পাঁচ নেতার ২৭ ক্যাডার

উত্তরবঙ্গের জেলা বগুড়ার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার হচ্ছে ক্যাডার বাহিনী। ক্ষমতাসীন দল ও অঙ্গসংগঠনের পাঁচ নেতা এদের নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করছেন। এই পাঁচ নেতার অন্তত ২৭ ক্যাডার দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বগুড়া। শাসক দলের নাম ব্যবহার করে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন এরা। কামাচ্ছেনও দু’হাতে। রাজনীতির বাইরে চাঁদাবাজি ও দখলবাজিতে ব্যবহার করা হচ্ছে এসব ক্যাডারকে। মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে পরিবহনে চাঁদাবাজি ও বালুর ব্যবসাসহ সবকিছুতেই ব্যবহার করা হচ্ছে ক্যাডার বাহিনী। তাছাড়া আধিপত্য বিস্তারেও এদের কদর অনেক বেশি। এই সুযোগে ক্যাডাররা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। নেতাদের অজান্তেও ঘটছে অনেক অঘটন। এসব ক্যাডারের মধ্যে হত্যা মামলার আসামিও রয়েছে। এসব ক্যাডার নিজেদের শক্তিমত্তা বাড়াতে দলে ভেড়াচ্ছে নিজেদের পছন্দমতো শতাধিক ক্যাডার। দিন যত যাচ্ছে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে এসব ক্যাডার। জেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে ক্যাডার নিয়ন্ত্রণে শীর্ষে রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম মোহন। শুধু ক্যাডার নিয়ন্ত্রণই নয়, ক্যাডার তৈরিতেও তার অবস্থান শীর্ষে। যুবলীগের নাম ব্যবহার করে যেসব ক্যাডার বগুড়ার রাজনীতির মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন তাদের অধিকাংশই তার নিয়ন্ত্রণে। তিনি দীর্ঘদিন জেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। অপরদিকে পরিবহন খাতের চাঁদাবাজি, দখলবাজি, মাদক কেনাবেচা, হাটবাজারের ইজারা, বালুর ব্যবসাসহ বগুড়ার অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছেন সাময়িক বহিষ্কৃত শহর যুবলীগের যুগ্ম-সম্পাদক মতিন সরকার, জেলা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দিন শেখ হেলাল ও শহর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক আবদুল মান্নান। এই তিন নেতাই তাদের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য ক্যাডার বাহিনী লালন-পালন করছেন। ক্যাডারদের ব্যবহার করেই তারা বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছেন। বগুড়া শহরজুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এই ক্যাডার বাহিনী। এরা প্রায়ই দলবেঁধে চলাফেরা করেন। তবে এই তিন নেতা নিজেরাও ক্যাডার হিসেবে পরিচিত। বগুড়ার ক্যাডার নিয়ন্ত্রণে পঞ্চম নেতা হচ্ছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আসাদুর রহমান দুলু। তার ক্যাডাররা শাজাহানপুর এলাকার নিয়ন্ত্রণসহ সেখানকার চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন। আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, বগুড়ার ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি দুটি ধারায় বিভক্ত। এর মধ্যে একটি ধারা নিয়ন্ত্রণ করছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন। অপর অংশটির নিয়ন্ত্রণ করছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম মোহন। তার নিয়ন্ত্রণে বিশাল ক্যাডার বাহিনী থাকলেও মমতাজ উদ্দিনের আশীর্বাদ রয়েছে আসাদুর রহমান দুুলু, মতিন সরকার, হেলাল এবং মান্নানের ওপর। যুগান্তরের সঙ্গে একান্ত আলাপকালে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন বলেন, দলে আমি কখনই সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিই না। বগুড়া একটি নেভেটিভ জোন। এখানে আমি দীর্ঘদিন ধরে দলকে এগিয়ে নিয়ে গেছি। আমার বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো অভিযোগও নেই। তিনি অভিযোগ করেন, মোহনের নেতৃত্বে জেলা যুবলীগ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে। এসব কারণে নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্বে গত ৮ বছরে ৩৬ জন খুন হয়েছে। কথা হয় জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম মোহনের সঙ্গে। তিনি শুক্রবার মোবাইল ফোনে যুগান্তরকে বলেন, আমার নামে কোনো চাঁদাবাজির মামলা নেই। আমি কোনো সন্ত্রাসীকে প্রশ্রয় দিই না। কে সন্ত্রাসী হচ্ছে, কারা বানাচ্ছে আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখেন। জেলা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দিন শেখ হেলাল শনিবার যুগান্তরকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে এগুলো অবান্তর। শহর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আবদুল মান্নান মোবাইল ফোনে যুগান্তরকে বলেন, দলের ছত্রছায়ায় কোনো কিছু করিনি। মতিন সরকারের সব কর্মকাণ্ডের দায়ভার নেব। তবে তার ভাই তুফানের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। আমার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ বগুড়ার কেউ বলতে পারবে না। মতিন সরকার একটি খুনের মামলায় পলাতক থাকায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুর রহমান দুলুর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতা মঞ্জুরুল আলম মোহনের ক্যাডার হিসেবে কাজ করছেন ৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. ইব্রাহীম। চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ছিলেন। যুবলীগ নেতা শেখও মোহনের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত। তিনি সিএনজি-অটোরিকশার চাঁদা নিয়ন্ত্রণ করেন। তার বিরুদ্ধে আপন ভাতিজা কসবো হত্যার অভিযোগ ঝুলছে। সুজানুর রহমান সুজন হত্যা মামলার আসামি মোস্তাকিম রহমান মোহনের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত। এছাড়া ঝন্টু, নান্টু, নাদিম, নাসির, রিপন ও গোলাম মোস্তফাও মোহনের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত। এদিকে ‘তুফান বাহিনী’র মতো মোহনের ঘনিষ্ঠ ক্যাডার ওমর খৈয়াম রূপমের একটি বাহিনী রয়েছে। স্থানীয়ভাবে সেটা ‘রুপম বাহিনী’ হিসেবে পরিচিত। অভিযোগ রয়েছে, ২০১০ সালে বালু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়ে ‘রুপম বাহিনী’র হাতেই খুন হন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন জুয়েল। মোহনের হাত ধরেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি ব্যাপক আলোচিত শহর যুবলীগের সাময়িক বহিষ্কৃত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মতিন সরকারের। এক সময় তিনি ক্যাডার থাকলেও এখন তিনি নিজেই একটি ক্যাডার বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছেন। একটি হত্যা মামলায় তিনি এখন পলাতক। তার সঙ্গে রয়েছেন জেলা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দিন শেখ হেলাল ও শহর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক সদস্য আবদুল মান্নান। এই তিন নেতার ক্যাডার হিসেবে কাজ করছেন জামিলুর রহমান শুভ ও সুইপার সোহেল। এর বাইরে মতিনের চার ভাই তুফান সরকার, ঝুমুর সরকার, সোহাগ সরকার ও পুটু সরকারও ক্যাডার হিসেবে পরিচিত। বগুড়া শহর জুড়েই ‘তুফান বাহিনী’র ভীতি রয়েছে। এর মধ্যে সম্প্রতি কিশোরী ছাত্রী ধর্ষণ মামলায় মূল হোতা হিসেবে তুফান এখন জেলহাজতে। এসব করেই তুফান এখন কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। বালু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে মতিন সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ক্যাডার লতিফুল করিমও একটি বাহিনী গড়ে তুলেছেন। তিনিও এক সময় মোহনের ক্যাডার ছিলেন। জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আসাদুর রহমান দুুলুর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী মিনকো ও মিস্টার। তারা দু’জনেই হত্যা মামলার আসামি। এদিকে শাহীন বাহিনীর লিখন, ফোরকান, ফয়সাল, ফুহাদ, আবু হানিফ, আলমগীর হোসেন, শহীদুল ও শরিফুল তার ক্যাডার হিসেবে পরিচিত। বালু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে ভয়ঙ্কর দুই ক্যাডারের বাহিনী : বগুড়ার করতোয়া নদীর বালু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রুপম বাহিনীর সঙ্গে লতিফুল করিম বাহিনীর খুনোখুনি লেগেই আছে। বালু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য নিয়ে করিমের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি। এ নিয়ে সাত বছরে বগুড়ায় তিনজন খুন হয়েছেন। ২০১০ সালের ৫ জুন রাতে বগুড়া শহরের শিববাটি সেবক সমিতির কার্যালয়ে শহর স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন জুয়েলকে গুলি ও রামদা দিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয়। এ মামলার অন্যতম আসামি ক্যাডার রূপম। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে খুন হন বালু ব্যবসায়ী শাহীন প্রামাণিক। বগুড়ার নারুলির ভাটকান্টি সেতুর কাছে তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। গত এপ্রিলে বগুড়া শহরতলির নিশিন্দারা মণ্ডলপাড়ায় হজরত আলী মণ্ডল নামে এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। বগুড়ায় ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতির ইতিহাস : স্বাধীনতার পর মোহাম্মদ শোকরানার মাধ্যমে বগুড়ায় সন্ত্রাসের হাতে খড়ি। তিনি তখন যুবলীগের নেতা। একের পর এক খুনের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। তার একটি টর্চার সেলও ছিল। জাসদের হাতে তার ভাই খুন হলে তিনি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন বলে অভিযোগ। একটি হত্যা মামলায় তার যাবজ্জীবন সাজাও হয়েছিল। ১৯৮১ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার তাকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। পরে তিনি জাতীয় পার্টি হয়ে ১৯৯৮ সালে বিএনপিতে যোগ দেন। কথা হয় মোহাম্মদ শোকরানার সঙ্গে। তিনি যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে জানান, এগুলো বাজে কথা। আমার যদি টর্চার সেল থাকে এটা কেউ খুঁজে বের করুক। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯১-১৯৯৫ সালে বগুড়ার ত্রাস ছিলেন ওই সময়ের ছাত্রদল নেতা হিরু ও সন্ত্রাসী মিল্টন। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রথম মেয়াদে বগুড়ায় মজনু ইব্রাহীম, পৌষ, লক্ষ্মণ, মাসুম ও শাহিন দাপিয়ে বেড়িয়েছে। মাসুম, শাহিন ও মজনু এরই মধ্যে খুন হয়েছেন। ২০০১ সালে চারদলীয় সরকারের সময়ে বগুড়ায় দাপিয়ে বেড়িয়েছে আতাউর রহমান শম্ভু, সরকার মুকুল ও তাদের লোকজন।

No comments

Powered by Blogger.