আওয়ামী লীগ নিয়ে অভাজনের ভাবনা

আওয়ামী লীগ নামের দলটির বাঘা বাঘা প্রাজ্ঞ নেতার দল পরিচালনা ও সরকার পরিচালনা নিয়ে মন্তব্য করা, আলোচনা করা বা পরামর্শ দেয়ার মতো যোগ্যতা ও ধৃষ্টতা আমার নেই। বরঞ্চ কিঞ্চিৎ ভীতি থাকতে পারে। এর হাজার কারণের একটি হিসেবে ৭ জুলাইয়ের রাতের একটি টিভি রিপোর্টিং উল্লেখ করা যায়। জানা গেল এবং ছবিতে দেখা গেল ময়মনসিংহে এর আগের দিন হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি এক যুবলীগ কর্মীকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। পুলিশের এই ঔদ্ধত্যে ক্ষেপে গেছে যুবলীগ নেতাকর্মীরা। তারা চড়াও হয়েছে পুলিশের ওপর। আসামি সতীর্থকে ছিনিয়ে নিয়েছে। এখানেই শেষ নয়, ‘অপরাধী’ পুলিশের শাস্তি দিতে পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ করে তছনছ করে দিয়েছে যুবলীগের কর্মীরা। অসহায় পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে ভয়ার্ত চোখে। যেখানে স্থানীয় ছোট নেতাদেরই এমন দাপট, সেখানে বড়দের কাজের সমালোচনা করি কোন সাহসে! কিন্তু একেবারে নিশ্চুপ থাকাও কঠিন। মুক্তিযুদ্ধ কাছে থেকে দেখেছি। পাকবাহিনী আর বিহারিদের ধ্বংসলীলায় আমার বিপর্যস্ত পরিবারের মুখ সেই কিশোর বয়সে যেভাবে বুকে রেখাপাত করেছিল তা এখনও বয়ে বেড়াচ্ছি। বঙ্গবন্ধু কীভাবে বাঙালির রক্তে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন তা তো মুছে ফেলার নয়। তাই মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়া দল আওয়ামী লীগ ছাড়া আমাদের রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার জায়গা আর কোথায় আছে? তাই আমরা যেহেতু অতি সাধারণ এবং দলবাজ নই, দেশপ্রেম আমাদের একমাত্র শক্তি- এ কারণে আমরা চোখ বন্ধ করে ‘দল জিন্দাবাদ’ বলতে পারি না। জানি জাতির ত্রাণের জন্য রাজনৈতিক শক্তিই প্রধান ভূমিকা পালন করে। এ কারণে রাজনীতি নিন্দার নয়, অতি জরুরি বিষয়। রাজনীতিকগণ কষ্ট করে, সংগ্রাম করে, নানা ঝড়ঝাপ্টা মোকাবেলা করে আমাদের জন্য সুখ এনে দেবেন আর নিরাপদ আশ্রয়ে বসে আমরা তা আকণ্ঠ পান করব এমন সুবিধাবাদী হতে চাই না। কিন্তু আমাদের মতো অতি সাধারণদের রাজনীতিতে অবদান রাখার পথ কি খোলা আছে? ন্যায়নিষ্ঠ আদর্শ নিয়ে যারা মাঠ পর্যায়ে রাজনীতি করে দলকে এগিয়ে নিয়েছিলেন আজ তাদের অবস্থান কোথায়? ভুইফোঁড় আওয়ামী লীগারের অভাব নেই। নতুন আওয়ামী লীগার হতে অর্থ-বাণিজ্য লাগে আর পুরনো আওয়ামী লীগার দলের মৌলিক আদর্শ ভুলে বড় ব্যবসায়ী হয়ে যান। প্রভাব খাটিয়ে নামে-বেনামে শত শত কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নেন। জমি দখল করেন, অবৈধ চিংড়ি ঘের বানান। যারা নিবেদিতপ্রাণ আওয়ামী লীগের নেতা, আওয়ামী লীগের মৌলিক আদর্শকে ধারণ করতে চান, এসব দেখে তাদের অন্তর কাঁদে ঠিকই; কিন্তু অবস্থা পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারেন না। আমরা বহুবার বলেছি-লিখেছি বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তবতায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একমাত্র আওয়ামী লীগই আছে, যে দল সুস্থ রাজনীতির ধারা ফিরিয়ে আনতে পারে। আওয়ামী ঘরানায়-পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধায় নিবেদিত এমন সৎ মানুষদের বন্ধু বানানো উচিত আওয়ামী লীগের। ভালোর জোয়ারে মন্দ হারিয়ে যাবে। একদিনে নয়, বহু বছরে। আমরা সবাই নগদ ফল ভোগ করতে চাই। ভবিষ্যতের জন্য ফলগাছ রোপণে আনন্দ কম নয়। যদিও আমরা শেষ পর্যন্ত একটি দমবন্ধ করা রাজনৈতিক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছি। এ কারণে আওয়ামী লীগ পথ হারালে বুকের ভেতর হায় হায় করে ওঠে। তারপরেও পর্দার অন্তরালে থেকে আমরা শুভ কামনা করি আওয়ামী লীগের জন্য। আসলে যা লিখতে যাচ্ছি এর একটি উৎস রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে একজন সহকর্মীর মন্তব্য আমাকে বেশ ভাবিয়ে দিয়েছে। একটি জন্মদিন পালন অনুষ্ঠানে আমাদের একজন প্রবীণ অধ্যাপক এসেছিলেন। তিনি আমার মতোই ঢোঁড়াসাপ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে কখনও যুক্ত থাকেননি। কিন্তু এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই, তিনি মনেপ্রাণে আওয়ামী লীগের সমর্থক। এক বিশ্ববিদ্যালয়েই আমরা পড়াশোনা করেছি। তিনি আমার সিনিয়র ভাই। তিনি বিরক্ত হয়ে বর্ণনা করছিলেন তার কষ্টের অভিজ্ঞতা। বেশ কয়েকটি কাজ নিয়ে ঢাকা গিয়েছিলেন। যানজট, বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় জলজট, খোঁড়াখুঁড়ি আর ভাঙাচোরা রাস্তায় তিনি এখন কোমর নাড়াতে পারছেন না ব্যথায়। হয়তো টাটকা দুর্ভোগ পোহানোর কারণে তার ক্ষোভটাও বেশি ছিল। তারপরেও তিনি যেভাবে সরকারের সমালোচনা করলেন তা খুব হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। অধ্যাপক সাহেব বললেন, আওয়ামী লীগ সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিকতা ও চেষ্টায় দেশে দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু তা কি মানুষকে স্বস্তি দিতে পারছে? যারা সমালোচনার দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেন তারা বলছেন, কৃষকের ঘাম ঝরানো উৎপাদনে এবং প্রবাসী কর্মজীবীদের পাঠানো রেমিটেন্সে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে। সরকারের অবদান কতভাগ তা নির্ণয় করলে প্রকৃত ছবি ভেসে উঠবে। আমি মনে করি সরকারের অবদান একেবারে খাটো করলে ঠিক হবে না। উন্নয়নের সড়ককে গতিশীল করায় অবশ্যই সরকারের ভূমিকা আছে। প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তা না থাকলে হয়তো পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হতো না। সেতুটি হয়ে গেলে উন্নয়নের অনেকগুলো পথ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই খুলে যাবে। বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নতি তো দৃশ্যমান। কিন্তু এসব কৃতিত্বের ফসল কি শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নির্বাচনে ঘরে তুলতে পারবে? ঢাকা ও চট্টগ্রামবাসী এবার অতি বৃষ্টিতে সিটি কর্পোরেশনগুলোকে ব্যর্থ হতে দেখেছে। বছর ধরে উন্নয়নের নামে পরিকল্পনাহীন খোঁড়াখুঁড়িতে বেহাল-বিধ্বস্ত নগরবাসী। ওয়াসার পানি ও গ্যাসের সংকট তো নিত্যসঙ্গী। যানজটে নাকাল নগরবাসী। শহরতলীতে রাস্তাঘাট আর ড্রেনেজ ব্যবস্থার নাজুক অবস্থা। প্রাকৃতিক জলাধারগুলো একে একে দখল হয়ে যাচ্ছে সরকারি দলের ছত্রছায়ায়। এসবের ওপর কোনো দলীয় বা রাষ্ট্রীয় শাসন নেই। হাওর এলাকাসহ দেশের নানা অঞ্চলে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় দুর্নীতির চিত্র সামনে চলে এসেছে। সংসদ সদস্য বা মন্ত্রীদের ওপর সাধারণ মানুষের কতটা আস্থা রয়েছে তা কি দায়িত্বশীলরা খোঁজ করেছেন কখনও? ব্যাংকের হাজার কোটি টাকা তসরুপ হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ দেখছে সরকারি দলের তকমাধারীরা কিভাবে ঋণ খেলাপি হয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। সব ক্ষেত্রে ঘুষ-দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত দশা। ছাত্রলীগের তাণ্ডবে অতিষ্ঠ ভুক্তভোগীরা। সেদিন পত্রিকায় রিপোর্ট বেরোল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাই কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে যথেষ্ট বিত্তশালী বলে অভিযোগ করছে। সাধারণ মানুষের নিশ্চয়ই অজানা নয় এসব তথ্য। কঠিন বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে বলতেই হবে, সুশাসনের অভাব সরকারের সব অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে। অতীত ইতিহাস সামনে নিয়ে