কাতার সংকটের অবসান চায় বাংলাদেশ

কাতার ইস্যুতে দৃশ্যত কোনো অবস্থান ব্যক্ত না করলেও সমঝোতার মাধ্যমে এ সংকটের অবসান চায় বাংলাদেশ। উপসাগরীয় অঞ্চলে সন্ত্রাসে মদদ দেয়ার অভিযোগে সৌদি আরবের নেতৃত্বে সাতটি মুসলিম দেশ কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। এসব দেশসহ মধ্যপ্রাচ্য বাংলাদেশের জনশক্তির বড় বাজার। অপরদিকে, বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে অনেক বেশি কর্মী কাতারে যাচ্ছে। ফলে সংকটের অবসান হলে বাংলাদেশ লাভবান হবে। তাছাড়া মুসলিম উম্মাহর বিভাজন পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এসব কারণে বর্তমান সংকটের অবসান ঘটিয়ে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য চায় বাংলাদেশ। যে দেশগুলো কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে সেগুলো হল- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, বাহরাইন, ইয়েমেন, লিবিয়া ও মালদ্বীপ। কাতার ইস্যুতে সৃষ্ট পরিস্থিতির ওপর সার্বক্ষণিকভাবে নজর রাখছে বাংলাদেশ। সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ ওই অঞ্চলের দেশগুলোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতরা পরিস্থিতির ওপর প্রতিবেদন ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাচ্ছেন। সৌদি আরবে বাংলাদেশের প্রায় ১৮ লাখ কর্মী কর্মরত। উপসাগরীয় অন্য দেশেও বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক কর্মী আছেন। অপরদিকে, কাতারে বাংলাদেশের কর্মী আছেন তিন লাখ ৮০ হাজার। প্রতি মাসেই ১০ থেকে ১২ হাজার বাংলাদেশি কর্মী কাতারে যাচ্ছেন। ২০২২ সালে কাতারে বিশ্বকাপ ফুটবল অনুষ্ঠিত হবে। সেখানেও বাংলাদেশের কর্মীদের প্রয়োজন হবে। এছাড়া সম্প্রতি কাতারের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি চুক্তি হয়েছে যার অধীনে এক দশমিক আট বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকে গচ্ছিত রাখবে কাতার। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বাংলাদেশের জন্যে ক্ষতিকর। মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশ সৌদি আরব ও ইরান পরস্পরের বৈরী অবস্থানে থাকলেও উভয়ের সঙ্গেই বাংলাদেশের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, সৌদি আরবের সঙ্গে কাতারের একটা টানাপোড়েন আছে- এটা আমরা সবাই জানি।
কিন্তু এটা সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর্যায়ে যাবে সেটা আমরা কল্পনাও করিনি। হঠাৎ করেই এটা হয়ে গেছে। তবে আমি এটা ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এ সমস্যা স্থায়ীভাবে থাকবে না। ফলে সৌদি আরবের কথায় আমাদের কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা ঠিক হবে না। তিনি আরও বলেন, কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেখানে বাংলাদেশের যে কর্মীরা আছেন তারা যাবেন কোথায়? কাতার ছোট দেশ হলেও বাংলাদেশের কর্মী সেখানে অনেক বেশি। এখন সম্পর্ক ছিন্ন করলে, পরে যদি সম্পর্ক ঠিক হয়েও যায়, কাতার সেটা ভুলবে না। ফলে আমাদের ক্ষতি হবে। তাই আমাদের এমনভাবে চলতে হবে যে, সৌদি আরব ও কাতার উভয়ের সঙ্গেই সম্পর্ক ঠিক থাকে। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছুটা দৃঢ় হতে হবে। আর দৃঢ় হলেই যে ক্ষতি হবে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। জানতে চাইলে কাতারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আসুদ আহমেদ মঙ্গলবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, আমরা পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। এখন পর্যন্ত কুয়েতের আমীরের সমঝোতার উদ্যোগ ছাড়া পরিস্থিতির বড় কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমাদের এখন অপেক্ষা করে দেখা ছাড়া তেমন কিছু করার নেই। পরিস্থিতির প্রতি আমাদের নজর থাকবে। এদিকে কাতারে কর্মরত বাংলাদেশিদের আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে দোহার বাংলাদেশ দূতাবাস। মঙ্গলবার বাংলাদেশ দূতাবাসের বিশেষ এক বিজ্ঞপ্তিতে এ পরামর্শ দিয়ে বলা হয়, কাতার ও উপসাগরীয় অন্য কয়েকটি দেশের মধ্যে উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ দূতাবাস। পরিস্থিতির পরিবর্তিত প্রেক্ষাপট পর্যবেক্ষণ ও যথাযথ বিশ্লেষণের মাধ্যমে দূতাবাস বাংলাদেশিদের করণীয় সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দেবে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কাতার প্রবাসী বাংলাদেশিদের একক কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয় বিজ্ঞপ্তিতে। সম্প্রতি কাতারের বার্তা সংস্থার ওয়েবসাইটে দেশটির আমীরের বরাত দিয়ে সৌদি আরব এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্পর্কে সমালোচনা করে দেয়া মন্তব্য দেখা যায়। সেখানে ইরান ও মুসলিম ব্রাদারহুডের পক্ষে বক্তব্যও দেখা যায়। এ নিয়ে সৌদি আরবসহ তাদের মিত্র দেশগুলোতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। কাতার অবশ্য এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেছে, হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ওয়েবসাইটে আমীরের এসব মন্তব্য জুড়ে দেয়া হয়েছে। কাতার এটাকে ভয়াবহ ‘সাইবার ক্রাইম’ হিসেবে অভিহিত করছে। সৌদি আরবের সঙ্গে কাতারের সম্পর্কে কিছুটা আস্থার অভাব থাকলেও তাদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার মতো বড় মতবিরোধ নেই। বরং সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবিরোধী জোটে কাতার অন্যতম শরিক দেশ। তাছাড়া, কাতারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি রয়েছে। এ বিষয়ে ঢাকার একজন ওয়াকিবহাল কূটনীতিক যুগান্তরকে বলেন, কাতারের সঙ্গে সৌদি আরবের ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টিতে মিসরের ভূমিকা থাকতে পারে। কেননা মিসরের সঙ্গে কাতারের বিরোধ রয়েছে। মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট মুসলিম ব্রাদারহুডের মোহাম্মদ মুরসির প্রতি কাতারের সহানুভূতি রয়েছে। তাছাড়া, কাতারের আলজাজিরার দু’জন সাংবাদিককে মিসরের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ সিসির সরকার জেলে আটকে রাখা নিয়েও দু’দেশের মধ্যে উত্তেজনা ছড়ায়। সৃষ্ট সংকটের পর ইতিমধ্যে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন স্থল ও আকাশপথে কাতারের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। কাতার থেকে কূটনীতিক প্রত্যাহার ও কাতারের কূটনীতিকদের বিতাড়নের নির্দেশ দিয়েছে দেশগুলো। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সৌদি সফরের ২ সপ্তাহের মাথায় এ সংকটের শুরু। রিয়াদে আরব-ইসলামিক সম্মেলনে ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছিলেন। এ বিষয়ে কাতার বলেছে, প্রতিবেশীদের এ আচরণ দুঃখজনক। এদিকে কুয়েতের আমীর বর্তমান সংকট নিরসনে মধ্যস্থতা করতে আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। কাতার এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। মধ্যস্থতার প্রস্তাব নিয়ে কুয়েতের আমীর শিগগিরই সৌদি আরব সফরে যেতে পারেন।

No comments

Powered by Blogger.