শতকোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার



রাজধানীর অস্থায়ী কোরবানির পশুর হাটগুলো এবারও সমঝোতার মাধ্যমে পানির দরে ইজারা দেয়া হয়েছে। বাজারের বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনা না করেই নির্ধারণ করা হয়েছে হাটের ইজারামূল্য। দুই সিটি কর্পোরেশনের একশ্রেণীর কর্মকর্তা ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীর যোগসাজশে গোপনে সম্পন্ন হয়েছে ইজারা সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম। এতে সরকার শতকোটি টাকার বেশি রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হবে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, আগের বছরগুলোয় একই পদ্ধতি অনুসরণ করে হাট ইজারা হলেও এবার অনিয়মের মাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি। জানা গেছে, এরই মধ্যে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ২২টি হাটের মধ্যে ১৫টির দর ও ইজারাদার চূড়ান্ত করা হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যে বাকি সাতটিও চূড়ান্ত হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট কোরবানির পশুর হাট সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা, নির্ধারিত স্থানে পশুজবাই নিশ্চিকরণ ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে বর্জ্য অপসারণ সংক্রান্ত সার্বিক কার্যক্রম মনিটরিং করছে। এ ইউনিটের কাছে দুই সিটি কর্পোরেশনের দেয়া তথ্যমতে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) হাটগুলোয় পশু বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার গরু এবং ২৫ হাজার ছাগল। আর ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ গরু এবং ২১ হাজার ছাগল। পশু ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, ছোট-বড় মিলিয়ে এবার প্রতিটি গরুর গড়মূল্য হবে সর্বনিন্ম ৬০ হাজার টাকা এবং প্রতিটি ছাগলের গড়মূল্য হবে সর্বনিন্ম ১০ হাজার টাকা। আর প্রতিটি গরু ও ছাগল থেকে শতকরা ৫ টাকা করে হাসিল আদায় করবে হাট ইজারাদাররা। সেই হিসাবে ডিএসসিসি এলাকার হাটগুলোর গরু বিক্রি করে হাসিল আদায় হবে অন্তত ৭৫ কোটি টাকা। আর ছাগল বিক্রি করে হাসিল আদায় হবে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। আর ডিএনসিসি এলাকার হাটগুলো থেকে গরু বিক্রি করে হাসিল আদায় হবে ৬০ কোটি টাকা। আর ছাগল বিক্রি করে হাসিল আদায় হবে অন্তত ১ কোটি ৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ এসব হাটগুলো থেকে এবার সর্বমোট হাসিল আদায় হবে ১৩৮ কোটি টাকা। আর ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ২২টি হাটের এবারের ইজারামূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২৩ কোটি টাকা। এ হিসাবে কমপক্ষে ১১৫ কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে সরকার। এছাড়া রয়েছে গাবতলী স্থায়ী কোরবানির পশুর হাট। এ হাটে বাৎসরিক ইজারামূল্য ১১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। রাজধানীর অস্থায়ী হাটগুলোর তুলনায় গাবতলী হাটে বেশি কোরবানির পশু বিক্রি হয়। এতে কী পরিমাণ রাজস্ব আদায় থেকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে, তার কোনো হিসাব নেই বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। জানতে চাইলে বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম যুগান্তরকে বলেন, এবারও গত বছরের মতো কোরবানি পশুর একই ধরনের দাম থাকবে। গরুর সর্বনিন্ম গড়মূল্য হতে পারে ৬০ হাজার টাকা এবং ছাগলের সর্বনিন্ম মূল্য হতে পারে ১০ হাজার টাকা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছর ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের অস্থায়ী ২২টি হাটে ২ লাখ ৮৩ হাজার গরু-ছাগল বিক্রি হয়েছে। এসব হাট থেকে ইজারামূল্যের প্রায় চারগুণ হাসিল আদায় হয়েছে। হাটগুলোর ইজারামূল্য ছিল ১৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। আর হাসিল আদায় করা হয় ৭৪ কোটি