উত্তর-মধ্যাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

যমুনা ও বহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় দেশের উত্তর-মধ্যাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। কুড়িগ্রাম, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইলসহ ৬ জেলার নিন্মাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব অঞ্চলের লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। জলাবদ্ধতার কারণে বগুড়া, কুড়িগ্রাম ও জামালপুরে অর্ধশতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বন্যাদুর্গতদের অভিযোগ, তারা পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছেন না। অভাব-অনটনে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন তারা। এদিকে সিলেট অঞ্চলে বন্যার পানি কমলেও সেখানে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত রোগবালাই। রাত যেন কাটতেই চায় না বানভাসি মানুষের। একদিকে খাবারের কষ্ট, অন্যদিকে রাত হলে নেমে আসে অজানা আতঙ্ক। সাপ আর পোকামাকড়ের আতঙ্কে জেগে থাকতে হয় সারারাত। যুগান্তর ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
বগুড়া : সারিয়াকান্দিতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। যমুনা নদীর পানি ১৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে শনিবার সকাল পর্যন্ত বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ৬টি ইউনিয়নে পানি ঢুকে পড়ায় অন্তত ১৮ গ্রামের তিন হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বন্যাকবলিত মানুষ বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের অভাব এবং পয়ঃনিষ্কাশনের সমস্যা নিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। ইতিমধ্যে জলাবদ্ধ ৩৬ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৭টি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুল মান্নান জেলা প্রশাসকের বরাদ্দ করা ৫০ মেট্রিক টন চাল বিতরণ শুরু করেছেন।
কুড়িগ্রাম ও চিলমারী : চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমা ছুঁইছুঁই। কুড়িগ্রাম সদর, উলিপুর, চিলমারী, রাজারহাট ও রাজিবপুর উপজেলার নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা জানান, কুড়িগ্রাম সদরে ২০ হাজার, উলিপুরে ১৭ হাজার, চিলমারীতে ২০ হাজার, রাজিবপুরে ৫ হাজারসহ অন্যান্য উপজেলা মিলিয়ে প্রায় ৭৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। চিলমারী ইউপি চেয়ারম্যান গয়ছল হক মণ্ডল জানান, তার ইউনিয়নে গত এক সপ্তাহে প্রায় ৭০টি বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। অন্তত ২০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এদিকে চিলমারী উপজেলার রানীগঞ্জ ইউনিয়নে বন্যার পানিতে ডুবে সিদ্দিক (৭) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে বাড়ির পেছনে ডোবায় পড়ে তার মৃত্যু হয়। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক মকবুল হোসেন জানান, বন্যায় এখন পর্যন্ত বীজতলা ও ফসল নিমজ্জিত হওয়ার সঠিক তথ্য নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। সিভিল সার্জন ডা. আমিনুল ইসলাম জানান, শনিবার জরুরি সভার মাধ্যমে ৮৮টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।
টাঙ্গাইল ও ভুয়াপুর : যমুনা নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় টাঙ্গাইল জেলার পাঁচটি উপজেলার নিন্মাঞ্চল বন্যাকবলিত হয়েছে। শনিবার যমুনা নদীর পানি গোপালপুর উপজেলার নলিন পয়েন্টে বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বন্যাকবলিত উপজেলাগুলো হচ্ছে- গোপালপুর, ভুয়াপুর, কালিহাতী, নাগরপুর ও টাঙ্গাইল সদর।
সিরাজগঞ্জ : পানি উন্নয়ন বোর্ড সিরাজগঞ্জ পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী রনজিৎ কুমার জানান, যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধির ফলে নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বাইরে সমতল ও নিচু এবং চরাঞ্চলের ২৭টি ইউনিয়নের নিচু এলাকায় পানি প্রবেশ করেছে।
গাইবান্ধা : গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, যমুনা, করতোয়া ও ঘাঘটসহ সবগুলো নদ-নদীর পানি বেড়েই চলেছে। সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও সদর উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের প্রায় ২৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। নিম্ন ও চরাঞ্চলের রাস্তাঘাট, ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। অন্তত ৩ হাজার একর তোষাপাট পানিতে ডুবে আছে। হুমকির মুখে পড়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। চরাঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠদান কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
