বিয়ানীবাজার কলেজ কক্ষে গুলিতে নিহত ১

সিলেটের বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের শ্রেণীকক্ষে গুলি করে খালেদ আহমদ লিটু (২৩) নামে একজনকে হত্যা করা হয়েছে। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের জেরে সোমবার দুপুর ১২টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এর আগে ক্যাম্পাসে বিবদমান দুই গ্রুপের মধ্যে হাতাহাতি ও সংঘর্ষ হয়। নিহত লিটু ওই কলেজের ছাত্র নয়। সে পেশায় একজন মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী ও স্থানীয় ছাত্রলীগের পাভেল গ্রুপের সমর্থক। কলেজটি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের নির্বাচনী এলাকায় অবস্থিত। আর নিহত লিটু শিক্ষামন্ত্রীর প্রতিপক্ষ গ্রুপের সমর্থক বলে জানা গেছে। এদিকে শিক্ষামন্ত্রীর এলাকার একটি কলেজের শ্রেণীকক্ষে এ ধরনের ঘটনা ঘটায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম নিয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষামন্ত্রীর এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের অস্ত্রের মহড়ায় অভিভাবকদের মধ্যেও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে লিটু কলেজের ছাত্র না হয়েও কী করে শ্রেণীকক্ষে অবস্থান করছিল, সে প্রশ্নও এখন অনেকের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। ঘটনার পর বিয়ানীবাজার থানা পুলিশ কামরান, ফাহাদ ও এমদাদুর নামের তিনজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তারা পাভেল গ্রুপের কর্মী বলে জানা গেছে। কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, লিটু নিহত হওয়ার আগে কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের পাভেল গ্রুপ ও পল্লব গ্রুপের অনুসারীদের মধ্যে হাতাহাতি-সংঘর্ষ হয়। এতে কলেজ ক্যাম্পাসে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। কলেজে পরীক্ষার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক পুলিশ সদস্য বলেন, ‘ছাত্রলীগের বিবদমান দুটি গ্রুপের অনুসারীদের মধ্যে সকালে হাতাহাতি হয়। এ নিয়ে ক্যাম্পাসে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। দুপুর ১২টার দিকে ইংরেজি বিভাগের কক্ষে হঠাৎ গুলির শব্দ শোনা যায়। দ্রুত সেখানে গিয়ে এক যুবককে রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখি। এ সময় কক্ষটিতে কেউ ছিল না।’ ডিউটিতে থাকা পুলিশের অপর এক সদস্য জানান, গুলির শব্দের পরপরই জিআই পাইপ হাতে তিন যুবককে দৌড়ে পালাতে দেখেছেন কলেজের শিক্ষার্থীরা। বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ দ্বারকেশ চন্দ্র নাথ যুগান্তরকে বলেন, ‘লিটু কলেজের ছাত্র নয়। দুপুরের দিকে হঠাৎ ইংরেজি বিভাগে গুলির শব্দ শোনা যায়। পরে গিয়ে দেখি রক্তাক্ত এক যুবক পড়ে আছে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। হত্যাকাণ্ডের পর কলেজ কাউন্সিলের জরুরি বৈঠক ডেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে পরীক্ষা যথারীতি চলবে।’ এদিকে হত্যাকাণ্ডের পর ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপ পরস্পরকে দায়ী করছে। জেলা ছাত্রলীগের আপ্যায়নবিষয়ক সম্পাদক পাভেল মাহমুদ নিহত লিটুকে তার গ্রুপের কর্মী দাবি করেছেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘পল্লবের ক্যাডাররাই লিটুকে হত্যা করেছে। বেলা ১১টায় পল্লব গ্রুপের সঙ্গে তার নেতাকর্মীদের ঝগড়া হয়। এ সময় পল্লব গ্রুপের ক্যাডার শাহেদ অস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে মহড়া দেয়। পরে সিনিয়রদের নিয়ন্ত্রণে পরিস্থিতি শান্ত হয়। দুপুরের দিকে শুনতে পাই, প্রতিপক্ষের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে লিটু মারা গেছে।’ জানতে চাইলে বিয়ানীবাজার পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও পল্লব গ্রুপের সমর্থক শাহেদ আহমদ বলেন, ‘প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। ঘটনার সময় আমি কলেজ ক্যাম্পাসেই ছিলাম না। দুটি স্ট্যান্ডের বিরোধ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় পুলিশ প্রশাসনের ডাকা বৈঠকে আমি ছিলাম। প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করতেই আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আসলে পাভেল গ্রুপের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার হয়েছে লিটু।’ তিনি দাবি করেন, ‘ফাহাদ, কালো কামরান ও এমদাদের নেতৃত্বেই লিটুকে খুন করা হয়েছে। ঘটনার পর ফাহাদকে অস্ত্র হাতে পালিয়ে যেতে দেখেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।’ জানতে চাইলে সাবেক ছাত্রনেতা ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আবুল কাশেম পল্লব যুগান্তরকে বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের সময় আমি মোল্লাপুর ইউনিয়নে ত্রাণ বিতরণে ব্যস্ত ছিলাম। পরে জানতে পারি, কলেজের কক্ষে একজন নিহত হয়েছে। ওই ঘটনায় আমাকে জড়িয়ে নানা বক্তব্য দেয়ায় আমি বিস্মিত।’ তিনি বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্ত হলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।’ জানতে চাইলে নিহত খালেদ আহমদ লিটুর বাবা ফয়জুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, লিটু আমার একমাত্র ছেলে। সে সম্পূর্ণ নির্দোষ, তার কোনো দোষ ছিল না। লিটু রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিল না। তারপরও তাকে খুন করা হল।’ তিনি জানান, লিটুর বন্ধু-বান্ধবরা পাভেল গ্রুপ করত। নিহত লিটুর মামাতো ভাই রুবেল আহমদ জানান, বিয়ানীবাজারের নোয়াগ্রাম রোডে এসএস মোবাইলশপ নামে লিটুর একটি দোকান রয়েছে। সে সরাসরি কোনো রাজনীতি করত না। বন্ধুরা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে ওকে খুন করা হতে পারে। বিয়ানীবাজার থানার ওসি চন্দন কুমার চক্রবর্তী জানান, লিটুকে হত্যার ঘটনায় তিনজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। শিগগির লিটুর হত্যাকারী চিহ্নিত ও রহস্য উদ্ঘাটন হবে। সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এ ব্যাপারে মামলা হয়নি বলে তিনি জানান। সিলেট সফরে থাকা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বিয়ানীবাজারে নিহত লিটুকে ছাত্রলীগের কর্মী দাবি করে যুগান্তরকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে গড়া ছাত্রলীগ এ ধরনের কর্মকাণ্ড করতে পারে না। যারা এসব করে, তাদের কোনো দল নেই। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের জিরো টলারেন্স। বিয়ানীবাজারের ঘটনা যে বা যারাই ঘটিয়ে থাকুক, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। এদিকে নিহত খালেদ আহমদ লিটুর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য দুপুরেই ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ রাতেই বিয়ানীবাজারের নোয়াগ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আবুল কাশেম পল্লব এবং জেলা ছাত্রলীগের আপ্যায়নবিষয়ক সম্পাদক পাভেল মাহমুদ দীর্ঘদিন ধরে বিয়ানীবাজারে ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। আর দুটি গ্রুপের সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গ্রুপের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। পাভেল  ও পল্লব মন্ত্রীবিরোধী হওয়ায় উভয় গ্রুপের মধ্যে সুসম্পর্কও রয়েছে। তাই এই খুন নিয়ে বিয়ানীবাজারবাসীর মধ্যে রহস্যের জন্ম দিয়েছে। এদিকে শিক্ষামন্ত্রীর এলাকায় এবং কলেজের কক্ষে এ ধরনের ঘটনা ঘটায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম নিয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষামন্ত্রীর এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের অস্ত্রের মহড়া অভিভাবকদেরও উদ্বেগের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.