কর ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা

ধ্রুপদী অর্থনীতির জনক অ্যাডাম স্মিথ আদর্শ কর ব্যবস্থাপনার চারটি বৈশিষ্ট্যের তত্ত্ব দিয়েছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে, ন্যায়পরায়ণতা, নিশ্চয়তা, সুবিধা ও মিতব্যয়িতার নীতি। কিন্তু বর্তমানে তা যেন বারবার হোঁচট খাচ্ছে। রাজস্বনীতি কাঠামোতে এসব নীতির তেমন প্রতিফলন হচ্ছে না। যদিও বিভিন্ন সময়ে অর্থনীতিবিদরা কর ব্যবস্থাপনায় আরও ৫টি বৈশিষ্ট্য যুক্ত করেছেন। এগুলো হচ্ছে উৎপাদনশীলতা, সম্প্রসারণশীলতা, সরলতা, বহুমুখিতা আর নমনীয়তার নীতি। এসব নীতি কর কাঠামোতে তেমন স্থান পাচ্ছে না। আয় হবে কিনা, তার নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু তাতে কী, উৎসে কর কেটে রাখা হবে। প্রত্যক্ষ কর বলা হলেও চরিত্রগত অবস্থা বিবেচনায় এটা পরোক্ষ কর। যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান ব্যবস্থায় উৎসে কর পরিশোধ করে থাকে, তা তার সেবা বা পণ্যমূল্যে যোগ করে দেয়। যা শেষ পর্যন্ত ক্রেতা-ভোক্তাকে পরিশোধ করতে হচ্ছে। রাজস্ব বোর্ড আবারও এ ধরনের উৎসে কর আদায়ে বেশ উৎসাহী। বাড়ছে ব্যাপ্তি ও পরিমাণ। প্রায় দেড়শ’ বছর আগে করবর্ষ নির্ধারণ করা হয়েছে। এক অর্থবছর শেষ হলে পরের অর্থবছরে কর আদায় করা হবে।
প্রত্যক্ষ আয়কর ব্যবস্থাপনায় এটা মেনে নেয়া হয়। কিন্তু উৎসে করের বিধানে আছে জটিলতা। এখানে বছরের হিসাব তো দূরের কথা, তাৎক্ষণিকভাবে কর কেটে নেয়া হয়। এ ধরনের খাতের সংখ্যাও বেশ। এর মধ্যে আছে- বেতন থেকে আয়, সুদ খাতে আয়, মাল সরবরাহের জন্য ঠিকাদারদের আয়, আমদানি বা রফতানি খাতে আয়, জনশক্তি রফতানির ফলে আয়, ব্যাংকের সঞ্চয়ী ও স্থায়ী আমানতের ওপর সুদ খাতে আয়, বীমা কমিশন বাবদ প্রাপ্ত আয়, মূলধনী লাভ খাতে আয় ইত্যাদি। উৎসে কর বেশি দিলে সহসা ফেরত পাওয়া বেশ কষ্টকর। নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হয় বলে উৎসে কর প্রদানকারী প্রায়ই বঞ্চিত হয়ে থাকেন। এখন কর কর্তনের দুই সপ্তাহের মধ্যে তা ট্রেজারি চালানে জমা দিতে হয়। এর পাশাপাশি উৎসে কর কর্তনের বিবরণী নির্ধারিত সময়ে দাখিল করতে হবে সংশ্লিষ্টকে। এসব করতে প্রয়োজন বাড়তি জনবলের। আর এতে বেড়ে যায় ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ। প্রত্যক্ষ কর ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় সংস্কার আনা যায়নি। যার কারণে দেখা যাচ্ছে, প্রত্যক্ষ করের চেয়ে পরোক্ষ করে সরকারের আস্থা বেশি। ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সরকারের প্রশংসা করেছে। চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সংস্থাটি জানিয়েছে, রাজস্ব আদায়ের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য ‘বিচ্যুত’ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। যে সংস্থার চাপে-পরামর্শে জনদুর্ভোগ উপেক্ষা করে আইন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, তাদের এ ধরনের অভিমত রাজস্ব ব্যবস্থাপনার নানা অসংগতির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বিচ্ছিন্নভাবে সংস্কার করা হয়েছে, তবুও এখন হালে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। আগামী বছর ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হলে পরবর্তীকালে আসবে আয়কর আইন। আইএমএফের পরামর্শে করা ভ্যাট আইনে রাজস্ব বোর্ড ও তার কর্মকর্তাদের দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, ‘এই আইন বা তদধীন প্রণীত কোনো বিধির অধীনে সরল বিশ্বাসে কৃত কোনো কার্যের ফলে কোনো ব্যক্তির ক্ষতিগ্রস্ত হইবার সম্ভাবনা থাকিলে তজ্জন্য বোর্ড বা উহার কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো আইনগত কার্যধারা দায়ের বা রুজু করা যাইবে না।’ দেশের প্রচলিত আইনে প্রতিকার আর মিলবে না, বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে রাজস্ব বোর্ডের কাছে বারবার সহযোগিতা চাইতে হবে। এনবিআরের এই ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার প্রবণতাও ব্যবসায়ী মহলে ভীতি ছড়াচ্ছে। ভ্যাট ও বিক্রয় কর বিতর্কের নিরসন হওয়াও জরুরি। মূল্য সংযোজনের ওপর কর নির্ধারণ করা হচ্ছে ভ্যাট আইনের মূলমন্ত্র। তবে নতুন আইনে দেখা যাচ্ছে ভ্যাট নির্ধারণ হবে বিক্রয় মূল্যের ওপর। অনেক সময় দেখা যায়, উৎপাদন খরচ যাই হোক, মূল্য সংযোজনের হার বাড়িয়ে দেখানো হয়। অর্থাৎ ৫০ টাকা উৎপাদন ব্যয় হলেও হয়তো একশ’ টাকায় বিক্রি করা হতে পারে। আর ৮০ টাকা উৎপাদন ব্যয়ের পণ্য আবার ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এতে ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে ১০০ টাকার ওপরে অর্থাৎ বিক্রয় করের ভিত্তিতে, মূল্য সংযোজনের মৌলিক হিসাবে নয়। এটাকে সাম্যতার পরিপন্থী মনে করছেন অনেকে। আর ভ্যাট ফেরত পেতে যেভাবে হিসাব সংরক্ষণ করতে হয়, সে পদ্ধতি দেশে তেমন বিস্তৃত নয়। এ কারণে ভ্যাট পরিশোধ করলে সরকারের কোষাগারে পৌঁছাবে, তার নিশ্চয়তা কতটুকু? বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ভ্যাটসহ যে কোনো ধরনের পরোক্ষ কর সামাজিক এবং আর্থিক বৈষম্য দূর করে থাকে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাজেট বক্তৃতার নবম অধ্যায়ে স্থান দিয়েছেন রাজস্ব সংক্রান্ত বিষয়। এর ৪০টি অনুচ্ছেদের মধ্যে আয়কর সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ মাত্র ১৮টি। অথচ অর্থবিলে যে ৭৩টি ধারা আছে, তার মধ্যে আয়কর সংক্রান্ত বিষয় ৪৮টি। এবারের অর্থবিলে আয়করের মৌলিক বিষয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে। যেমন ‘আয়’-এর সংজ্ঞা, ‘করযোগ্য সত্তা’-এর সংজ্ঞা।
