ঘুষ দিতে হয় চার ঘাটে

বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির কাজ হাতে পেয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে শিক্ষার মাঠ প্রশাসন। অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মেতে উঠেছেন ঘুষ বাণিজ্যে। প্রাপ্যতা না থাকলেও অর্থ দিলে এমপিও পেয়ে যাচ্ছেন অনেকে। আবার অর্থ না দিলে বৈধ ফাইলও নিষ্পত্তি হয় না। পদে পদে হয়রানি করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা এমপিওকে ‘বিশেষ হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করে একদিকে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় করছে, অপরদিকে ঘুষের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ভুক্তভোগী শিক্ষক-কর্মচারীদের অভিযোগ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। তাদের অভিযোগ, আগে এমপিওভুক্তির বিভিন্ন কাজ ঢাকায় শুধু মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরে (মাউশি) সম্পন্ন হতো। তখন অনেক ক্ষেত্রে এক জায়গায় অর্থ ঢাললে হতো। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন উপজেলা ও জেলা শিক্ষা অফিস এবং বিভাগের আঞ্চলিক কার্যালয়। ফলে এখন সব মিলিয়ে অন্তত চার ঘাটে পয়সা না দিলে ফাইল ওপরে ওঠে না। অথচ সেবাপ্রার্থীদের সুবিধা দিতেই এমপিও’র কাজ মাঠপর্যায়ে বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে। এছাড়া মাউশিতে থাকা এমপিও সংক্রান্ত অবশিষ্ট কাজ এবং সরকারি স্কুলের শিক্ষক বদলিতেও পয়সার খেলা চলছে বলে ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. এসএম ওয়াহিদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, এমপিও সংক্রান্ত কাজে নানা ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ও অভিযোগ আমাদের কাছেও এসেছে। এজন্য শিগগির সারা দেশে টিম পাঠানোর চিন্তাভাবনা করছি।
ওইসব টিম প্রয়োজনে ১০-১৫ দিন সরেজমিন কাজ করবে। প্রয়োজনে তারা এমপিও’র জন্য আবেদনকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে দোষীদের চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দেবে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমরা দুর্নীতির মূলোৎপাটন করে ছাড়ব। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম রনি অভিযোগ করেন, তিনি রাজধানীর মিরপুরের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ২০১৬ সালের মার্চে ওই পদে এমপিওভুক্তির জন্য তাকেও জেলা শিক্ষা অফিসারকে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আগের চেয়ে এখন এমপিওভুক্তির কাজে ঘুষ বাণিজ্য কয়েকগুণ বেড়েছে। ঘুষ না দিলে উপজেলা শিক্ষা অফিসার, জেলা শিক্ষা অফিসার, আঞ্চলিক কার্যালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে কর্মচারী পর্যন্ত সবাই শিক্ষককে হয়রানি করে থাকেন। নানা অজুহাতে এমপিও’র ফাইল আটকে দেয়া হয়। এ নিয়ে শিক্ষক সমাজের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। শুধু এই শিক্ষক নেতাই নন, মাউশির একাধিক কর্মকর্তাও মাঠপর্যায়ে এমপিও’র কাজে দুর্নীতির অভিযোগ করেছেন। নাম প্রকাশ না করে মাউশির একজন সহকারী পরিচালক যুগান্তরকে বলেন, ‘আত্মীয়স্বজনের বৈধ এমপিওভুক্তির কাজের জন্য অনুরোধ করেও শিক্ষা অফিসারদের সহায়তা পাইনি। ওই কাজে এমন প্যাঁচ লাগিয়ে দেয়, শেষে শপথ করিয়ে ১০-১৫ হাজার টাকা নিয়েছে- যেন টাকা দেয়ার কথা আত্মীয়রা আমাদের না জানায়। বড়ই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আছি।’
