জৈন্তেশ্বরীতে একদিন

আকাশের মনের অবস্থা ভালো নেই। একটু পর পর অঝোর ধারায় কান্না করছে। এর মাঝেই আমাকে বের হতে হল। মনোয়ার ভাই অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন। বাসা থেকে বের হয়ে রিকশা নিয়ে সোজা হাজির হই হোটেলের সামনে। দশটার দিকে আমাদের কাক্সিক্ষত যাত্রা শুরু করলাম। আমার যাত্রা সঙ্গী মনোয়ার ভাই, ভাবী আর আমি। আমাদের এবারের গন্তব্য ’জৈন্তেশ্বরী বাড়ি’। সিলেট-তামাবিল সড়কের পাশে জৈন্তাপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছেই ’জৈন্তেশ্বরী বাড়ি’র অবস্থান। এগিয়ে চলছি আমরা অঝোর বৃষ্টি ধারার মাঝে। আমি গাড়ির জানলার বাইরে হাত দিয়ে বৃষ্টির ছোঁয়া পেতে চেষ্টা করলাম। বৃষ্টিমুখর দিনে আমরা এগিয়ে চলছি। মুষলধারা বৃষ্টির মাঝে গন্তব্যে পৌঁছেও বসে থাকতে হল চার চাকার বাহনে। বৃষ্টি একটু ঝিম ধরার সঙ্গে সঙ্গে আমরা গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। বৃষ্টির মাঝে চোখে পড়ল প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের সাইনবোর্ড সংরক্ষিত পুরাকীর্তি। ভেতরে প্রবেশের পর দেখা পেলাম ভগ্নপ্রায় দেয়ালের অংশ। ভেতরের দিকে এগিয়ে গেলাম আমরা। সামনে একটি পুরনো ঘর দেখতে পেলাম। ঘরটির সামনে একটি সাইনবোর্ড দেখলাম ঘরটি ‘ইরাদেবী মিলনায়তন’। আমাদের মতো অনেকেই এসেছেন এ প্রাচীন পুরাকীর্তি দেখতে। প্রবীণ সামাদ আহমেদ বললেন- ‘জৈন্তেশ্বরী বাড়ি’ মূলত : সিন্টেং বা জৈন্তা রাজাদের পূজিত দেবতার বাড়ি। জৈন্তার রাজা যশোমানিক ১৬১৮ সালে অত্যন্ত আড়ম্বরে উপহার হিসেবে প্রাপ্ত কালী দেবীর মূর্তিকে এ বাড়িতে স্থাপন করেন এবং বাড়িটি নির্মাণ করেন। বাড়িটির মধ্যখানে মূল মন্দির ঘরটির অবস্থান। বর্তমানেও মূল ঘরটির ভিটা এবং সংলগ্ন দক্ষিণের ঘরটি নানা দৈব-দুর্বিপাকের মধ্যেও দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা সংস্কার করে একদল হিতৈষী ব্যক্তি ঘরটি ‘ইরাদেবী মিলনায়তন’ নামকরণ করেছেন এবং বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মাঝে মাঝে এতে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ঘরটির স্তম্ভগুলো লোহার এবং স্থাপত্যশৈলী বেশ দৃষ্টিনন্দন। জৈন্তেশ্বরীর ইতিহাস জানতে চাইলে তিনি বলেন- রাজা ধন মানিক ১৫৯৬ থেকে ১৬০৬ সাল পর্যন্ত জৈন্তিয়ার অধিপতি ছিলেন। তার মৃত্যুর পর ১৬০৬ সালে কাছাড় রাজ শত্রুদমন যশোমানিককে মুক্তি দেন। যশোমানিক দেশে ফিরে আসেন ও সিংহাসন লাভ করেন। ১৬১৮ সালে শত্রুদমন ও অসমরাজ প্রতাপ সিংহের মধ্যে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে প্রথমে কাছাড় রাজ পরাজিত হন। যুদ্ধ জয়ের পর অহম রাজ সেনাপতি সুন্দর গোসাইকে রহা দুর্গে রেখে নিজে রাজধানীতে প্রত্যর্পণ করেন। এ সুযোগে কাছাড় পতির ভ্রাতা ও সেনাপতি ভীমবল রহা দুর্গ আক্রমণ করেন। অতর্কিত এ আক্রমণ প্রতিরোধে তিনি অসমর্থ হন, অধিকাংশ সেনা মৃত্যুবরণ করে, বাকিরা পালিয়ে যায়। কাছাড়পতি এ বিজয়কে স্থায়ী করার জন্য রাজধানী মাইবঙ্গের নতুন নাম করেন ‘কীর্তিপুর’। এ সময় থেকে কাছাড়পতিকে জৈন্তাপতি কর্তৃক বার্ষিক নজরানা দেয়ার প্রথাও রহিত হয়। শত্রুদমনের এ বিজয়ের পর যশোমানিক কোচবিহার গমন করেন এবং কোচরাজ লক্ষ্মীনারায়ণের কন্যাকে বিয়ে করেন। সে বিয়েতে যৌতুকস্বরূপ ধাতুনির্মিত মূল্যবান একটি দেবমূর্তিপ্রাপ্ত হন। দেবী কালীর সে মূর্তিকে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে জৈন্তাপুরে নিয়ে মহাসমারোহে ‘জৈন্তেশ্বরী কালী’ নামে প্রতিষ্ঠিত করেন। যশোমানিকের আগে রাজদরবারে জৈন্তা বা সিন্টেং রীতিনীতি পালিত হতো কিন্তু এ মূর্তি স্থাপনের পরই রাজ পরিবারে হিন্দুদের মূর্তিপূজা শুরু হয়। সামাদ আহমেদ আমাদের পুরো এলাকাটি ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলেন। ঘরটির পশ্চিম দিকে দেয়াল সংলগ্ন প্রায় দু’ফুট উঁচু পাকা মঞ্চ ধাঁচের একটি জায়গা আছে। দেখে আমি বললাম এখানে কী হয়? সামাদ সাহেব বললেন এটি ‘চণ্ডীর থালা’ নামে পরিচিত। বিগত কয়েক দশক আগেও এখানে একজন ব্রাহ্মণ বসবাস করতেন। এ ঘরটি সংলগ্ন পেছনের দিকে আরেকটি ঘর ছিল, যেটির কয়েক ফুট উঁচু পাকার ভিটা এখনও দেখা যায়।