এলে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বিএনপির ভূমিকা আছে তা বলার উপায় নেই। জিয়াউর রহমানের সময় থেকেই ত্যাগী-পরীক্ষিত রাজনৈতিক নেতাদের কোণঠাসা করে ভুইফোঁড় ব্যবসায়ীদের দিয়ে দল গড়া আর খালেদা জিয়ার সময় তরুণ অথচ ‘বড় নেতা’ তারেক রহমানের গড়া হাওয়া ভবনের দুর্নীতির কথা মানুষের সামনে উন্মোচিত হয়েছিল। ২১ আগস্টের পৈশাচিক গ্রেনেড হামলাকেও সহজে মানুষের মন থেকে মুছে ফেলা যাবে না। সবশেষে ২০১৪-এর নির্বাচনকে ঘিরে জামায়াত-বিএনপির অমানবিক ছবি তো এখনও স্পষ্ট। ফলে বিএনপির কাছ থেকে সাধারণ মানুষ সুশাসন প্রত্যাশা করে না। এমন এক বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। তারপরও এই জায়গায় এসে এখন মানুষের অস্বস্তি অনেক। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার দম্ভ স্থানীয় ও বড় নেতাদের অনেককে পেয়ে বসেছে।
এমপি-মন্ত্রীদের অনেকেই সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার মানুষদের সঙ্গে তেমন একটা সম্পৃক্ততা তৈরি করেননি। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, আওয়ামী লীগ- সব লীগের পেশিশক্তি মানুষকে শঙ্কিত করে তুলছে। এদের অনেকের সৃষ্ট সন্ত্রাস, দখলবাণিজ্য, দুর্নীতি ইত্যাদি কারণে কোনো না কোনোভাবে ভুক্তভোগী হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এসব কারণে অন্যদের কথা বাদ দেই, আওয়ামী লীগের শুদ্ধ নেতারাই হতাশ। এ অবস্থা নির্বাচনে প্রভাব না ফেলে পারে না। প্রতিপক্ষ দুর্বল ভেবে আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্ত মানসিকতার নেতাকর্মীরা যদি নিজেদের না শুধরে এখনও দাপটে বেড়ান, আর দল পরিচালকরা মহানন্দে শীতঘুম দেন, তবে দুঃস্বপ্ন দেখার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। নির্বাচনের মাঠে কি শুধু বিএনপি থাকবে? এখানে জাতীয় পার্টির জোট, তৃতীয় ধারার জোট- সবার অনেক বিকল্প প্রার্থী থাকবে। এ সময়ের বাস্তবতায় আমাদের মনে হয় অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ ভোটারের বড় অংশ যারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিতে পছন্দ করত, তাদের অনেকেই এবার মার্কাকে ভোট দেবে না। পছন্দের মার্কা কপালের তিলক হলেও প্রার্থী পছন্দ না হলে সেদিকে ভোটার ফিরে তাকাবে না। ভুক্তভোগী এবং বিতৃষ্ণ মানুষ দল নির্বিশেষে পছন্দের প্রার্থীই বেছে নেবে। নির্বাচনে আমাদের দেশের বিশেষ গণতান্ত্রিক বাস্তবতায় ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’ বলে একটি কথা সবাই জানে। এ সময়ের বাস্তবতায় এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিসীমায় এবার ব্যাপকভাবে এই ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভাব ফেলতে পারবে বলে আমাদের মনে হয় না। আমাদের বিশ্বাস আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা এবার পরিশুদ্ধ নির্বাচনই প্রত্যাশা করেন। ফলে জনগণের কাছে যাওয়ার বিকল্প নেই। আগেই বলেছি, উন্নয়নের ঔজ্জ্বল্য নানা অন্যায়ের ধুলোবালিতে মানুষের মনে এখন আর ততটা জ্বলজ্বল করছে না। ফলে নির্বাচনের মাঠে আওয়ামী লীগ শতভাগ ফসল ঘরে তুলতে পারবে না। সরকারের সুশাসনের অভাবটাই ভুক্তভোগী মানুষ এখন বড় করে দেখছে। সামনের দেড় বছরে সরকার সুশাসনের পথে হাঁটাকে কিছুটা দৃশ্যমান করতে পারে। আর এর সুফল মানুষ যদি কিছুটা ভোগ করতে পারে, তবে আবার আস্থার জায়গাটি অনেকটা ফিরে আসবে। বিশ্বাস রাখতে হবে বাংলাদেশের মানুষ প্রতিদান দিতে জানে। অতীতের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সব নির্বাচনে এদেশের ভোটার বরাবরই সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছে।
এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnaway7b@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.