বিচারপতি নিয়োগে দলীয় সমর্থকদের অগ্রাধিকার

স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য বিচারপতি নিয়োগে নিরপেক্ষতা, সততা ও যোগ্যতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এটা আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের স্বার্থেই দরকার। এখন নির্বাহী বিভাগ বিচারপতি বাছাই করে বলে সৎ, দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিরা নিয়োগ পান না, স্থান পান দলীয় সমর্থকরা। তাই বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলা বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে এসব কথা বলা হয়েছে। ১ আগস্ট প্রকাশিত রায়ে বিচারপতিদের জন্য ৩৯ দফা আচরণবিধিও বেঁধে দেয়া হয়েছে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা রায়ে লিখেছেন, বিচারপতিদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে কয়েকটি দেশে আচরণবিধি রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিচারপতিরা নিজেরাই এটা তৈরি করেছেন আবার কোথাও সরকার আচরণবিধি তৈরি করে দিয়েছে। তিনি লিখেছেন, বিচারপতির আচরণ নিয়ে ব্যাঙ্গালোর নীতিতে বলা হয়েছে, স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা, নিষ্ঠা, সমতা, যোগ্যতা, সভ্য-ভব্যতা ও অধ্যবসায়ের মতো মূল্যবোধ থাকতে হবে । বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার লিখেছেন, নিরপেক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। এটা আইনের শাসনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অন্যথায় বিচারের ওপর জনগণ আস্থা হারাবে। স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারপতি নিয়োগ করতে হবে।
এজন্য ঘোষিত নীতি থাকতে হবে এবং কোনো ধরনের বৈষম্য ছাড়াই মেধার ভিত্তিতে সবার জন্য সমান সুযোগ থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে বিচারপতিরা যেন কোনো মহলের বাধা, অযাচিত প্রভাব, প্রলোভন, চাপ, হুমকি ও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হস্তক্ষেপ ছাড়া স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন। বিচারপতিদের নিরপেক্ষভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার বাধাহীন ক্ষমতা থাকতে হবে। যেখানে নিজের বিবেক ও বিদ্যমান আইনই মুখ্য হবে। তিনি লিখেছেন, অন্যান্য দেশে কোনো ব্যক্তিকে উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগের আগে স্বচ্ছতা, সমান সুযোগ, সততা, নৈতিক মূল্যবোধ এবং মেধার বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করা হয়। যারা সংবিধান ও জনগণের অধিকার রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন তাদেরকেই নিয়োগ দেয়া হয়। স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দেশে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করেই বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়। আগেকার দিনে প্রধান বিচারপতি তার সহকর্মী ও সিনিয়র বিচারপতিদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন যে কাকে হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ দেয়া যায়। এরপর সেটি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হতো। কিন্তু এখন আর সেই ব্যবস্থাও বিদ্যমান নেই। এখন নির্বাহী বিভাগ একটি তালিকা তৈরি করে নিয়মরক্ষার জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠান। মনে হতে পারে যে প্রধান বিচারপতির কার্যালয় একটি পোস্ট বক্স। বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার লিখেছেন, এই প্রক্রিয়ায় উচ্চ আদালতের বিচারপতি হিসেবে যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া কঠিন। কারণ নির্বাহী ও আইন বিভাগ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে গঠিত। আইন বিষয়ে গভীর জ্ঞানসম্পন্ন লোক বাছাই করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে উল্টো যোগ্য আইনজীবীর পরিবর্তে রাজনৈতিক সংযোগ আছে এমন ব্যক্তিরা অগ্রাধিকার পান। যদি আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ কঠোর পরিশ্রমী আইনজীবী, নিষ্ঠাবান ও সাহসী ব্যক্তিদের বিচারপতি পদে নিয়োগ দেয়া না হয় তবে বিচারপতিদের মান অবধারিতভাবেই অধোগামী হয়ে যাবে। স্বাধীন বিচার বিভাগ চাইলে বিচারপতি নিয়োগে মান, নিরপেক্ষতা, সততা ও যোগ্যতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এটা আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের স্বার্থেই দরকার। বলা হয় যে ন্যায়বিচার শুধু করলেই হবে না, বরং এটা যে করা হয়েছে তা যেন দেখা যায়। তার মত হচ্ছে- ধর্ম, লিঙ্গ, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নির্বিশেষে সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থীদের মধ্য থেকে বিচারপতি নিয়োগ দিতে হবে। তিনি লিখেছেন, সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব শর্ত দেয়া হয়েছে সেগুলো হল তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। তাকে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি হিসেবে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা অথবা বাংলাদেশের বিচার বিভাগীয় পদে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা এবং জেলা বিচারকের পদে তিন বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার এসবের সঙ্গে বাড়তি কিছু যোগ্যতা যোগ করেছেন। তিনি লিখেছেন, আইন সম্পর্কে অভিজ্ঞ ও পরিপক্ব, সৎ ও মূল্যবোধ সম্পন্ন, আইন ও ভাষা সম্পর্কে দক্ষ, ন্যায়বিচার করার মত অঙ্গীকার ও সাহস আছে এমন ব্যক্তিদের বিচারপতি নিয়োগ দিতে হবে। এভাবে নিয়োগ দেয়া হলে সেই বিচারপতির বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিচার কিংবা তাকে অপসারণের প্রয়োজন হবে কদাচিৎ।
বিচারপতিদের আচরণবিধি
ষোড়শ সংশোধনী মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারপতিদের জন্য ৩৯ দফা আচরণবিধি প্রকাশ করা হয়েছে। নিন্মে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিধি প্রকাশ করা হল :
বিচারপতিদের আচরণ হতে হবে উঁচু মানের, যাতে বিচার বিভাগের সততা ও স্বাধীনতা রক্ষা করা যায়। বিচারপতিদের সংবিধান ও আইনের প্রতি সম্মান থাকতে হবে এবং একে মেনে চলতে হবে। তাদের সব সময় এমনভাবে কাজ করতে হবে, যাতে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পায়। আচরণিবিধিতে বলা হয়েছে, বিচারের ক্ষেত্রে পরিবারিক, সামাজিক ও অন্যান্য সম্পর্ক দ্বারা কোনো বিচারপতি যেন প্রভাবিত না হন। দলীয় স্বার্থ, জনগণের বিক্ষোভ কিংবা সমালোচনার ভয় যেন বিচারপতিদের প্রভাবিত না করে। বিচারপতিকে হতে হবে ধৈর্যশীল, মর্যাদাসম্পন্ন ও সাহসী। আচরণিবিধিতে বলা হয়েছে, রায় ঘোষণার ছয় মাসের মধ্যে বিচারপতিকে পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্বাক্ষর করতে হবে। কোনো মামলায় বিচারপতির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তার সে মামলা থেকে সরে যেতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর কিংবা সন্তানের অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত আছে এমন মামলার শুনানি থেকে তাকে বিরত থাকতে হবে। আচরণিবিধিতে বলা হয়েছে, বিচারপতি প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে নিজে কিংবা অন্য কারও সঙ্গে মিলে কোনো ব্যবসায়ে জড়িত হতে পারবেন না। দেশে কিংবা বিদেশে রাজনৈতিক কার্যকলাপে জড়াতে পারবেন না বিচারপতিরা।
আচরণিবিধিতে বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতি চাইলে যে কোনো বিচারপতি তার সম্পদ ও দায়ের হিসাব প্রকাশ করবেন। বিচারপতিরা আইনজীবী সমিতির কোনো সদস্যের (আইনজীবীর) সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতে পারবেন না। বিচারপতির পরিবারের কোনো সদস্য বারের সদস্য হলে তিনি বিচারপতির বাসভবনে থাকতে পারবেন না। বিচারপতিরা রাজনৈতিক বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো বিতর্কে জড়াবেন না, গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেবেন না। বিচারপতিকে যথাসময়ে আদালতে আসন গ্রহণ এবং আসন ত্যাগ করতে হবে। এটা করা না হলে সেটা তার অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে এবং এজন্য আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আচরণবিধিতে বলা হয়েছে, কোনো বিচারপতির অসদাচরণের ব্যাপারে প্রধান বিচারপতি অভিযোগ পেলে আপিল বিভাগের সবচেয়ে সিনিয়র দু’জন বিচারপতিকে নিয়ে প্রধান বিচারপতি বিষয়টি তদন্ত করবেন। প্রাথমিক তদন্তে এ বিষয়ে অভিযোগের সত্যতা মিললে প্রধান বিচারপতি বিষয়টি রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করবেন। স্বচ্ছতা ও দ্রুততার সঙ্গে অভিযোগের তদন্ত হবে এবং অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হবে। বিচার বিভাগের মান অনুযায়ী অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.