বাচ্চু ও পরিচালনা পর্ষদকে বাদ দিয়ে ৫ মামলার প্রতিবেদন

বেসিক ব্যাংকের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় দায়ের করা ৫৬টি মামলার মধ্যে ৫টিতে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু ও পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের বাদ দিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। দাখিল করা প্রতিবেদনগুলো শিগগির দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) উপস্থাপন করা হবে। কমিশন অনুমোদন করলে তা আদালতে দাখিল করা হবে। বাকি ৫১ মামলার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। জানা গেছে, প্রতিবেদনগুলো প্রাথমিকভাবে বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত বিভাগ-১-এ দাখিল করা হয়েছে। এসব মামলায় বেসিক ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ফখরুল ইসলাম ও ব্যাংকের ডিএসডিসহ সাবেক ১১ কর্মকর্তা এবং ঋণগ্রহীতা ৫টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ১৬ জনসহ ২৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। ৫ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা ঋণের নামে লোপাটের অভিযোগ আনা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে। দুদক সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনায় ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ১২০ জনের বিরুদ্ধে ৫৬টি মামলা করে দুদক। এসব মামলায় অভিযোগ করা হয়, ঋণের নামে ব্যাংক থেকে অন্তত আড়াই হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই ঋণ অনিয়মের সঙ্গে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু ও তার নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদের জড়িত থাকার বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক এমনকি বেসিক ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্তে বেরিয়ে এলেও তাদের বাদ দিয়ে দুদক সে সময় মামলা করে সমালোচনার মুখে পড়ে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও বলেছিলেন, ’ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ দায় এড়াতে পারে না। দুদক তদন্ত করছে। অপেক্ষা করুণ- তারা কি করে তা দেখার জন্য।’ সেই অপেক্ষার প্রথম ধাপে দেখা যাচ্ছে, ৫ মামলার প্রস্তাবিত চার্জশিটে শেখ আবদুল হাই বাচ্চু বা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কারও নাম নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল বলেন, ‘ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোর মধ্যে ৫টিতে ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে জড়িত থাকার অভিযোগ এখনও প্রমাণিত হয়নি। বাকি ৫১ মামলার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। সেগুলো শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর কে আসামি হবেন বা হবেন না সে বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না।’ দুদক আইন ও বিধি অনুযায়ী, কোনো দুর্নীতির ঘটনা অনুসন্ধানকালে বা মামলা দায়েরের আগে দুর্নীতিতে জড়িত সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে তার বা তার প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আর যদি কাউকে চার্জশিটভুক্ত আসামি করা হয় তবে তাকে তদন্তকালে জিজ্ঞাসাবাদ করার বিধান রয়েছে। বেসিক ব্যাংকের অর্থ লোপাটের ঘটনায় মামলা দায়েরের আগে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান বা পর্ষদের কাউকে ডেকে এনে যেমন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি তেমনি তদন্তকালেও তাদের জিজ্ঞাসাবাদের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যদিও আবদুল হাই বাচ্চু ও পরিচালনা পর্ষদকে আইনের আওতায় আনার জন্য দুদককে নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত ২৬ জুলাই ৪০ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির একটি মামলায় এক আসামির জামিন আবেদনের বিরুদ্ধে করা দুদকের রিভিশন আবেদন খারিজ করে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের বেঞ্চ ওই আদেশ দেন। আদালতে দুদকের পক্ষে আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব বলেন, ‘২০১০ সালের ২ নভেম্বর ক্রেডিট কমিটির সুপারিশ উপেক্ষা করে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদ সৈয়দ ট্রেডার্সের ম্যানেজিং পার্টনার সৈয়দ মাহবুবুল গণিকে ৪০ কোটি টাকা ঋণের অনুমোদন দেয়। ব্যাংকের শান্তিনগর শাখা থেকে এ ঋণ দেয়া হয়। যারা ঋণ অনুমোদন দিয়েছেন তাদের কাউকেই এ মামলায় আসামি করা হয়নি। তাই বেসিক ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদের সব সদস্যকে আইনের আওতায় এনে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দিতে বলেছেন আদালত।’ আইনজীবীরা বলেছেন, ‘আদালতের এ আদেশ বেসিক ব্যাংক অর্থ জালিয়াতি সব মামলার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য এবং সব মামলার ক্ষেত্রেই সাবেক চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদের অপরাধ নির্ণয় করার বিষয়ে কাজ করবে দুদক। কিন্তু ৫৬ মামলার মধ্যে ৫ মামলায় সেরকম ঘটেনি। অথচ আবদুল হাই বাচ্চু বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় ২০০৯-১২ সালের মধ্যে ব্যাংকটির দিলকুশা, গুলশান ও শান্তিনগর শাখা থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা উত্তোলন ও আত্মসাতের ঘটনা ঘটে।’ দুদকের প্রধান আইন কর্মকর্তা খুরশিদ আলম খান যুগান্তরকে বলেন, কমিশনকে আদালতের অর্ডার (আদেশ) মান্য করতে হবে। আমি আদালতের অর্ডারের বিষয়টি কমিশনকে জানিয়েছি। প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তাদের মতামত : প্রতিবেদনে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে পরিচালনা বোর্ডের ভূমিকা কি ছিল, তা তুলে ধরা হয়েছে বলে জানা গেছে। বেসিক ব্যাংকের গুলশান, শান্তিনগর ও মতিঝিল শাখা থেকে ঋণের নেতিবাচক প্রস্তাব ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের ক্রেডিট কমিটিতে পাঠালে ওই কমিটিও তা নেতিবাচক হিসেবে বোর্ডে উপস্থাপন করে। ৫ জন তদন্ত কর্মকর্তাই তাদের দাখিল করা প্রতিবেদনে বেসিক ব্যাংকের অর্থ লোপাটের জন্য সংশ্লিষ্ট শাখা ও ব্যাংকের এমডিসহ ক্রেডিট কমিটিকে দায়ী করেছেন। তারা বলেছেন, যেসব কোম্পানিকে জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ দেয়া হয়েছে তাদের ব্যাপারে ‘নেতিবাচক প্রস্তাব’সহ ঋণের সুপারিশ করা হয় প্রধান কার্যালয়ে। শাখা থেকে নেতিবাচক প্রস্তাব ছাড়াও শর্তসাপেক্ষে ঋণ মঞ্জুরের পক্ষে সুপারিশ করা হয়। কিন্তু পরিচালনা পর্ষদের হস্তক্ষেপের কারণে ওইসব শর্ত পূরণ না করেই তাদের ঋণ মঞ্জুর করা হয়। বেসিক ব্যাংক প্রধান কার্যালয় ক্রেডিট কমিটি ইচ্ছা করলে সংশ্লিষ্ট শাখায় প্রস্তাবগুলো সংশোধনের জন্য পাঠাতে পারত। কিন্তু তা করা হয়নি। নেতিবাচক ধারণার পরও পর্ষদ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দিয়েছে। যেসব ব্যাংক কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে : দুদকের উপপরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিম, ঋত্তিক সাহা, মো. শামসুল আলম, মাহবুবুল আলম ও উপসহকারী পরিচালক মো. জয়নাল আবেদীন পৃথকভাবে ৫ মামলার তদন্ত শেষ করে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিটের সুপারিশ করে তদন্ত প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট শাখায় জমা দেন। এসব মামলায় ব্যাংকের সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলামসহ ১১ জন কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়। কাজী ফখরুলসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা সব মামলারই আসামি। যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চার্জশিটের সুপারিশ করা হয়েছে তারা হলেন : বেসিক ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি ও ক্রেডিট ও ঋণ ডিজভার্সমেন্ট কমিটির সভাপতি ফজলুস সোবহান, ব্যাংকের সাবেক জিএম (ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট ডিভিশন) খন্দকার শামীম হাসান, সাবেক জিএম গোলাম ফারুক খান, ডিজিএম (গুলশান শাখা) শিপার আহমেদ, গুলশান শাখার সাবেক ক্রেডিট ইনচার্জ জাহিদ হাসান, প্রধান কার্যালয়ের ডিজিএম মোনায়েম খান, মো. সেলিম, জয়নাল আবেদীন চৌধুরী ও এজিএম জহির উদ্দিন। যে ৫ প্রতিষ্ঠানকে আসামি করা হয়েছে : ৫ মামলার মধ্যে ৪৫ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় মেসার্স সিনটেক্সের স্বত্বাধিকারী হাসিবুজ্জামানসহ ৬ জনকে আসামি করার সুপারিশ করা হয়। এ মামলায় ব্যাংকের সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলামসহ তিনজন ব্যাংক কর্মকর্তা ও দু’জন সার্ভেয়ারকে আসামি করা হয়। ব্যাংক থেকে ঋণ মঞ্জুরের আগে কর্তৃপক্ষ কোনো নিরপেক্ষ সার্ভেয়ার প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে ঋণ নিতে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের জমিজমা, ব্যবসা শিল্প প্রভৃতি সার্ভে করিয়ে নেয়। তাদের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে ঋণ মঞ্জুর করে ব্যাংক। কিন্তু সার্ভে প্রতিষ্ঠানগুলো বেসিক ব্যাংকের ঋণ মঞ্জুরের ক্ষেত্রে ভুল তথ্য দেয় বলে জানা গেছে। এ কারণে তাদেরও আসামি করা হয়। সিনটেক্স লিমিটেডের মামলায় এসডি সার্ভে নামক প্রতিষ্ঠানের প্রধান সার্ভেয়ার মো. ফারুক ও ইকবাল হোসেন চৌধুরীকে আসামি করা হয়। ১৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ঋণ জালিয়াতির মামলায় মেসার্স এমারেল ড্রেসেস লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের এমডি মো. এনামুল হক খান, চেয়ারম্যান সয়দ হাসিবুল গনি গালিব ও পরিচালক আনোয়ার হোসেন খোকনসহ ৯ জনকে আসামি করার সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে ব্যাংকের সাবেক এমডি ও কর্মকর্তা রয়েছেন ৫ জন। এ ছাড়া ইকবাল হোসেন ভুঁইয়া নামে একজন সার্ভেয়ারকেও আসামি করা হয়। মেসার্স সৈয়দ রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ১১ কোটি ৩৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়। সুপারিশে ব্যাংকের সাবেক এমডিসহ ৫ জন ব্যাংক কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়। এ ছাড়া ওই প্রতিষ্ঠানের এমডি সৈয়দ হামদুজ্জামান বাবলু, পিএসআর সার্ভে অ্যান্ড ইন্সপেকশন লিমিটেডের চিফ সার্ভেয়ার জসিম উদ্দিন চৌধুরী, এসডি সার্ভে ফার্মের মো. ফারুক ও ইকবাল হোসেন ভুঁইয়াকে আসামি করার সুপারিশ করা হয়। রিলায়েন্স শিপিং লিমিটেডের ১৬ কোটি ১২ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলায় প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী আসিফ ইকবালসহ ৮ জনকে আসামি করার সুপারিশ করা হয়। এতে ব্যাংকের সাবেক এমডিসহ ৬ জন কর্মকর্তা ও সিরাজুল ইসলাম নামে একজন সার্ভেয়ারকে (ইউনিক সার্ভে) আসামি করার প্রস্তাব করেন তদন্ত কর্মকর্তা। অন্যদিকে ৭৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মেসার্স ফারশি ইন্টারন্যাশনালের এমডি ফয়জুন নবী চৌধুরী ও চেয়ারম্যান জেসমিন নবী চৌধুরীসহ ৯ জনকে আসামি করার প্রস্তাব করেন তদন্ত কর্মকর্তা। এতে ব্যাংকের সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলামসহ ৬ জনকে আসামি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া সার্ভেয়ার জহিরুল ইসলামকেও আসামি করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.