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে এমপিওভুক্তির কাজ মাঠ প্রশাসনে ছেড়ে দেয়া হয়। এরপর থেকেই এমপিওভুক্তির প্রায় প্রতিটি কাজে নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়ছে মাউশি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এ ব্যাপারে অনলাইন এমপিও কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত মাউশি পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক এলিয়াছ হোসেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে যুগান্তরকে বলেন, ‘মানুষ টাকা দেয় কেন? কাজ তো এমনিতেই হবে।’ অনুসন্ধানে নেমে উল্লিখিত শিক্ষক নেতার অভিযোগের বেশকিছু সত্যতা পাওয়া গেছে। সারা দেশে মাউশির নয়টি আঞ্চলিক কার্যালয় আছে। এর মধ্যে চারটির উপপরিচালকের বিরুদ্ধেই বর্তমানে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত চলছে। বাকিগুলোর বিরুদ্ধেও কমবেশি অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় আরও চারজন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও ৬ জন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাউশিকে বিভাগীয় মামলা দায়েরের নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অবশ্য এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে রক্ষায় মাউশিরই আরেকটি দুর্নীতিগ্রস্ত চক্র মরিয়া। জানা গেছে, নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও অবৈধভাবে ৬ জনকে এমপিও দেয়ার দায়ে মন্ত্রণালয় গত বছরের নভেম্বরে নির্দেশনা দেয়। এরপর ১৫ ডিসেম্বর মাউশি মহাপরিচালক গোপালগঞ্জ, সাতক্ষীরা, নেত্রকোনা ও নোয়াখালীর শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার ফাইল অনুমোদন করেন। একই ফাইলে ঢাকা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক উপ-পরিচালকের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি অনুমোদিত হয়। কিন্তু ওই ফাইল আজ অবধি নিষ্পত্তি হয়নি। অভিযোগ উত্থাপন বা প্রমাণিত হওয়ার পরও বরং সংশ্লিষ্টরা বহাল-তবিয়তে আছেন। এ সুযোগে অভিযোগকারীদের নানাভাবে ম্যানেজের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ উঠেছে, সারা দেশে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এবং আঞ্চলিক পরিচালকের কাছ থেকে মাসিক হারে মাসোয়ারা নিয়ে থাকেন ৪ জন চিহ্নিত কর্মকর্তা। কিন্তু তারা এতটাই প্রভাবশালী যে তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস করেন না। উল্টো অভিযুক্তদের রক্ষা করতে মহাপরিচালক দফতরের সংশ্লিষ্ট ফাইল গায়েব করার অভিযোগ আছে এ চক্রের বিরুদ্ধে। এমন পরিস্থিতিতে জুনের প্রথম সপ্তাহে মন্ত্রণালয় থেকে চিহ্নিত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কঠোর ভাষায় ফের তাগিদপত্র দেয়া হয়। তাও মহাপরিচালকের নজরে না নিয়ে গায়েব করা হয়। এ ব্যাপারে মহাপরিচালক যুগান্তরকে বলেন, অভিযুক্ত কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের তাগিদপত্র সম্পর্কে তার জানা নেই। যদি পাঠিয়ে থাকে তাহলে কেন তার নজরে নেয়া হয়নি তা তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন। আর পরিচালক (মাধ্যমিক) বলেন, মাঠপর্যায়ের কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এমপিও-দুর্নীতির কারণে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে মহাপরিচালকের নির্দেশনার বিষয়টি তার জানা নেই। তবে এ সংক্রান্ত ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব প্রশাসন শাখার। এটা এক শাখা থেকে আরেকটিতে পাঠানো মানেই হল দায় সারার অপচেষ্টা। সূত্র জানিয়েছে, ময়মনসিংহ, সিলেট এবং ঢাকা অঞ্চলের উপপরিচালকের বিরুদ্ধে আরও বেশকিছু অভিযোগ আছে। এরমধ্যে ঢাকা অঞ্চলের উপপরিচালকের বিরুদ্ধে তারই দফতরের সাবেক এক কর্মচারী অভিযোগ তুলেছেন যে, ৫১ ব্যক্তিকে এমপিও দিয়ে রাষ্ট্রের লাখ লাখ টাকা অপচয় করা হয়েছে। তথ্যপ্রমাণসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দেয়ার পর শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশে তদন্ত শুরু হয়েছে।
