তাবলিগের বিরোধ মিটিয়ে ফেলুন

নজিরবিহীন ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হয়েছে এবারের বিশ্ব ইজতেমা। তাবলিগ জামাতের প্রায় শতবর্ষের মেহনতের ইতিহাসে এ ধরনের বিরোধের, মুখোমুখি অবস্থান, হাতাহাতি, মারামারি, দখল-পাল্টা দখল, এমনকি রাস্তা অবরোধ করে লাখো মানুষকে তীব্র কষ্টের মধ্যে ফেলার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা আমাদের দেখতে হয়েছে এবারের বিশ্ব ইজতেমাকে সামনে রেখে।
যার প্রভাব নবীওয়ালা এ দাওয়াতি কাজটিকে করেছে অপূরণীয় এক ক্ষতি। প্রশ্ন হল, আত্মশুদ্ধির শান্তিপূর্ণ ও আধ্যাত্মিক এ আন্দোলনের কপালে কলঙ্ক লাগানো, সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে তাবলিগ জামাত বিষয়ে বিরূপ পরিস্থিতি তৈরির পেছনে দায় কার? ইসলাম ধর্মের সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্বীন চর্চা এবং অন্য ধর্মের লোকদের ইসলামের প্রতি আহ্বান জানানো এর মূল উদ্দেশ্য। ইলিয়াস (রহ.) দেওবন্দ ভাবধারার আলেম ছিলেন এবং এ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষের মধ্যে দ্বীনের স্পৃহা জাগ্রত করা। এ কারণে শুরু থেকেই তাবলিগের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন, সহায়তা, এমনকি সরাসরি অংশগ্রহণ ছিল এ দেওবন্দের আলেমদের। আধ্যাত্মিক এ আন্দোলনের শুরুর দিকে ভারত অখণ্ড ছিল। এর আনাচে-কানাচে দাওয়াতি কার্যক্রম চলেছে এবং এখনও চলছে দেদার। কিন্তু একটি সময় পাকিস্তান, পাকিস্তান থেকে পরে বাংলাদেশ হলেও দাওয়াতি কার্যক্রমে কোনো ধরনের বিভক্তি লক্ষ করা যায়নি। পাকিস্তান হওয়ার পর তাবলিগের মূল মারকাজ নেজামুদ্দিন থেকে রাইবেন্ডে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হলেও তা হালে পানি পায়নি। একইভাবে ইজতেমাও হয়ে আসছে বাংলাদেশেই। পাকিস্তানের রাইবেন্ডের মারকাজ ও আমাদের কাকরাইল মারকাজ থেকে সহযোগিতার মাধ্যমে মূলত নেজামুদ্দিনের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ইজতেমাসহ তাবলিগের সব ধরনের ব্যবস্থাপনা। দেশে দেশে তাবলিগের মূলনীতি ছিল আলেমদের সম্মান এবং তাদের বেশি বেশি করে কাজের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করা। অন্যদিকে বিভিন্ন মহলের সমালোচনার পরও যেহেতু বান্দাকে আল্লাহর দিকে ডাকার জন্য, ব্যক্তি জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য এ কাজের কার্যকর কোনো বিকল্প সত্যিকারার্থেই নেই, তাই আলেমরা একে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে আসছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জেনারেল শিক্ষিত সাথীদের সমালোচনা বা এড়ানোর মুখোমুখি যে আলেমরা হননি,
এমন কিন্তু নয়। তবে সেটি ছিল একেবারেই ব্যতিক্রম। এর পেছনে আলেম ও ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিতরা গুরুত্বপূর্ণ এ দাওয়াতি কাজের সঙ্গে কম মেলা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমালোচনা করাকেই দায়ী করা যায়। নবীওয়ালা কাজ নবীর ওয়ারেসরা না করলে যা হয়। তারপরও ভারতে দেওবন্দ এবং পাকিস্তান ও বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বে দেওবন্দ ভাবধারার আলেম সমাজের প্রত্যক্ষ সমর্থনের মধ্য দিয়েই বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে তাবলিগ এবং উভয়পক্ষ কেউ কারও থেকে কখনও বিমুখ হননি। বান্দাকে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক করিয়ে দেয়ার এ মাধ্যম পারস্পরিক বিরোধিতার কারণে বাধাগ্রস্ত না হোক- এটি আমাদের সার্বক্ষণিক চাওয়া। আল্লাহ কবুল করুন। তাবলিগের জন্ম হয়েছে ভারতে, এর সবচেয়ে বেশি ও কঠোর মেহনত হয় পাকিস্তানে আর ইজতেমা আয়োজনের কারণে পৃথিবীব্যাপী তাবলিগের দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে বাংলাদেশ। তাবলিগের প্রায় শতাব্দীর ইতিহাসে এ তিনটি দেশে রাজনৈতিক বহু বিবর্তন, প্রশাসনিক ভাঙন ও সীমানা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু তাবলিগের কাজে সেগুলো অনৈক্য তো দূরের কথা, কোনো প্রভাবই ফেলতে পারেনি। তা পারার কথাও নয়, কারণ সবকিছু ছাপিয়ে এটি কোনো বৈষয়িক উপার্জনের পথ নয়। কেবলই আত্মশুদ্ধি, আমল, পরকালীন মুক্তি ও নবীর দাওয়াত প্রচারের কাজ। যা হোক, নেজামুদ্দিনের বিভক্তি এড়িয়ে চলার বহু চেষ্টা করা হলেও শেষ পর্যন্ত তার রেশ কাকরাইল পর্যন্ত নিয়ে এসেছে ইবলিস। সাদ সাহেবের পক্ষ নিয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছেন কিছু মুরব্বি। এ নিয়ে কাকরাইলে হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে গত বছরের শেষের দিকে এবং বেশিরভাগ শূরার সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে মাওলানা সাদকে এনে নিজেদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও প্রভাব বিস্তার এবং নিজেদের ক্ষমতা দেখানোর চেষ্টা করেছেন তারা। মাওলানা সাদকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে তা তারা দেখিয়েছেনও। এ অবস্থায় নিজেদের সম্মানিত আমিরকে আতিথেয়তা না দেয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে অভ্যর্থনা জানানোর চেষ্টাও কাকরাইলের মুরব্বিদের পক্ষ থেকে করা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি আর হয়ে ওঠেনি। দীর্ঘ ইতিহাসে শান্তির আন্দোলন হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তাবলিগে রাস্তা অবরোধের মতো কলঙ্ক লেপন করে দিয়েছে একটি পক্ষ। এর দায়ভার আপাতদৃষ্টিতে আলেম ও শূরার সংখ্যাগরিষ্ঠদের দিকে গেলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ শূরার সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে মাওলানা সাদকে নিয়ে আসার উদ্যোক্তারাও দায়ভার এড়াতে পারে না। অভিযোগ আছে এদের গুটিকয়েক ব্যক্তি নিজেদের বিরুদ্ধে ওঠা কিছু গুরুতর অভিযোগ ধামাচাপা দিতে এটি করেছেন।
কী ক্ষতি ও কীভাবে ক্ষতিপূরণ?
যারা মাওলানা সাদকে নিয়ে এসে সফলতা দেখাতে চেয়েছেন তাদের কাছে প্রশ্ন, সাদ সাহেব আল্লাহর দিদারে চলে গেলে আপনারা কি তাবলিগ ছেড়ে দেবেন? নবীওয়ালা দাওয়াত কি বন্ধ করে দেবেন? যদি জবাব নেতিবাচক হয়, তবে কেন ইজতেমায় না গিয়ে কাকরাইলে বসে রইলেন? এমনকি এখনও মারকাজ কব্জায় রাখার জন্য নিজেদের মতানুসারীদের দিয়ে কাকরাইলের পাহারার ব্যবস্থা করাচ্ছেন? আপনারা কী জানেন না, আল্লাহ বলেছেন, মোহাম্মদ কেবলই একজন নবী বৈ কিছু নন। তার আগে অনেক নবী গেছেন। তবে কি তিনি মারা গেলে বা শহীদ হলে তোমরা ফিরে যাবে? (সূরা আলে এমরান)। উম্মতের সত্যিকারের দরদি হলে নিজেদের অবস্থান ভেবে দেখতে হবে। অন্যদিকে সাদ সাহেবকে বাধা দিয়ে যারা নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছেন, তাদেরও নিজেদের অপরিণামদর্শী কাজের কারণে লজ্জিত হতে হবে। বেশি বেশি কাজের সঙ্গে মিলতে হবে। নিজেদের যেতে ও অনুসারীদের পাঠাতে হবে। আলেমদের আরও বেশি হারে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য তাবলিগের সাথীরা ব্যাকুল। নবীর ওয়ারিশ হিসেবে তারা আপনাদের পেতে চায়। কিন্তু কাজে জুড়বেন কম, প্রভাব চাইবেন বেশি- এমন মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। দু’পক্ষের বাড়াবাড়ি-বিরোধের কারণে এবার ইজতেমায় মেহনতি সাথীদের উপস্থিতি কম ছিল, এটা উভয়পক্ষই জানেন। বিদেশি মেহমান অন্য বছরের তুলনায় অর্ধেক এসেছেন, তা-ও অজানা নয়। এমনকি কেবল তাবলিগে গিয়ে দ্বীনদার হয়েছেন, সন্তানদের দ্বীনি শিক্ষা দিয়েছেন- এমন মানুষও নিজেরা যাননি ও সন্তানদের পাঠাননি ইজতেমায়। এর অর্থ এটি নয় যে, ইজতেমার মূল উদ্দেশ্য বেশি সময়ের জন্য, বেশি জামাত বের করা- এবার পূরণ হয়নি। বিদেশি সাথীদের জামাত কম বের হয়েছে। এটি সবাইকেই পোড়ানোর কথা। কারণ আপাতত বিরোধ দেখা গেলেও উভয়পক্ষের সবাই যে দ্বীনি কাজের জন্য, বান্দাকে আল্লাহমুখী করার জন্য ব্যাকুল, তা কারও অজানা নয়। আমরা বিশ্বাস করি, প্রকাশ না করলেও সবাইকে বিষয়টি পোড়াচ্ছে। ফলে নিজেদের মনোসান্ত্বনার জন্য হলেও এক হয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, এতে যত দেরি হবে দ্বীনের কাজের ততই ক্ষতি হবে। দ্বীনি ভাই হিসেবে, আল্লাহ কর্তৃক বর্ণিত নবী (সা.)-এর সাহাবিদের (রা.) গুণ ‘তারা পরস্পরের জন্য দয়ালু-মেহেরবান’ নিজেদের মধ্যে আছে প্রমাণের জন্য হলেও বিরোধ ভুলে যেতে হবে। দুর্ভাগ্যের বিষয়,
এমন একটা সময় তাবলিগের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়েছে, যখন আরব বিশ্বে এর চেয়ে বেশি তাবলিগ প্রসারের সময় এসেছে। কারণ সৌদি যুবরাজ ঘোষণা দিয়েছেন, তারা উগ্র সালাফিপন্থী থেকে মধ্যমপন্থী ইসলামের দিকে ফিরে আসবেন। যখন একে সুযোগ হিসেবে নিয়ে নবীর দেশে এগিয়ে যাওয়ার কথা, তখন কিনা তাবলিগকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারের রাজপরিবারের সদস্যের গাড়ির চাবি-কাগজপত্র ইজতেমায় আটকে রাখার মতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় আর কী হতে পারে! ঘটনা পরম্পরায় যা কিছু ঘটেছে, তা অভ্যন্তরীণ সমঝদারির কিছুটা অভাব থেকেই। আর কিছু নয়। দেওবন্দ ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার পরও বাংলাদেশ সরকার চেষ্টা করেছে আরও দূরত্ব যেন তাবলিগের বিবদমান পক্ষের মধ্যে না ঘটে। সে ক্ষেত্রে মাওলানা সাদকে এনে একপক্ষ সফল, তো উনাকে ফিরিয়ে দিয়ে অন্য পক্ষ সফল- কারও কিছু হারায়নি। তবে দায়ী না পেয়ে দ্বীন শেখার সুযোগ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। উভয়পক্ষই ‘আল্লাহর রুজ্জুকে ধরে রাখা’র আদেশ পালন করছে। তবে কারও মধ্যেই ‘ঐকমত্য থাকা ও বিচ্ছিন্ন না হওয়া’র আমল নেই। দ্বীনের স্বার্থে দ্রুত তা-ও ফিরিয়ে আনতে হবে। আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। এরই মধ্যে হয়ে যাওয়া ক্ষতি কাটিয়ে উঠার জন্য বিরোধ ভুলে দ্রুত কাজে নামার তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক : সাংবাদিক
saifulh92@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.