দায় সরলভাবে সু চির ওপর দিয়ে চাপিয়ে দেয়া উচিত হবে না। আমি বিশ্বাস করি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নিজের অবস্থান থেকে তিনি তার সাধ্য মতো সবই করছেন। কিন্তু তিনি প্রতিনিয়ত কঠিন প্রতিকূলতা মোকাবেলা করছেন। যখনই তিনি আন্তর্জাতিক চাপে ব্যক্তিগতভাবে পদক্ষেপ নিতে এগিয়ে আসছেন, তখনই এসব প্রতিকূলতা তার ক্ষমতাকে সীমিত করে দিচ্ছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদে ফেরত পাঠানো, পুনর্বাসন ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের চুক্তি হয়ে যাওয়ার পর বাস্তবিক অর্থে আমরা এখন কি দেখতে চাই রাখাইনে ক্ষমতাপূর্ণ আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর কার্যকর উপস্থিতি? আর এটাই মূলত ওই এলাকায় সমন্বিত মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের নিরাপদ আবাসন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা, সহিংসতায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার পুনঃগঠন, মৌলিক চাহিদা পূরণের টেকসই সমাধান নিশ্চিত করা এবং ঘৃণাত্মক ও উসকানিমূলক আচরণ আইনের আওতায় আনতে সংস্কারমূলক কার্যক্রম হাতে নেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারকেও সাহায্য করবে। দীর্ঘ মেয়াদে এমন কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে করে সরকার সব নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সেনাশাসিত একনায়কতন্ত্র থেকে বের হয়ে একটি সত্যিকারের দায়িত্বশীল, প্রতিনিধিত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যেতে পারে এবং চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে পারে। সব মিলিয়ে সু চিকে খুব প্রয়োজন। তাকে ছাড়া স্থায়ী কোনো সমাধান পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। সমস্যার সমাধানের মানসিকতা থেকে এবং তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানো নয়, বরং বাস্তব সহযোগিতাভিত্তিক যৌক্তিক প্রস্তাবনা সংবলিত গঠনমূলক সমালোচনা করা হলে তা খুবই ভালো। একই সাথে, তা ওই বিষয়কে ব্যাপক পরিসরে শনাক্তকরণ এবং স্থিরকরণেও সহায়ক ভূমিকা রাখে। মেয়ের, ফোরসিথ এবং সাথিরাথাই যেসব পরামর্শ দিয়েছেন, সেগুলো ছাড়া বাকিসব অপ্রয়োজনীয় নীতিবাক্য কচলানোর মতোই বিপজ্জনক।
‘আরব নিউজ’ থেকে ভাষান্তর করেছেন মোহাম্মদ সাজেদুল ইসলাম।
* স্যার জন জেনকিন্স: ‘পলিসি এক্সচেঞ্জ’র সিনিয়র ফেলো। তিনি ১৯৯৯ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত। ২০১৫ সাল পর্যন্ত সৌদি আরবে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত। ২০১৭ সাল পর্যন্ত মানামাভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্যাটেজিক স্টাডিজে মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক পরিচালক এবং ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যাকসন ইনস্টিটিউটের সিনিয়ের ফেলো।

No comments

Powered by Blogger.