কেউ কারো নয়!

শেষ কয়েক বছর ধরে বুকের মধ্যে কেমন যেন এক তীব্র ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। প্রথমে চেপে রাখলেও এখন বার্ধক্যের আবরণে একে আর ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। মাঝেমধ্যে মধ্যরাতে প্রচণ্ড ব্যথার প্রকোপে ঘুম ভেঙে যায়। তখন সারা রাত বিছানায় বসে থাকি। আর অপেক্ষা করতে থাকি- আর কতদূর? নানা ভাবনা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। কিছুতেই তাদের দূরে ঠেলে দিতে পারি না। ইদানীং বুকের ব্যথার সঙ্গে সঙ্গে কাশিটাও পিছু ছাড়ছে না। মাঝেমধ্যে মনে হয় এ দুটি মিলে জীবন নামের কারাগার থেকে আমায় মুক্ত করবে। আমি নিজেও তেমনটিই চাই। আর কত বয়ে বেড়াতে হবে! তবে আমি ভালো করেই বুঝতে পারছি, সময় আমার হাতে খুবই কম। সুতরাং যা করার তাড়াতাড়িই করতে হবে। সেদিন রাতে খুব করে মনে পড়ছিল অভিযুক্তকারীনি সেই প্রিয় মুখটির কথা। কেমন আছে সে? কি করছে এখন? নিশ্চয়ই পাশে কাউকে রেখে সুখনিদ্রায় বিভোর হয়ে আছে। আচ্ছা, নিশিত রাতে যখন কোনো স্বপ্ন দেখে সে চমকে ওঠে, তখন কি আমার কথা ভাবে? অথবা সেকি আদৌ বেঁচে আছে? চোখটা কেমন যেন অবসাদে বুজে আসছে। একটু তন্দ্রাভাব এসে ভর করছে আমার ওপর। আস্তর খসেপড়া এবড়োথেবড়ো দেয়ালের সঙ্গে পিঠটা একটু হেলান দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করেছিলাম। ভয়ংকর এক স্বপ্ন দেখে জেগে উঠলাম! এটি কি স্বপ্ন নাকি আমার কল্পনা- ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না!
বুকের মধ্যে প্রচণ্ড ব্যথায় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে কিন্তু স্বপ্নটা দেখার পর বুকটা এমনভাবে ধপ ধপ করছে যে, তা ব্যথার প্রকোপকে পিছু ফেলে দিচ্ছে। হাত-পা ভীষণ রকম কাঁপছে। খুব বেশি ইচ্ছে করছে এখন লেকের ধারে একবার যেতে। কিন্তু এখন মধ্যরাত। রাস্তাঘাটে কেউ নেই। শুধু দূর থেকে নাইটগার্ডের বাঁশির শব্দ আর কুকুরগুলোর ডাক থেমে থেমে ভেসে আসছে। কিন্তু মনে হচ্ছে, আমাকে এখন যেতেই হবে, দেরি করলে চলবে না। আমার সময় হয়তো আর বেশি নেই। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। কাঁপা কাঁপা হাতে অন্ধকার ঘরে দেয়াশলাই খুঁজতে গিয়ে কীসের সঙ্গে যেন এক প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলাম। চোখের ভ্রু বরাবর ফেটে গিয়ে আঝোর ধারায় রক্ত পড়তে লাগল, ডান পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির নখটা সম্পূর্ণ উল্টে গেল। ফিনকি দিয়ে সেখান থেকে রক্ত বেরিয়ে আসছে। কোনোমতে আলোটা জ্বালিয়ে ঘরের মেঝেতে বসে পড়লাম। এক টুকরো কাপড় দিয়ে ভ্রুটা চেপে ধরলাম। আর হাত দিয়ে মুঠ করে ধরে রাখলাম পায়ের ক্ষতস্থান। ঘরের কোণে পড়ে থাকা