টাকা। বাস্তব চিত্র আরও বেশি হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, অস্থায়ী কোরবানি পশুর হাটের দরপত্র প্রতিযোগিতামূলক না হওয়ার পেছনের অন্যতম কারণ হচ্ছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রভাব এবং টেন্ডার সমঝোতা। আর এ কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকে সংসদ সদস্য, কাউন্সিলর ও সরকারদলীয় নেতাদের। তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হাটে কোনো আবেদন জমা পড়ে না। প্রতিটি হাটের পাতানো দরপত্রের কারণে প্রতিবছর সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণেই থাকে অস্থায়ী কোরবানির পশুর হাট। প্রতিবছর কোরবানির ঈদ উপলক্ষে ঈদের আগের তিন দিন এবং ঈদের দিন রাজধানীর কিছু জায়গায় পশুর অস্থায়ী হাট বসানোর অনুমোদন দেয় ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। এসব হাটে ইজারা দেয়া এবং হাট শেষে আবর্জনা সংগ্রহের কাজ করে দুই সিটি কর্পোরেশন। অন্যদিকে হাটের ইজারাদাররা হাটে বাঁশ-খুঁটি পুঁতে গরু বাঁধার জায়গা তৈরি করে এবং হাট ব্যবস্থাপনা করে। সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সিটি কর্পোরেশন বেশি কাজ করলেও বেশি মুনাফা পাচ্ছেন ইজারাদার। জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, সরকারি হাটবাজার বরাদ্দ নীতিমালা-২০১১ অনুসরণ করে রাজধানীর অস্থায়ী কোরবানি পশুর হাট ইজারা দেয়া হয়। এক্ষেত্রে বিগত তিন বছরের হাটের ইজারামূল্যের সঙ্গে ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত মূল্য যোগ করে হাট ইজারা দেয়া হয়। এবারের কোরবানির পশুর অস্থায়ী হাট ইজারার ক্ষেত্রে সেই নিয়মের কোনো ব্যত্যয় করা হয়নি। তবে অস্থায়ী কোরবানির পশুর হাটগুলো থেকে ইজারামূল্যের চেয়ে অনেক বেশি হাসিল আদায় হয়, এটার সত্যতা স্বীকার করেন এ কর্মকর্তা। তিনি আরও বলেন, নীতিমালার বাধ্যবাধকতার কারণে এর চেয়ে বেশি দর নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি, তবে বিষয়টি ভবিষ্যতে আলোচনা করা দরকার বলে অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এবার পশুর হাটের দরপত্র ক্রয়ের সুযোগ অবারিত ছিল। তবে বিক্রি কম হওয়ায় দরপত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয় না। কিন্তু কেউ দরপত্র না কিনলে এক্ষেত্রে তাদের কিছু করার থাকে না বলে জানান। অন্যদিকে ডিএনসিসির সম্পত্তি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, উন্মুক্ত টেন্ডারের মাধ্যমে রাজধানীর অস্থায়ী কোরবানি পশুর হাটের ইজারা দেয়া হয়। এক্ষেত্রে সরকারি নীতিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, হাট ইজারা দেয়ার পর কোন হাটে কত গরু বিক্রি হয়েছে, কিংবা ইজারাদার কত টাকা লাভ করেছে, সে তথ্য সিটি কর্পোরেশনের জানার কোনো সুযোগ নেই। হাটের সার্বিক ব্যবস্থাপনা করেন ইজারাদাররা। তবে পশুর অস্থায়ী হাট থেকে রাজস্ব আয় কীভাবে বাড়ানো যায়, সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে। কেননা আমরাও বুঝতে পারি, ইজারামূল্যের চেয়ে কোনো কোনো পশুর হাটে অনেক বেশি হাসিল আদায় করা হচ্ছে। তবে এবার বেশিরভাগ হাটের মূল্য অনেক বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আরও সতর্কতা অবলম্বন করা হবে।
কয়েকটি হাটের ইজারা সংক্রান্ত তথ্য
ঝিগাতলা : অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঝিগাতলা হাজারীবাগ অস্থায়ী কোরবানির পশুর হাটের গত বছরের ইজারামূল্য ছিল ৬৬ লাখ ১০ হাজার টাকা। গত বছর ওই হাটে গরু বিক্রি হয় ১০ হাজার ৩২০টি এবং ছাগল বিক্রি হয় ৪ হাজার ১২০টি। শতকরা ৫ টাকা হাসিল হিসাবে ইজারাদার গরু বিক্রি করে ৩ কোটি ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং ছাগল বিক্রি করে ২০ লাখ ৬০ হাজার টাকা। ছাগল ও গরু বিক্রি করে ইজারাদার মোট হাসিল আদায় করে ৩ কোটি ৩০ লাখ ২০ হাজার টাকা। সরকারি ইজারামূল্য থেকে ইজারাদার গত বছর ওই হাট থেকে বেশি হাসিল আদায় করে ২ কোটি ৬৪ লাখ ১০ হাজার টাকা। এ অবস্থা জানার পরও এবার ঝিগাতলা হাটের সরকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৭০ লাখ ৪৫ হাজার টাকা।
