‘বাংলাদেশ, সত্য বলা মানে নেতিবাচক প্রচারণা নয়’

মিনাক্ষী গাঙ্গুলি
বাংলাদেশে গোপন আটক আর বলপূর্বক গুম নিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ৮২ পৃষ্ঠার রিপোর্ট প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল দাবি করেন এটা ছিল ‘নেতিবাচক প্রচারণা’। নির্মমভাবে তিনি উপেক্ষা করে গেছেন ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে যারা উত্তরের জন্য মরিয়া হয়ে আছে। স্থানীয় গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘কাকে আপনি গুমের শিকার হওয়া বলবেন? অনেক ব্যবসায়ী এ দেশে তাদের ঋণের অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে আত্মগোপন করে আছে। কিছু মানুষ বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়ানোর পর লাপাত্তা হয়েছে।’
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, ‘গুম হওয়া ব্যক্তি’ এমন একজন যিনি রাষ্ট্রীয় এজেন্টদের হেফাজতে আটক (বা সর্বশেষ দেখা গেছে)। এরপর ওই ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণ বা তার অবস্থান স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানানো হয় যা তাকে আইনি সুরক্ষার বাইরে নিয়ে যায়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিভিন্ন ঘটনার বিস্তারিত বিশ্লেষণ তুলে ধরেছে যেখানে ব্যক্তিবিশেষকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষদর্শী বা পরিবারের সদস্যদের সামনে। তাদের তুলে নিয়ে গেছে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো যারা নিজেদের র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র‌্যাব), ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি) বা ‘প্রশাসন’-এর লোক হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। বাংলাদেশি আইন মোতাবেক তাদের যখন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করা হয় নি, তখন পরিবারের সদস্যরা বার বার পুলিশ ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের দ্বারস্থ হয়েছেন। কিন্তু তারা ওই ব্যক্তিবিশেষকে আটক রাখার কথা অস্বীকার করেছে। এদের অনেককে কয়েক সপ্তাহ বা মাসব্যাপী অবৈধভাবে আটক রাখার পর আদালতে হাজির করা হলেও, অন্যদের নীরব থাকার হুঁশিয়ারি দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বেশ কয়েকজনকে পরবর্তীতে কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। আর বহুসংখ্যক এখনো নিখোঁজ।
এসব ঘটনা তদন্তে প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরিবর্তে আসাদুজ্জামান খান ঘোষণা দিয়েছেন তার সরকার ‘এ রিপোর্ট পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান’ করবে। দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য দায়িত্বশীল মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে তিনি দাবি করেছেন, জাতিসংঘ কখনই গুমের কথা উল্লেখ করে নি। প্রকৃতপক্ষে, এসব নিয়ম লঙ্ঘনের বিষয়ে মন্তব্য চেয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পাঠানো বিস্তারিত একাধিক চিঠির মতো জাতিসংঘ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সেস-এর তরফে বার বার পাঠানো জিজ্ঞাসাগুলোকে উপেক্ষা করেছে বাংলাদেশ সরকার। হিউম্যান রাইটস কমিটিও কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে।   
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ, বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় বার বার মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো হাইলাইট করেছিলেন। আর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ক্ষমতায় আসলে এসবের ইতি টানবেন। এখন, টানা দ্বিতীয় মেয়াদের শেষের দিকে থাকা তার আওয়ামী লীগ সরকার শুধু তাদের নিয়মলঙ্ঘনকারী পূর্বসূরিদের মতো কাজ করে যাচ্ছে তাই নয়, বরং নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সমালোচকদের গোপনে আটক ও গুম করছে তাদের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো। এছাড়াও গুম করা হচ্ছে যাদের অপরাধী মনে করা হচ্ছে তাদের। দলটির নেতা হাসান মাহমুদ হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে পক্ষপাতমূলক হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। তবে, তিনি এর আগে বিরোধী দলের সহিংসতার এবং যুক্তরাষ্ট্রে তাদের কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানানোর বিষয়টি উপেক্ষা করে গেছেন। বাংলাদেশ আসলে আরো ভালো কিছু করতে পারে। আর তাদের সেটা করাও উচিত।
[লেখক পরিচিতি: মিনাক্ষী গাঙ্গুলি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক। উপরের লেখাটি সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত- নো, বাংলাদেশ, দ্য ট্রুথ ইজ নট এ ‘স্মিয়ার ক্যাম্পেইন’ শীর্ষক তার নিবন্ধের অনুবাদ]

No comments

Powered by Blogger.