এব্যাপারে উপ-পরিচালক গৌরচন্দ্র মণ্ডল যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে তা মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন। ওই কর্মচারীর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাবিরোধী অভিযোগ আনায় এ অসত্য অভিযোগ এনেছেন।’ এক প্রশ্নের উত্তরে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রাপ্যতা না থাকা সত্ত্বেও দুটি এমপিও ভুলে দেয়া হয়েছে। অনেক চাপের মধ্যে কাজ করায় এটা হয়েছে।’ ময়মনসিংহ অঞ্চলের উপপরিচালক এএসএম আবদুল খালেকের ব্যাপারে অবৈধভাবে এমপিওভুক্তিসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির লিখিত অভিযোগ করেছেন তারই পরিচালক অধ্যাপক মো. আ. মোতালেব। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফকে দিয়ে এক সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে মাউশি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অধ্যাপক ইউসুফ যুগান্তরকে বলেন, ‘কমিটির তদন্ত কাজ শেষ। তদন্তে এমপিওভুক্তির কাজে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পেয়েছি। প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করা হবে।’ এ ব্যাপারে উপ-পরিচালক দাবি করেন, যেসব শিক্ষককে অবৈধভাবে এমপিও দেয়া হয়েছে বলে কথা উঠেছে, তাদের আসলে দেয়াই সম্ভব হয়নি। বাছাই তালিকায় তারা ছিল। অভিযোগের পর তদন্ত শুরু হওয়ায় স্থগিত আছে। কারও কাছ থেকে কাজের নামে তিনি কোনো অর্থ নেননি বলে জানান। এমপিওতে ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ আছে খুলনার আঞ্চলিক কার্যালয়ের বিরুদ্ধেও। মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার একটি নিন্ম মাধ্যমিক স্কুলে নিয়ম ভেঙে ১৩ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। অথচ এ ধরনের স্কুলে সর্বোচ্চ পাঁচজন শিক্ষক ও দু’জন কর্মচারীর এমপিওভুক্তির বিধান আছে। এভাবে রাতকে দিন করার নানা অভিযোগ এনে কিছুদিন আগে যশোর জেলার ২০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান মাউশি এবং মন্ত্রণালয়ে অভিযোগও করেন। এ উপপরিচালকের বিরুদ্ধে সরকার আদেশ জারি করে যে বিষয়ের এমপিওভুক্তি বন্ধ রেখেছে তাতে এমপিও দেয়ার ঘটনা প্রমাণিত হয়েছে। এ ঘটনা ধরা পড়ার পর এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। বিষয়টি প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও রহস্যজনক কারণে এ কর্মকর্তাকে শুধু ‘সতর্ক’ করে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ১৩ জুন এ আদেশ জারি করা হয়েছে। এ ব্যাপারে টিএম জাকির বলেন, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে অযথা ঢালাও অভিযোগ করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে কার্যক্রম বিকেন্দ্রীকরণের পর প্রতি দু’মাস পরপর এমপিও দেয়া হচ্ছে। সর্বশেষ ২৫ মে মাউশিতে এমপিওভুক্তির বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে ২৭৮৫টি নতুন এমপিওভুক্ত করা হয়। এর আগে মার্চ মাসে ৩৫৬৯ জনকে দেয়া হয়। এ দুই মাসে সবচেয়ে বেশি নতুন এমপিওর আবেদন ছিল রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলে। এ কমিটির একজন সদস্য বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ বন্ধ আছে। এ অবস্থায় এত ব্যক্তির এমপিওবিহীন থাকার নয়। এনিয়ে বৈঠকে প্রশ্ন তুলেও লাভ হয়নি। জানা গেছে, শুধু নতুন এমপিওভুক্তিই নয়, নাম সংশোধনের আড়ালে শিক্ষকদের বেতন বাড়িয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। বকেয়া দেয়ার নামে অবৈধভাবে সরকারের অর্থ দেয়া হচ্ছে। সর্বশেষ মে মাসের বৈঠকে ১২টি বকেয়া বেতনের ইস্যু বৈঠকে তোলা হয়। তার একটিও নিষ্পত্তি হয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, বৈঠকে বেতনের ইস্যু তোলা হয় কিন্তু এ সংক্রান্ত কোনো ফাইল উঠানো হয় না। এর ফলে বৈধ-অবৈধতা নিরূপণ করা যায় না। এভাবেই সরকারের অর্থ চলে যাচ্ছে অনায়াসে। দেশে বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রায় ২৮ হাজার। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী সরকারি বেতন পাচ্ছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে মোট বরাদ্দের প্রায় ৬৫ শতাংশই খরচ হয় এ খাতে।

No comments

Powered by Blogger.