রহমতগঞ্জ : গত বছর রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস সোসাইটি হাটের ইজারামূল্য ছিল ৯ লাখ ১৫ হাজার টাকা। ওই হাটে মোট গরু বিক্রি হয় ৪ হাজার ৯৮০টি। গরুর গড়মূল্য অনুযায়ী ১ কোটি ৪৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা হাসিল পেয়েছেন ইজারাদার। ইজারামূল্যের চেয়ে গত বছর ওই পশুর হাট থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ ২৫ হাজার টাকা বেশি হাসিল আদায় করে ইজারাদার। ডিএসসিসি এবার এ হাটের ইজারামূল্য নির্ধারণ করেছে মাত্র ১০ লাখ ৩ হাজার টাকা।
ভাটারা : গত বছর ভাটারা সাঈদনগর হাটের ইজারামূল্য ছিল ১৫ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। এ হাটে গরু বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার এবং ছাগল ৩ হাজার। গড়মূল্য হিসাবে গরু বিক্রি করে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকার হাসিল আদায় করা হয়। ইজারাদার এ হাট থেকে মোট হাসিল আদায় হয় ১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। ইজারামূল্যের চেয়ে ইজারাদার হাসিল বেশি আদায় করে ১ কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এবার এ হাটের ইজারামূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
প্রভাবশালীদের কব্জায় পশুর হাট : ডিএনসিসির খিলক্ষেত ৩০০ ফুট সড়ক ও দক্ষিণ পাশের বসুন্ধরার প্রাচীরের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গার হাটের ইজারা পেয়েছেন খিলক্ষেত থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা হাজী মো. কেরাতম আলী দেওয়ান, বাড্ডার আফতাবনগর হাটের ইজারা পেয়েছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবদুর রহমান রুবেল, উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের ১ নম্বর গোলচত্বর সংলগ্ন খালি জায়গার হাটের ইজারা পেয়েছেন দক্ষিণখান থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. শফিক, ভাটারা সাঈদনগর পশুর হাটের ইজারা পেয়েছেন গুলশান থানা আওয়ামী লীগের নেতা মোজাফফর হোসেন, বসিলা পুলিশ লাইন্সের জায়গার হাট পেয়েছেন ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সহসভাপতি মো. শাহ আলম, মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের ইস্টার্ন হাউজিংয়ের খালি জায়গার হাট পেয়েছেন কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সালাহউদ্দিন মাহমুদ, মিরপুরের ডিওএইচএস সংলগ্ন উত্তর পাশের খালি জায়গার হাটের ইজারা পেয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা ইমরান উদ্দিন মোল্লাহ। অন্যদিকে ডিএসসিসির মেরাদিয়া বাজার পশুর হাটের ইজারা পেয়েছেন ডিএসসিসির ৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা মো. শরীফ, উত্তর শাজাহানপুরের খিলগাঁও রেলগেট সংলগ্ন মৈত্রীসংঘের মাঠ পশুর হাটের ইজারা পেয়েছেন ১১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল লতিফ, গোপীবাগের হাটের ইজারা পেয়েছেন আওয়ামী লীগ কর্মী মোহাম্মদ সহিদ উদ্দিন, হাজারীবাগ হাটের ইজারা নিয়েছেন থানা আওয়ামী লীগের নেতা অহিদুর রহমান ওয়াকিব, রহমতগঞ্জ খেলার মাঠ হাটের ইজারা পেয়েছেন মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নেতা হাজী শফি মাহমুদ, কামরাঙ্গীরচর চেয়ারম্যান বাড়ির হাটের ইজারা পেয়েছেন থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন সরকার, পোস্তগোলা শ্মশানঘাটের পাশের হাটের ইজারা পেয়েছেন শ্যামপুর থানা আওয়ামী লীগ নেতা মইন উদ্দিন চিশতি। অন্য হাটগুলোর চিত্র প্রায় একই। অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, দলীয় পদ ছাড়া যারা ইজারা পেয়েছেন, তাদের নেপথ্যে স্থানীয় সংসদ সদস্য, কাউন্সিলর ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের রয়েছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা।

No comments

Powered by Blogger.