ক্রীড়া পরিষদ আইন কি যুগোপযোগী by পবিত্র কুন্ডু

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আইনের (১৯৭৪) প্রস্তাবিত সংশোধনী যাচাই-বাছাইয়ের পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে গেছে। ধরে নেওয়া যায়, এরপর মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়ে জাতীয় সংসদে গেলেই আইনটি নতুন রূপে প্রণীত হয়ে যাবে। যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদার বলেছিলেন, সামরিক সরকারগুলো অধ্যাদেশ জারি করে যে সংশোধনী এনেছে, তা বাতিল করে আইনটি যুগোপযোগী করে বাংলায় প্রণয়ন জরুরি হয়ে পড়েছিল। আসলে আইনটির মৌলিক পরিবর্তন হচ্ছে না। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সাধারণ পরিষদে অর্থ,
পরিকল্পনা, স্বরাষ্ট্র, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিবেরা যুক্ত হচ্ছেন। কার্যনির্বাহী পরিষদে রাখা হয়েছে ক্রীড়া, শিক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিবদের। বলা হচ্ছে খেলাধুলার সঙ্গে নিবিড় সংযোগ আছে বলেই এই মন্ত্রণালয়গুলোর প্রতিনিধিত্ব জরুরি। গোটা ক্রীড়াঙ্গন অবশ্য আশায় ছিল, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আইন সংশোধিত ও পরিবর্ধিত হয়ে যে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আইন ২০১৭ পাওয়া যাবে, সেটি হবে একটি মাইলফলক । জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে ‘দ্বৈত শাসনের’ অবসান ঘটবে। ৪৪ বছর ধরে চালু একটি অগণতান্ত্রিক ধারা বাতিল হবে। প্রথমে ‘দ্বৈত শাসন’ বিষয়টির ব্যাখ্যা দেওয়া যাক। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ হলো ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন ও সমন্বয়ক প্রতিষ্ঠান। সরকার সমস্ত ক্রীড়া কার্যক্রম ও উন্নয়নের সমন্বয় সাধন করবে এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। বাস্তবায়ন করবে সরকারি নীতিমালা। বর্তমান আইনে মন্ত্রণালয়ের প্রধান ও উপপ্রধান (এখন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী) প্রতিষ্ঠানটির প্রধান (চেয়ারম্যান) ও উপপ্রধান (ভাইস চেয়ারম্যান) হিসেবে থাকেন। কারণ এতে কাজের পুনরাবৃত্তি হয়। মন্ত্রীরা ক্রীড়া পরিষদে যে সিদ্ধান্ত নেন, তা-ই আবার মন্ত্রণালয়ে যায় তাঁদের অনুমোদনের জন্য। তা ছাড়া নিজের অধীন প্রতিষ্ঠানের প্রধান হওয়াটা মন্ত্রীকে মানায়ও না। অগণতান্ত্রিক ধারাটা হলো ২০ (ক)। এই ধারাবলে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ কারণ না দেখিয়েই যেকোনো ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী কমিটি ভেঙে দিতে পারে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় এই ধারা প্রয়োগ করে ভেঙে দিয়েছিল ফুটবল ফেডারেশনের নির্বাচিত কমিটি। ফিফা নিষিদ্ধ করেছিল বাংলাদেশকে। সেই ঘটনা দেশবাসী ভুলে যায়নি। একটি নতুন আইন করতে গেলে বা আইনের সংশোধনী আনতে গেলে সেটি নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা হওয়া উচিত, তাঁদের মতামত নেওয়া উচিত। কিন্তু বিভিন্ন ক্রীড়া ফেডারেশন, অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন, ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়া সংগঠক ও পৃষ্ঠপোষকদের দাবি, তাঁদের সেভাবে জানানোই হয়নি বিষয়টি! পরে কেউ কেউ এ নিয়ে আপত্তি তুলেছেন, যদিও মৃদুস্বরে। যুব ও ক্রীড়া সচিব আসাদুল ইসলাম সেদিন বলছিলেন, ‘আমরা জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোকে জানিয়েছিলাম। তারা এই সংশোধনীর ব্যাপারে মত না জানালে কী করার আছে?’ ফেডারেশনগুলো মতামত জানায়নি বলে আইনটি সত্যিকারের ক্রীড়াবান্ধব ও যুগোপযোগী হতে পারবে না? ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার যখন ক্রীড়া পরিষদ আইন প্রণয়ন করে, বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন ছিল ছোট। সময়ের প্রবহমানতায় ছোট্ট ক্রীড়াঙ্গন এখন অনেক বড়, পত্রপল্লবে সুশোভিত। খেলা এখন শুধু খেলাই নয় বা নিছক চিত্তবিনোদনের মাধ্যমও নয়; শ্রমঘন শিল্প, ব্যবসা।
ক্রীড়া সাফল্যে যেমন দেশের গৌরব বাড়ে, তেমনি অর্থও উপার্জিত হয়। আর অর্থযোগ হলে কিছু ‘অনর্থযোগ’ও হয়। শিকড় গাড়ছে ক্রীড়া দুর্নীতি। ক্রিকেটে ঢুকে পড়েছে জুয়া। দুর্নীতি দমনের জন্য ক্রীড়া পরিষদ আইনে ধারা রাখা উচিত ছিল। ক্রীড়া ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুযোগ রাখা যেত। খেলাধুলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ক্লাবগুলো সমাজসেবা অধিদপ্তর বা যৌথ মূলধনী কোম্পানিতে নিবন্ধিত। এদের ব্যাপারে ক্রীড়া আইনে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা থাকা দরকার। ১৯৯৮ সালে প্রণীত ক্রীড়া নীতি অনুযায়ী ক্রীড়া পরিষদ, ক্রীড়া পরিদপ্তর ও ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে একই ছাতার নিচে আনতে পারলে ভালো হতো। কেননা, দেশবাসী দেখছে, ভিন্ন তিনটি প্রতিষ্ঠান বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করায় ক্রীড়া উন্নয়ন কাঙ্ক্ষিত গতি পাচ্ছে না। ২০০৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, খেলাধুলা শিক্ষা, শারীরিক সুস্থতা ও বিশ্বশান্তির সহায়ক। জাতিসংঘের চোখ দিয়ে দেখলেও দেশের একমাত্র ক্রীড়া আইনটিকে আধুনিক ও মানসম্পন্ন করে তোলার বিকল্প নেই। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বর্তমান সরকার সুযোগ পেয়েও সেটি করল না। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার প্রণয়ন করে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আইন। ক্রীড়াঙ্গনেও গণতন্ত্রের হাওয়া ঢোকে ওই সময়। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে সম্পন্ন করে নির্বাচন। শেখ হাসিনার সরকারের তৃতীয় মেয়াদে বাংলাদেশের একমাত্র ক্রীড়া আইনটি সমস্ত অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে আধুনিক ও যুগোপযোগী কেন হবে না,
সেটাই প্রশ্ন।
পবিত্র কুন্ডু প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি

No comments

Powered by Blogger.