জামালপুর ও ইসলামপুর : ইসলামপুর উপজেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। উপজেলায় নতুন করে এলাকা প্লাবিত হয়ে মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। উপজেলা ২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জলমগ্ন হয়ে পড়ায় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম। এদিকে বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনা বিপদসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, সরিষাবাড়ী ও মেলান্দহ উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের ৩০ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। যমুনার পানি বৃদ্ধির ফলে হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি, কাঁচা তরিতরকারি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার মানুষ গৃহপালিত গবাদিপশু নিয়ে উচু বাঁধে আশ্রয় নিচ্ছেন।
মৌলভীবাজার ও কুলাউড়া : মৌলভীবাজারের রাজনগরে কুশিয়ারা নীদতে ধীরগতিতে পানি কমছে। কিন্তু পানি বাড়ছে কাউয়াদীঘি হাওরে। হাওরে পানি বাড়ায় রাজনগর উপজেলার নতুন নতুন এলাকার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন রোগবালাই। পানিবন্দি মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানরা শুকনো খাবার দিলেও তা পর্যাপ্ত নয়। বন্যাদুর্গতরা বলছেন, আগে ভাতের প্রয়োজন। ভাতের স্বাদ চিঁড়ায় মেটে না। এমন পরিস্থিতিতে হাওর তীরের বন্যাকবলিত ইউনিয়নগুলোতে বন্ধ হওয়া ওএমএস চালুর দাবি জানিয়েছেন ইউনিয়ন ও উপজেলার জনপ্রতিনিধিরা। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তার সংকটের কারণে বন্যাকবলিত এলাকায় প্রয়োজনীয় মেডিকেল টিম দেখা যাচ্ছে না। আমিরপুর গ্রামে জ্বরের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। সেখানে শনিবার মেডিকেল টিম যাওয়ার কথা থাকলেও যায়নি।
সাপের আতঙ্কে ঘুম আসে না : হাকালুকির তীর থেকে মাহবুবুর রহমান রিপন জানান, সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, ঘরে বন্যার পানি ঢুকেছে এমন পরিবারের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। এর মধ্যে তিন হাজার পরিবার বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্র কিংবা উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আহবান জানালেও অনেকেই বাড়ি ছাড়তে চান না। ঝুঁকি নিয়েই চৌকি কিংবা মাচা বেঁধে অবস্থান করছেন বন্যার পানিতে ডোবা বাড়িতে। শনিবার সরেজমিন গেলে কথা হয় আখাই মিয়ার সঙ্গে। তিনি হাকালুকির তীরবর্তী ফেঞ্চুগঞ্জের ঘিলাছড়ার বাসিন্দা। জানালেন, ২২ দিন ধরে ঘরে হাঁটুপানি হলেও বাড়ি ছাড়েননি। কোনোরকম দিনের বেলা কাটালেও রাতে অনেক ভয় হয়। যেখানে দিনের বেলাতেই ঘরের ভেতরে বানের পানিতে ভেসে আসা সাপ ঢুকে সেখানে রাতের চিত্র আরও ভয়ঙ্কর। তিনি নিজ হাতে প্রায় ১০টি সাপ মারার পর টিকে আছেন। এর মধ্যে অনেক বিষাক্ত সাপও রয়েছে। রাতের অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। সাপ কিংবা অন্যান্য পোকামাকড়ের ভয়ে পরিবারের তিন সদস্যই ঘুমাতে পারেন না। আলো জ্বালিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না রাতে। তিনি বলেন, ‘খুব কষ্টের মাঝে দিন যার আমরার, পানি যে কুনবালা লামবো আল্লাহই জানোইন। ইলা কষ্ট আর কোনোদিন অইছে না। গরো খানি নাই (খাবার নেই), এর মাজে রাইত অঘুমা কাচানি লাগে।’ কক্সবাজার : শুক্রবার থেকে ভারি বর্ষণ থেমে গেছে। ফলে নেমে গেছে ঢলের পানিও। এরপরই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে ক্ষতচিহ্নগুলো। ফলে পানিবন্দির মতোই এখন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন প্লাবিত এলাকার লোকজন। সরকারের তরফ থেকে এ পরিস্থিতি উন্নয়নে তৎক্ষণাৎ কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তাই নিজেদের প্রচেষ্টায় সড়কের ভাঙা অংশে কাঠের সাঁকো কিংবা বিকল্প সড়ক তৈরি করে যাতায়াত স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছেন দুর্গত মানুষগুলো। ঈদগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান ছৈয়দ আলম বলেন, আশা করছি স্থানীয়দের পাশাপাশি সরকারি সহযোগিতা এক হলে আগামী সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে ভাঙা সড়ক ও বাঁধ মেরামত করা সম্ভব হবে।

No comments

Powered by Blogger.