এ ঘরটিই মূল মন্দির ঘর ছিল এবং এটি আয়তাকার। ভিত থাকলেও ওপরের কাঠামোটি সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। সম্ভবত এখানে জৈন্তেশ্বরী দেবী অধিষ্ঠিত ছিলেন। ঘরটি যে খুবই মজবুত ও সুরক্ষিত ছিল, তা বর্তমান ধ্বংসাবশেষ দেখেই নিশ্চিত হওয়া যায়। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে দেবীর মূর্তিটি চুরি হয়ে যায়। এ ঘরটির দক্ষিণ দিকে রয়েছে একটি পানির কূপ যা স্থানীয়দের কাছে ‘ইন্দিরা’ নামে পরিচিত। কূপটির পাড় বাঁধানো এবং বর্তমানে এটির পানি আর ব্যবহার উপযোগী নয়। হঠাৎ আমি বললাম এখানে কোথায়ও নর বলি দেয়া হতো বুঝি। ছোটবেলায় মার কাছে শুনতাম। তিনি বললেন, ঠিকই শুনেছেন, কথিত আছে ওই পাকার উঁচু গোলাকৃতি একটি পাটাতন বা বেদি যেখানে মানুষ বলি দেয়া হতো। এ জন্য পাটাতনটি ‘বলির পাটাতন’ নামে পরিচিত। বেদিটি বেলে পাথরের তৈরি এবং আয়তন প্রায় ৩ বর্গ মিটার। বেদির গোলাকৃতি অংশ থেকে উত্তর দিকে ক্রমশ নিচের দিকে একটি সিঁড়ি চলে গেছে। এটির দুটি ধাপ রয়েছে-প্রথমাংশ সামান্য উঁচু এবং পরের অংশ প্রথমাংশ থেকে খানিকটা নিচু হয়ে ক্রমশ ভূমির দিকে চলে গেছে। সম্ভবত নরবলি দেয়ার নানা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এখানে সম্পাদিত হতো। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এ মানুষ বলি দেয়ার অপবাদেই (?) ব্রিটিশরা ১৮৩৫ সালে জৈন্তারাজ্য দখল করে নেয়। বর্তমানে বাড়িটিতে মোট তিনটি ফটক দেখা যায়। প্রধান ফটকটি দক্ষিণ দিকে অবস্থিত এবং সেটি সাবেক কালের রাজকীয় ভাব অনেকটা ধরে রাখতে পেরেছে। যদিও সংস্কার ও পরিচর্যা অভাবে সেটি এখন প্রায় বিবর্ণ এবং ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের কারণে ওপরের অংশটি ভেঙে পড়েছে। অপর গেট দুটির একটি পূর্বদিকে এবং একটি পশ্চিমদিকে অবস্থিত। নিরাপত্তার জন্য সে দুটি এখন বন্ধ করে রাখা হয়েছে। সম্ভবত রাজা রাজবাড়ি হতে এ পূর্বদিকের গেট দিয়েই যাতায়াত করতেন। তবে এ বাড়ির সবচেয়ে আকর্ষণ এবং দর্শনীয় বিষয়টি হচ্ছে বাড়িটির বিরাট উঁচু দেয়াল। বিশাল এ বাড়িটির পুরোটাই ৮ হাত উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা এবং দেয়ালের মধ্যে হাতি, ঘোড়াসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর চিত্র অঙ্কিত আছে। জৈন্তেশ্বরী বাড়ির দেয়ালের মধ্যে উত্তর-পশ্চিম দিকে আরেকটি ভবনের ধ্বংসাবশেষ এখন দেখতে পাওয়া যায়। এটি সম্ভবত রাজ্যের সচিবালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো। মন্দিরের দক্ষিণ দিকটি রাজার দরবার হল হিসেবে ব্যবহৃত হতো বলে কথিত আছে এবং প্রধান ও অভিজাতদের বসার জন্য সেখানে পাথরের আসন রয়েছে। সে পাথরগুলো ‘মেগালিথিক’ নামে পরিচিত এবং এগুলো জৈন্তিয়ার প্রাচীনত্বের এক জীবন্ত নিদর্শন। যাবেন কীভাবে : ঢাকা থেকে ট্রেনে বা বাসে সিলেট। সিলেট থেকে এক ঘণ্টার পথ জৈন্তাপুর। বাস, মিনিবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা মাইক্রোবাসে চড়ে জৈন্তাপুর চলে যেতে পারেন। উঠতে পারেন জৈন্তা হিল রিসোর্টে অথবা কাছের নলজুড়িতে জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয়। আগে থেকেই বুকিং দিয়ে যেতে হবে ডাকবাংলোয়। শহর থেকে মাইক্রবাস নিয়ে গেলে ভাড়া নিবে ২৫০০ থেকে ৩০০০। গাড়ির জন্য ০১৬১৭৬৭৪৩১০ অথবা ০১৯২৯৪১৭৪৪১ এ নম্বরে যোগাযোগ করতে পারেন।

No comments

Powered by Blogger.