আ’লীগে প্রার্থীর ভিড় বিএনপিতে তিন

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সিলেট-৩ আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা তৎপর হয়ে উঠছেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ৮ জনের নাম শোনা গেলেও বেশ কয়েকজন মাঠে নেমে পড়েছেন। তুলনামূলক বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকা ছোট, প্রার্থী হিসেবে তিনজনের নাম শোনা গেলেও মাঠে নেই কেউ-ই। দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা ছাড়াও বালাগঞ্জ উপজেলার তিন ইউনিয়নের সমন্বয়ে সিলেট-৩ আসন। বিভাগীয় সদর সিলেটের প্রবেশপথেই আসনটি। সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের সড়ক ও রেল যোগাযোগ এ আসনের ওপর দিয়েই। ফলে আন্দোলন-সংগ্রামে এ আসনের গুরুত্ব অনেক। সিলেট-৩ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী। এর আগের দফায় বিএনপির শফি আহমেদ চৌধুরীর কাছ থেকে আসনটি ছিনিয়ে নেন তিনি। এর আগে পরপর তিন টার্ম আসনটি জাতীয় পার্টির আবদুল মুকিত খানের দখলে ছিল। এবার সামাদ চৌধুরী এ আসন থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। এছাড়া আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। কয়েকজন প্রার্থী প্রকাশ্যেই বর্তমান এমপির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে চলছেন। তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় এমপি সামাদের বাবার কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলছেন। তারা বলছেন, যে আসনে বিপুল ভোটে নৌকা জয়লাভ করে, সে আসনের দুই উপজেলাতেই জামায়াতের লোক উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন কীভাবে? আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার দৌড়ে রয়েছেন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, দক্ষিণ সুরমা উপজেলা চেয়ারম্যান আবু জাহিদ, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক হাবিুবর রহমান। এছাড়াও এ আসনে দলের প্রার্থী হিসেবে শোনা যাচ্ছে সাবেক এমপি সৈয়দা জেবুন্নেছা হক, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট আবদুর রকিব মন্টু, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল বাছিত টুটুল ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সাধারণ সম্পাদক ফেঞ্চুগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের সাবেক ভিপি সাংবাদিক শাহ মুজিবুর রহমান জকনের নাম। যুক্তরাজ্য আ’লীগ নেতা হাবিব দীর্ঘদিন ধরে মাঠে রয়েছেন। দলের হাইকমান্ডের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় এলাকায় উন্নয়নমূলক বিভিন্ন কাজও করছেন তিনি। কথা হয় হাবিবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, এবার আমি আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চাইব। তৃণমূল নেতাকর্মীরা আমাকে প্রার্থী হিসেবে চাইছে। আসন্ন নির্বাচনের ভাবনা নিয়ে জানতে চাইলে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট আবদুর রকিব মন্টু যুগান্তরকে বলেন, আমাকে বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক করেছেন প্রধানমন্ত্রী। আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ও জাতীয় ক্রীড়াবিদ। গতবার মনোনয়ন চেয়েছিলাম। এবারও চাইব।
উপজেলা চেয়ারম্যান আবু জাহিদ যুগান্তরকে বলেন, ‘মাহমুদ উস সামাদ কখনোই আওয়ামী লীগের ছিলেন না। এক ভাই বিদেশে থাকেন। তিনি খালেদা জিয়ার ভক্ত। গত উপজেলা নির্বাচনে ফেঞ্চুগঞ্জ ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলায় জামায়াত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন বর্তমান এমপি। ভোটের বাজারে সামাদ ‘পচা মাছ’। তার জামায়াত-বিএনপিপ্রীতি শেখ হাসিনাও অবহিত।’ অভিযোগ অস্বীকার করে মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, অনেক কষ্টে আসনটি বিএনপির হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছি। আসনটি যাতে ফের বিএনপির হাতে চলে যায়, সে চেষ্টা করছেন আবদুর রকিব মন্টু, হাবিবুর রহমান হাবিব, আবু জাহিদরা। নির্বাচনের আগে আমার বাবা রাজাকার ছিলেন- এ অভিযোগ নিয়ে মাঠে নামেন তারা। তিনি জানান, তার পরিবারে কেউ রাজাকার ছিলেন না। বাবা স্থানীয় চেয়ারম্যান হিসেবে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি রাজাকার হলে বঙ্গবন্ধু তাকে রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান বানাতেন না। তিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন, যদি কেউ প্রমাণ করতে পারেন যে তার বাবা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন, তবে তিনি রাজনীতি ছেড়ে দেবেন। সিলেট-৩ আসনে শাসক দলে দ্বন্দ্ব, কোন্দল, উপকোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কোন্দল মেটাতে একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও তেমন কাজে আসেনি। দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ দু’ভাগে বিভক্ত। দক্ষিণ সুরমায় রয়েছে একাধিক গ্রুপ। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফুল ইসলাম, যুগ্ম সম্পাদক রাজ্জাক হোসেন ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা শাহ ছমির উদ্দিনের নেতৃত্বে কাজ করছে একটি গ্রুপ। এছাড়া হাবিবুর রহমান হাবিব, সাধারণ সম্পাদক রইছ আলী ও ইউপি চেয়ারম্যান ফখরুল ইসলাম সাইস্তার নেতৃত্বাধীন আরেকটি গ্রুপ সক্রিয়। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শাহ ছমির উদ্দিন জানান, যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করেন, তারা কখনও দলে কোনো গ্রুপ তৈরি করতে পারেন না। আগামী সংসদ নির্বাচনে যে প্রার্থীই নৌকা প্রতীক নিয়ে আসবেন, অবশ্যই তার পক্ষে মিলেমিশে সবাই কাজ করবেন। যারা কেন্দ্রের নির্দেশ মানবেন না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। দক্ষিণ সুরমা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক কোন্দল সম্পর্কে বলেন, যারা রাজনৈতিকভাবে হতাশায় নিমজ্জিত, বিকারগ্রস্ত ও ঋণগ্রস্ত তারাই উপগ্রুপ সৃষ্টি করছে। সময়ের ব্যবধানে এগুলো থাকবে না। কেন্দ্র থেকে যখন নির্দেশনা আসবে, তখন সবাই একযোগে শেখ হাসিনার নির্দেশে কাজ করবেন- এমনটি দাবি এই নেতার। সূত্র বলছে, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সম্পাদকের নাম ঘোষণার পর দুই বছর পার হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি আজও। দলীয় কোন্দলের জেরে জেলা আওয়ামী লীগ কমিটির অনুমোদন না দেয়ায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শওকত আলী ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল বাছিত টুটুলের নেতৃত্বে দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এখন বিভক্ত। সাধারণ সম্পাদক টুটুলের বলয়ে রয়েছেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমদ রাজা, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি এ আর সেলিম, সাবেক সহ-সাধারণ সম্পাদক শাহ মুজিবুর রহমান জকন, ফেঞ্চুগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি এবিএম কিবরিয়া ময়নুল, জিএস আবদুল মতিন। এ গ্রুপটি দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিছবাহ উদ্দিন সিরাজের অনুসারী বলে প্রচার রয়েছে। আওয়ামী লীগে হেভিওয়েট প্রার্থী থাকলেও বিএনপিতে সেটা এখনও দৃশ্যমান নয়। তবে আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণার পর বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা কিছুটা সক্রিয় হয়ে উঠছেন। বিএনপি ঘর গুছিয়ে মঠ গরম করতে চাইছে। দলের প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন সাবেক এমপি শফি আহমেদ চৌধুরী, যুবদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী ও কেন্দ্রীয় বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার এমএ সালাম। কোন্দলের কারণে যুবদল এবং ছাত্রদলও বিভক্ত। রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন না পাওয়া জামায়াত এ আসনের জয়-পরাজয়ে ফ্যাক্টর। স্বতন্ত্র বা অন্য ব্যানারে জামায়াত প্রার্থী দিতে পারে- এমন গুঞ্জনও রয়েছে। জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে নির্বাচনে অংশ নেবে, নাকি এককভাবে নির্বাচন করবে- এমন সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় জাপার স্থানীয় নেতাকর্মীরা। জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন জেলা জাতীয় পার্টির সদস্য সচিব উছমান আলী চেয়ারম্যান, মহানগর জাতীয় পার্টির নেতা অ্যাডভোকেট আবদুল হাই কাইয়ুম ও জেলার সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইশরাকুল হোসেন শামীম। এ ব্যাপারে জেলার সদস্য সচিব উছমান আলী বলেন, আমি গত নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলাম; কিন্তু জোটগতভাবে নির্বাচন হওয়ায় কেন্দ্রের নির্দেশে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে প্রত্যাহার করি। এবার দলের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.