হোঁচট খেয়ে মধ্যপথে ট্রাম্প by অনুপম দেবাশীষ রায়

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেওয়া প্রথম স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন ভাষণে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শোনাল ঠিক প্রেসিডেন্টদের মতো। কেবল নির্বাচনের খাতিরে যে আক্রমণাত্মক আগ্রাসী প্রার্থী রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন চেয়েছিলেন, গত বুধবার রাতের ভাষণে মনে হলো, তিনিই ভেতরে-ভেতরে একজন রিপাবলিকান। ভোটে জয়ের খাতিরে আগ্রাসী আর আক্রমণাত্মক রূপ ধরেছিলেন। একেবারে একজন মার্কামারা রিপাবলিকানের মতো করে ট্রাম্প আওড়ালেন দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ আর আমেরিকান ড্রিমের বুলি, ঠিক যেন তিনি আশির দশকের রোনাল্ড রেগান। তিনি বললেন সমন্বয়ের কথা, একতার কথা। শতবর্ষী মিঠে কথার রাজনীতির সংস্কৃতি অনুসারে তিনিও দেখালেন স্বপ্ন, সেই পর্যন্ত পৌঁছানোর বাস্তবতাকে পুরোপুরি আবছা রেখেই। তবে যদিও ট্রাম্প একজন রাজনীতিবিদের মতো করে কথা বলতে বা স্ক্রিপ্ট পড়তে শিখে গেছেন, তাঁর পৃথিবী এখনো রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁর ভাষণ শুনতে শেখেনি। যাঁরা ট্রাম্পকে ভালোবেসেছিলেন তাঁর সোজাসাপটা বক্তব্যের জন্য, তাঁর অনড় অবস্থানের জন্য আর তাঁর অরাজনীতিবিদসুলভ আচরণের জন্য, তাঁদের কাছে এই জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ বরং একটি হৃদয়ভঙ্গেরই কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তবে তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীদের খুশি করবার জন্য কি যথেষ্ট বুলি আওড়াননি ট্রাম্প? তা আউড়েছেন। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের বিল গ্যালস্টনের মতে, তাঁর এই আবৃত্তি পুরোপুরি মিছে কথাও নয়। আমেরিকার অর্থনীতি আসলেই ফুঁসে উঠেছে, আয় বাড়ছে, বিনিয়োগ বাড়ছে। ট্রাম্পের নেতৃত্বে এরই মাঝে পাস হয়েছে ট্যাক্স রিফর্ম, রক্ষণশীল বিচারকেরা পেয়েছেন আসন আর ওবামাকেয়ারের দারুণ অজনপ্রিয় স্বাস্থ্যবিমা কেনার বাধ্যবাধকতা গিয়েছে আস্তাকুঁড়ে (যদিও ওবামাকেয়ার পুরোপুরি বাতিলের বিষয়টি দারুণ হোঁচট খেয়ে পড়েছে)। কাজেই ভালো অর্থনীতিতে টিকে থাকা সব প্রেসিডেন্টের মতোই সব গুণ নিজের বলে দাবি করে বসেছেন ট্রাম্প। যদিও এর অনেকটাই তিনি পেয়েছিলেন উত্তরাধিকারসূত্রে। উপাত্ত আসলেই বলছে যে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের বেকারত্বের হার রেকর্ড পরিমাণে কমেছে, তবে এই কমার ধারা শুরু হয়েছিল সেই ২০১০ সালে। উপাত্ত আরও বলছে, আমেরিকার ঋণের বোঝাও বেড়েই চলেছে আর ট্রাম্পের নীতির কারণে আগামী দশকে তা এক ট্রিলিয়ন পেরোবে। তবে এসব ক্ষতিকর উপাত্ত লুকিয়ে ফেলা ট্রাম্পের জন্য কোনো ব্যাপারই নয়।