আনা হয়েছে উৎসে আয়কর কর্তন সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু পরিবর্তন। আয়কর সংক্রান্ত প্রস্তাবনায় মূল ফোকাস উৎসে আয়কর সংগ্রহ সুদৃঢ় করা। ৫৫টি খাতে উৎসে আয়কর কর্তন বা সংগ্রহ করা হয়। উৎসে সংগৃহীত আয়করের বিভিন্ন খাতের জন্য ভিন্ন ভিন্ন করহার আছে। রাজস্ব ফাঁকির তথ্য উদ্ঘাটনে প্রণোদনা দেয়ার বিধান চালু রেখেছে এনবিআর। কিন্তু কেন জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে প্রণোদনা দেয়া হয়। আইনি কাঠোমোর মাধ্যমে দেয়া হলে এর নৈতিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। একজন কর্মকর্তার কাজ কী তা তার নিয়োগবিধিতে স্পষ্ট উল্লেখ থাকে। রাজস্ব ফাঁকি রোধের পাশাপাশি করদাতাকে আইনি বলয়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করাই তো তার প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে তথ্য উদ্ঘাটনে প্রণোদনা কেন? ব্যাংক আমানতে আবগারি শুল্ক আরোপের বিরোধিতায় সরব হয়েছে সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিরা। সংসদের বাজেট অধিবেশনে অনেক সরকারদলীয় সংসদ সদস্য প্রশ্ন তুলেছেন, কেন আমানতে এই আবগারি শুল্ক? মদ, বিয়ার ও সিগারেটের মতো পণ্যে আবগারি শুল্ক আদায় করে অনেক দেশ। এর বাইরে, আমদানিকৃত কিংবা দেশে উৎপাদিত বিশেষ পণ্যে এ ধরনের কর আরোপ করতে পারে সরকার। নব্বুইয়ের আগ পর্যন্ত এ প্রচলন ছিল বাংলাদেশেও। আবগারি শুল্ক আদায় হয় ১৯৪৪’র আবগারি ও লবণ আইনের অধীনে। এতেও উত্তেজক পণ্যবিশেষে কর আদায়ের কথা বলা হয়েছে। পরে, ২০০৪ সালে আগের ধারা বাতিল করে শুধু ব্যাংকে ব্যক্তিসঞ্চয় ও অভ্যন্তরীণ বিমান টিকিটের ওপর আবগারি শুল্ক বহাল রাখে রাজস্ব বোর্ড। কর হার সমন্বয়ও করা হয় একাধিকবার। ১৯৯১-৯২ অর্থবছরের বাজেটে ১ লাখ টাকা আমানতের ওপর দেড়শ’ টাকা আবগারি শুল্ক আরোপ করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান। পরে ৬ বার এ শুল্ক বাড়ানো হলেও তা বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করা হয়নি। ফলে অনেক আমানতকারী জানেনই না এ করের কথা। আগামী অর্থবছরে আবগারি শুল্ক থেকে ৯২৫ কোটি টাকা আদায় করতে চায় সরকার, যা মোট রাজস্ব আয়ের মাত্র দশমিক তিন শতাংশ। আবগারি শুল্ক আরোপের ফলে সুদূরপ্রসারী বিরূপ প্রভাবের আশঙ্কা রয়েছে যথেষ্ট। ব্যাংকবিমুখ হয়ে পড়ার প্রবণতা তৈরি হতে পারে। আর এভাবে শুল্ক আরোপের ফলে দেখা যাবে, একজন সম্পদশালী তার অব্যবহৃত টাকা ব্যাংকে রাখলে যে অর্থ কাটা হবে, পেনশনভোগী বা জীবন সায়াহ্নে জমানো টাকা যিনি রাখবেন, তার অর্থও সমভাবে কাটা হবে। এ তো ন্যায্যতার পরিপন্থী। টাকা কেটে রাখার দুঃশ্চিন্তায় হয়তো সমাজে অনেকে অনানুষ্ঠানিক খাতে বিনিয়োগ করার চিন্তা করবে। লগ্নিকৃত অর্থ ফেরত আনতে জোরজবরদস্তির মুখে পড়তে পারেন সাধারণ মানুষ। যা আরও আইনি জটিলতা তৈরি করতে পারে।
সাজ্জাদ আলম খান : সাংবাদিক
sirajgonjbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.