ষোড়শ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায় : গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য। কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ ও পক্ষপাত ছাড়া নিরপেক্ষভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে না পারলে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া গ্রহণযোগ্য সংসদ গঠিত হতে পারে না। আর এ কারণে আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থা এবং সংসদ শিশু অবস্থায় রয়ে গেছে। জনগণ নির্বাচন কমিশন ও সংসদের প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না। এ দুইটি প্রতিষ্ঠানকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে যতদিন পর্যন্ত জনগণের আস্থা ও সম্মানের জায়গায় না আনা যাবে ততদিন গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে না। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায়ে তিনি এ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। মোট ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় গত ১ আগস্ট প্রকাশিত হয়েছে। রায়ে প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচন ছাড়া জ্ঞানী-গুণীদের মাধ্যমে সংসদ গঠিত হতে পারে না। আর এ কারণেই সংসদকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা যাচ্ছে না। সংসদকে পরিপক্ব না করে সংসদের হাতে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা দেয়া হলে সেটা হবে আত্মঘাতী। তিনি বলেন, বিচার বিভাগের জবাবদিহিতা সংসদের কাছে রাখা উচিত নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর বরং উচিত সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া। বাস্তবে দেখা গেছে, যেসব দেশে গণতন্ত্র বিকশিত হয়েছে, নির্বাচন প্রক্রিয়া সঠিকভাবে কাজ করছে এবং সংসদ সদস্যরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হচ্ছেন, সেসব দেশও সংসদের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারছে না। বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা রায়ে লিখেছেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে নিচের বিষয়গুলো থাকা অপরিহার্য : (ক) বিশুদ্ধ নির্বাচন, (খ) শাসনকার্যে সততা, ব্যক্তিগত মর্যাদার বিশুদ্ধতা, (ঘ) অলঙ্ঘনীয় আইনের শাসন, (ঙ) স্বাধীন বিচার বিভাগ (চ) দক্ষ ও গ্রহণযোগ্য আমলাতন্ত্র, (ছ) গ্রহণযোগ্য বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, সংসদ ও আমলাতন্ত্র এবং (জ) এসব প্রতিষ্ঠান যারা পরিচালনা করবেন তাদের সংহতি ও সম্মান। রায়ে তিনি বলেছেন, হাইকোর্টে ষোড়শ সংশোধনীর বাতিল হওয়ার পর এ বিষয়ে সংসদে যে ধরনের সমালোচনা হয়েছে এবং যেসব অসংসদীয় ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তাতে এটা প্রমাণ করে যে, আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্র অপরিপক্ব। সংসদীয় গণতন্ত্র পরিপক্বতা অর্জনের জন্য কমপক্ষে চার থেকে পাঁচ মেয়াদ টানা সংসদীয় গণতন্ত্র চালু থাকা অপরিহার্য। পণ্ডিত রাজেন্দ প্রসাদ ভারতে সংবিধান প্রণয়নের সমাবেশে যে বক্তব্য দেন তা উদ্ধৃত করেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তার রায়ে। রাজেন্দ্র প্রসাদ বলেছিলেন, সংবিধান যেমনই হোক দেশের কল্যাণ নির্ভর করে কারা কিভাবে দেশ পরিচালনা করছেন তার ওপর। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যদি দক্ষ, সৎ ও চরিত্রবান হন তাহলে সংবিধান ত্রুটিপূর্ণ হলেও তারাই সবচেয়ে ভালো কল্যাণ রাষ্ট্র তৈরি করতে পারবেন। কিন্তু নির্বাচিত প্রতিনিধিদের যদি সততা, দক্ষতা ও চরিত্রের ঘাটতি থাকে তাহলে সংবিধান দেশকে কোনো সাহায্য করতে পারে না। সংবিধান হলো প্রাণহীন একটি যন্ত্রের মতো। এটা প্রাণ পায় কারা এটা নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করছে তাদের ওপর নির্ভর করে। এরপর প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, আইন প্রণয়নের মাধ্যমে একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনে জনপ্রতিনিধিদের গুণের কথা বলা হয়েছে এখানে। জনপ্রতিনিধিদের অবশ্যই হতে হবে সৎ ও চরিত্রবান। তাই আইন ত্রুটিপূর্ণ হলেও জনপ্রতিনিধিরা যদি এসব গুণসম্পন্ন হন তাহলে সংসদীয় গণতন্ত্র ধাপে ধাপে একটি ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে। আর এমন একটি দেশের জন্যই লাখ লাখ মানুষ লড়াই করেছিল যেখানে থাকবে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন। এ বিশ্বাস পুনরুদ্ধার করতে হবে, অন্যথায় স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে। সুরেন্দ্র কুমার সিনহা লিখেছেন, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত দেশে কোনো গণতন্ত্র ছিল না। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর দেশে মাত্র সাড়ে তিন বছর গণতান্ত্রিক সরকার ছিল। এরপর দেশ ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি হলো। দুই কন্যা বাদে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মম হত্যা করা হলো। দেশ আবার বন্দুকধারী আর জেনারেলদের হাতে গেল। মার্শাল লয়ের মাধ্যমে এক ভয়ার্ত অধ্যায়ের যাত্রা শুরু হলো এবং চলল ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। অনেক ত্যাগ, লড়াই এবং শেষে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক জান্তা বিদায় হওয়ার পর দেশ আবার ১৯৯০ সাল থেকে চলতে লাগল তার স্বাভাবিক সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে। কিন্তু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতি তখনকার সরকারের উদাসীনতার কারণে সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি সঠিকভাবে কাজ করতে পারল না। ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি এবং সংসদ দুই মাসেরও বেশি টেকেনি। প্রবল আন্দোলনের মুখে সরকার সংবিধান সংশোধন করতে বাধ্য হলো। দেশে একটি অবাধ ও নিরপক্ষে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় নিরপক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলো। কিন্তু এটাও বেশি দিন চলল না এর মাঝে কিছু অনিরাময়যোগ্য ত্রুটি থাকার কারণে। আবার দেশ চলে গেল দুই বছরের জন্য সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন জরুরি শাসনের কবলে। তখনকার ক্ষমতাসীন নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে তাদের উদাসীনতা এ জন্য দায়ী। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলো। একবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এক সেনাপ্রধান অভ্যুত্থান চেষ্টা চালালেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি বরখাস্ত হলেন। শেষ পর্যন্ত ত্রয়োদশ সংশোধনী (অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা) হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হলো। তখন সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আদালত এ মত দিলো যে, অন্তত আরো দুই বার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করা যাবে। তবে শর্ত হলো সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি অথবা আপিল বিভাগ থেকে সর্বশেষ অবসরে যাওয়া কোনো বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করা যাবে না। আদালত এ নির্দেশনা দিয়েছিল এ বিষয়টি মনে রেখে যে, এ পদ্ধতির কারণে প্রধান বিচারপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজনীতিকরণ করা হতে পারে। তাই এটি বন্ধ করে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী এবং প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করতে হবে যাতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সব সময় নিরপেক্ষভাবে হতে পারে। এ আদালত লক্ষ করেছে যে, প্রতিটি সংসদ নির্বাচনের পর পরাজিত দল নির্বাচনে পক্ষপাতের অভিযোগ এনেছে এবং সংসদ কার্যকর করার ক্ষেত্রে তারা বিরোধী দল হিসেবে সহযোগিতা করেনি। শেষ পর্যন্ত দশম সংসদ নির্বাচনে বড় একটি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেনি। প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, আদালত মনে করে অবাধ ও নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকার সর্বশক্তি দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করবে। আর এর ফল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের শূন্য পদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে পূরণ হবে সরকারের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ ছাড়া। কিন্তু কোনো সরকারই নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালীকরণের কাজ করেনি। এমনকি নির্বাচন কমিশনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য বিরোধী দলও সংসদে বা সংসদের বাইরে এ বিষয়ে কোনো জোরাল ভূমিকা পালন করেনি। প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকলে বিচারপতিরা দলের হাইকমান্ডের করুণার পাত্রে পরিণত হবে। ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ে সংসদ সম্পর্কে একটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে। সেটি প্রধান বিচারপতি তার রায়ে তুলে ধরেছেন। হাইকোর্টের সে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, বিপুল সংসদ সদস্যের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে এরা উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বসে পরিণত হয়েছেন এবং বিচারপতিদের স্বাধীন বিচার কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের শতকরা ৭০ ভাগ সংসদ সদস্য ব্যবসায়ী। মাহবুবে আলম ও মুরাদ রেজা কেউই এ তথ্যকে ভুল বলেননি। আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, তারা সংসদে আইন প্রণয়ন বিষয়ে সংসদীয় বিতর্ক বা আলোচনায় আগ্রহী নন। ফলে আজকাল সংসদে পাস করা বেশির ভাগ আইনই ত্রুটিপূর্ণ এবং নিম্নমানের। সংসদে আইন প্রণয়ন বিষয়ে তারা তাদের দক্ষতা প্রমাণ না করে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ প্রক্রিয়ায় নিজেদের জড়ানোর বিষয়ে আগ্রহী হয়েছেন। তবে প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টের এ পর্যবেক্ষণকে সমর্থন করেননি। উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অসদাচরণ তদন্ত ও অপসারণের ক্ষমতা এর আগে ছিল সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হয় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে। তিন সদস্যের এ কাউন্সিলে অপর দুই সদস্য হলেন আপিল বিভাগের বিচারপতি। ১৯৭৭ সালে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয় এ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। বর্তমান সরকার বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পরিবর্তে সংসদের ওপর ন্যস্ত করে সংবিধানে ষোলতম সংশোধনী পাস করে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। গত বছরের ৫ মে হাইকোর্টের তিনজন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। হাইকোর্টের সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে সরকার। শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ গত ৩ জুলাই সর্বসম্মতিক্রমে সরকারের আপিল খারিজ করে দেন। ফলে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া হাইকোর্টের রায় বহাল থাকে।

No comments

Powered by Blogger.