যতই তাঁর বিরোধীরা মাইক হাঁকাক না কেন, ট্রাম্পের কাছে টুইটার আছে! এ জন্যই বলছি যে ট্রাম্পের আজকের ভাষণটি আরেকটু হলেই সফল হয়ে যেত, যদি তাঁর সমর্থকেরা মধ্যপন্থী রক্ষণশীল হতেন। ট্রাম্পের আজকের ভাষণ আবারও প্রমাণ করেছে যে তিনি রক্ষণশীলদের বলে দেওয়া পথেই হাঁটছেন। তবে ট্রাম্পের জন্য দুঃসংবাদ হলো, তাঁর সমর্থকেরা খুব একটা মধ্যপন্থী নন যে এতে তাঁদের মন গলবে। তাঁর সত্যিকারের জীবন-মরণ সমর্থকেরা অনেক বেশি ভাবেন বরং অন্য একটি ইস্যু নিয়ে, যেটি নিয়েই ট্রাম্প কথা বলে ফেলেছেন বড্ড বেশি। আর সব ছেড়েছুড়ে কেবল অভিবাসন নিয়েই সবিস্তারে আলোচনা করতে গেছেন তিনি, আর সেটা বলতে গিয়েই বলে ফেলেছেন আপসের কথা। বলেছেন যে সীমান্তদেয়ালের জন্য ২৫ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ আর আইনগত অভিবাসন সীমিত করার বিনিময়ে তিনি দেড় মিলিয়নের বেশি কাগজবিহীন অভিবাসীকে নাগরিকত্বের সুযোগ করে দেবেন। তবে আইনি অভিবাসনের গলা টিপে ধরার কারণে আর বাজেটের থেকে দেয়ালের নামে টাকা নিয়ে যাওয়ার কারণে ডেমোক্র্যাটরা বা স্বাধীন মধ্যবামপন্থীরা এই আপসে রাজি হবেন বলে মনে হয় না। সত্যিকারের আপসে আসতে গেলে আর মধ্যপন্থীদের দলে টানতে গেলে ট্রাম্পকে আরও অনেক ছাড় দিতে রাজি হতে হবে। কাজেই আজকের ভাষণের মধ্য দিয়ে মধ্যপন্থীদের সঙ্গে পাওয়ার বদলে বরং নিজের দলের কড়া ডানপন্থীদের সমর্থন হারাতে বসেছেন ট্রাম্প। রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ (ট্রাম্পের সাবেক নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী) এরই মাঝে বলেছেন, কাগজহীনদের নাগরিকত্বের কথা বলে ট্রাম্প তাঁর প্রতিশ্রুতির খেলাপ করছেন। যে অতি ডান ব্রাইটবার্ট নিউজ তীব্রভাবে ট্রাম্পের পক্ষের শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল, তাঁরাই এখন ট্রাম্পের বদনাম করে তাঁকে ডাকছেন ‘অ্যামনেস্টি ডন’ বা ক্ষমার সরদার। ডানপন্থী থিংক ট্যাংক হেরিটেজ অ্যাকশন ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেও যত তীব্রভাবে তাঁর সমালোচনা করা যায়, ততটুকুন করছে। এর সব ঘটে গেছে আজকের ভাষণের আগেই। আর আজকের এই ভাষণে তাঁর এই সমালোচিত প্রকল্পের কথা আবারও আউড়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প বরং নিশ্চিত করলেন যে তাঁর অন্তঃপ্রাণ সমর্থকদের সবাই তাঁর প্রতিশ্রুতিতে আপসের কথা শুনছেন। কাজেই যে মুলা ঝোলানো রাজনীতির থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় ট্রাম্পকে তাঁরা ভোট দিয়েছেন, অনেকের কাছে মনে হবে যে ট্রাম্প নির্বাচিত হয়ে ঠিক সেই মুলা ঝোলানোর রাজনীতিরই পুনরাবৃত্তি করছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প ওয়াশিংটন ডিসির বাতাস আর রাজনৈতিক বাতাসার মিঠে ভাষা শিখতে শুরু করেছেন। তাঁর ভাষণ তাই সেই মিঠে ভাষার ওপরে ভাসা প্রচারণা আর ভবিষ্যৎ স্বপ্নের মাঝেই সীমিত থাকা উচিত ছিল। তা না করে বরং ট্রাম্প কথা বলতে গিয়েছেন তাঁর প্রকল্প পরিকল্পনা নিয়ে আর বেছে নিয়েছেন ঠিক সেই প্রকল্প, যেটি হয়তো ভেঙে দেবে তাঁর কঠিনতম সমর্থকদের হৃদয়। ট্রাম্পের সমর্থকেরা আজ টিভি খুলেছিলেন তাঁদের স্বপ্নের বাস্তবায়নের হালখাতা দেখতে, তার বদলে ট্রাম্প তাঁদের ধরিয়ে দিয়েছে আদিম অকৃত্রিম মুলা, যার স্বাদ পেয়েই এত দশক ধরে রাজনীতিবিমুখ হয়ে ছিল আমেরিকার সুপ্ত সংখ্যাগুরু। কাজেই এই ভাষণের পর রিপাবলিকানরা যখন নির্বাচনে লড়তে যাবেন সামনের দিনে, তখন হয়তো তাঁদের হাতেও হারিকেন ধরিয়ে দেবে সুপ্ত জনতা—হয়তো লুপ্ত হয়ে যাবে তাদের ট্রাম্পকার্ড। অনুপম দেবাশীষ রায়: আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতির ছাত্র, হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটি, ওয়াশিংটন ডিসি।

No comments

Powered by Blogger.