ময়লা চাদরটি গায়ে চাপিয়ে, লাঠিটি শক্ত করে ধরে বেরিয়ে পড়লাম। কাঁপা কাঁপা শরীর। বুকে অসহ্য ব্যথা। তার ওপরে ক্ষত। সঙ্গে কাশির প্রকোপে মাঝেমধ্যে নিশ্বাস নেয়া কষ্টকর হয়ে উঠছে। কিন্তু পুরোটা পথ আমাকে পাড়ি দিতেই হবে। অনেক কষ্টে রাস্তাটা পেরিয়ে লেকের কাছাকাছি একটা ছোট্ট ব্রিজে এসে বসলাম। শরীরটা আর কুলিয়ে উঠতে পারছে না। ভ্রুর ক্ষত থেকে রক্ত চুয়ে চুয়ে চোখের মধ্যে যাচ্ছে। পায়ের ক্ষত থেকে এখনও রক্ত পড়ছে। জুতার সঙ্গে রক্ত লেগে জুতা আঠালো হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে চাপ লেগে সেখান থেকে এতই রক্ত ঝরছে যে, পা পিছলে পড়ে যাচ্ছি। কিন্তু সবকিছু পেছনে ফেলে পৌঁছে গেলাম লেকে। বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে আসছে। মনে হচ্ছে এখনই বুঝি দেহ থেকে প্রাণটা বেরিয়ে যাবে। কিন্তু আমার কাজ যে এখনও বাকি! আমাকে লেকের ওপারে যেতে হবে, যেখানে আমি আমার অভিমানীকে শেষবারের মতো দেখেছিলাম। বহু কষ্টে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। এক পা, দু পা করে পৌঁছলাম আমার প্রিয় সেই প্রশ্নবালার কাছে। কনক্রিটের বেঞ্চটা আজ চেনাই যাচ্ছে না। উজ্জ্বল সেই বেঞ্চটা আজ শ্যাওলা পড়ে কালচে রঙ ধারণ করেছে। আজ থেকে বহু বছর আগে রোজ আমরা এখানে বসতাম। দুজন পাশাপাশি। একটুও দুরত্ব থাকত না আমাদের মধ্যে। আমার বাহুতে তোমার মাথাটি রেখে চুপটি করে বসে থাকতে তুমি। আর বলতে সারটা জীবন এমনি করেই কাটাবে, কখনও দূরে যাবে না। একদিন তোমার ব্যাগের কোনায় লেগে আমার সামান্য কেটে যায়। তুমি তখন আমায় নিয়ে কেমন পাগলের মতো করছিলে! তোমার পছন্দের নতুন ওড়নাটি ছিঁড়ে আমার হাতে বেঁধে দিয়েছিলে! কিন্তু আজ দেখো আমি ক্ষতবিক্ষত, রক্তে ভেসে যাচ্ছি। তুমি আমায় বেঁধে দাও না। আমি পারছি না। খুব কষ্ট হচ্ছে। তুমি দেবে না? তুমি বলেছিলে- একটা মুহূর্তও আমায় ছাড়া থাকতে পারবে না। আজ কতগুলো যুগ আমি তোমায় দেখি না। তোমার কথা শুনি না। তোমার স্পর্শ আমি পাইনা। একটি বারের জন্যে হলেও তুমি আসো। আসবে না তুমি? আসবে না? হঠাৎ প্রচণ্ড বেগে বাতাস বইতে শুরু করল। বুকের ব্যথাটা প্রচণ্ড রকম বেড়ে গেল। কাশির প্রকোপে দেহটা মাটির সঙ্গে লুটিয়ে পড়ল। ভ্রু থেকে তখনও গড়িয়ে গড়িয়ে রক্ত পড়ছিল। পা থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসছিল তাজা তাজা রক্ত। হঠাৎ মনে পড়ে যায়, এক গুণী ব্যক্তির একটি কথা- ‘পৃথিবীতে কেউ কারো নয়; নিজেই নিজের কিনা ভেবে দেখার অবকাশ আছে!’
লেখক:জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ্যান্ডমিডিয়া স্টাডিজ ডিপার্টমেন্ট,স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

No comments

Powered by Blogger.