রাজনীতির পরিভাষার রূপান্তর

‘বিপ্লব’, ‘বৈপ্লবিক’, ‘বৈপ্লবিকতা’ ইত্যাদি শব্দ হামেশা ব্যবহারের ফলে এই শব্দগুলো ক্লিশে হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ ব্যবহারে ব্যবহারে জীর্ণ, অনেকটা ছেঁড়া টাকার মতো। অথচ জাতীয় টাঁকশাল থেকে ছাপা টাকা সবসময়ই বৈধ। ছেঁড়া টাকা এখনও বিনিময়ের বৈধ মাধ্যম, কিন্তু বাজারে সেই টাকা চলে না, কেনাবেচা কঠিন হয়ে পড়ে। ছেঁড়া টাকা সহজে কেউ নিতে চায় না। তেমনি পরস্পরের মধ্যে চিন্তার বিনিময়ের জন্য কিছু উপযুক্ত ভাষা-পরিভাষার দরকার আছে, চিন্তার টাঁকশাল থেকেই তাদের উৎপত্তি। কিন্তু অতি ব্যবহারে সেটিও যখন জীর্ণ হয়, তখন যার সঙ্গে ভাবের বিনিময় ঘটাতে চাই তিনি তা বিশেষ কবুল করতে রাজি হন না। সেই ক্ষেত্রে ভাষা ও পরিভাষার মধ্যেও বদল আনা জরুরি হয়ে পড়ে। নতুন পরিভাষার দরকার হয়, কিংবা ছেঁড়া টাকা টাঁকশাল থেকে বদলিয়ে ঝকঝকে নতুন ছাপা টাকা নিয়ে চিন্তার বাজারে কেনাবেচায় নামতে হয়। ক্লিশে পরিভাষাগুলোর হয়েছে সেই দশা। তবে পরিভাষাগুলো এখনও গুরুত্বপূর্ণ। কেউ যখন ব্যবহার করে তখন ব্যবহারকারীর আকাক্সক্ষার দিকটা বোঝা খুব একটা কঠিন নয়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কোন ?অর্থে? রোমান্টিক ভাবাবশে ‘বিপ্লব’ সম্পর্কে পুরনো চিন্তা আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য নয়। বরং বদ্ধমূল ধ্যানধারণার কঠোর ও নির্মোহ পর্যালোচনার জন্য। সমাজ, রাজনীতি, রাষ্ট্র, আইন, ক্ষমতা ইত্যাদি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা ইতোমধ্যে বহুদূর এগিয়ে গিয়েছে। নতুন নতুন প্রশ্ন উঠছে। পুরনো ভুল ও ব্যর্থতা নিষ্ঠার সঙ্গে পর্যালোচনার তাগিদ বেড়েছে। কেউ যখন বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কথা বলে তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওই বলার মধ্যে মৌলিক পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা থাকে। সেই ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন বলতে সুনির্দিষ্টভাবে কী চাওয়া হচ্ছে, তার দ্বারা কী ধরনের রূপান্তর কাম্য পরিষ্কার বোঝা দরকার।
বোঝা না গেলে ক্লিশে পরিভাষার ব্যবহার নিছকই কথার কথা মাত্র। বিদ্যমান অবস্থা কারও কাছে অসহ্য মনে হলে একদিন তার খোল-নলচে বদলে ফেলার আকাক্সক্ষা তৈরি হতেই পারে। সেটি বাস্তব দুর্দশার প্রতি মানুষের সাধারণ প্রতিক্রিয়া। কিন্তু সমাজ বদলের সমাজতত্ত্ব ও রাজনীতি এবং ক্ষমতা বা বলপ্রয়োগের দার্শনিক বিচার একালে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিষয়ে আমাদের সমাজে মনোযোগ, গবেষণা ও বিশ্লেষণ নাই বললেই চলে। বাংলায় বিপ্লব কথাটা আর দশটা পরিভাষার মতো পাশ্চাত্যের ‘রেভলিউশান’-র অনুবাদ হিসেবেই এসেছে। আধুনিক সমাজের গতিশীলতা, দ্বন্দ্ব ও অনিশ্চয়তা আমাদের প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে ছিল না। সমাজ একদমই নিশ্চল ছিল কিনা সেটি তর্কসাপেক্ষ, তবে আধুনিক সমাজের তুলনায় অনেক নিস্তরঙ্গ ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নাই। জাতপাত ও আভিজাত্যের সুস্পষ্ট পার্থক্যে বিভক্ত নিশ্চল সমাজকে কার্ল মার্কস নাম দিয়েছিলেন ‘প্রাচ্যের স্বৈরতন্ত্র’ (Oriental Despotism); জীবন ছিল নিয়তির হাতে ছেড়ে দেয়া উদ্যমহীন ব্যাঙের ছাতা, মার্কসের ভাষায় ‘মর্যাদাহীন, আটকে পড়ে থাকা উদ্ভিদমার্কা জীবন (undignified, stagnatory, and vegetative life’ that this passive sort of existence)। এই নিস্তরঙ্গ সমাজে ‘বিপ্লব’-এর কোনো ধারণা ও পরিভাষা গড়ে ওঠা অসম্ভবই বলা যায়। ফলে পাশ্চাত্যের ‘রেভুলিউশান’ অনুবাদ করে আমরা ‘বিপ্লব’ বানিয়েছি, এ অভিযোগ মিথ্যা নয়। রাজনৈতিক পরিভাষা হিসেবে রেভুলিউশানের বাংলা অনুবাদ ‘বিপ্লব’-এর মধ্যে ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯-৯৯) বৈপ্লবিকতা ধারণের চেষ্টা আছে। ইউরোপে গির্জা, পুরোহিত ও সামন্ত শ্রেণির একচ্ছত্র ক্ষমতা সাধারণ মানুষ সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ও আর্থ-সামাজিক সম্পর্ক থেকে উৎখাত করে; এরই চূড়ান্ত পরিণতিতে প্রাচীন রাজতন্ত্র (Monarchy) জনসাধারণতন্ত্রে (Republic) রূপ নেয়। পার্থক্য থাকলেও ‘রিপাবলিক’ বা জনসাধারণতন্ত্রকে আমরা সাধারণত গণতন্ত্র বলেই গণ্য করি। মনে করি, ইংল্যান্ড ও ইউরোপের সাংবিধানিক রাজতন্ত্রও আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একটি রূপ। এর মানে তাদের সাধারণ মিল থাকলেও বিশেষ বৈশিষ্ট্যের দিকে আমরা মনোযোগী থাকি না। ইংল্যান্ড নিজেকে ‘ইউনাইটেড কিংডম’ বা রাজাদের ‘যুক্তরাজ্য’ বলে। কিন্তু একে আমরা সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করি। ফরাসি বিপ্লবের আগে ইংল্যান্ডে সাধারণ মানুষের বিপ্লব ঘটেছে ১৮৮৮ সালে।
রাজা বা রানীর রাজকীয় ক্ষমতা ইংল্যান্ডে বিল অব রাইটস ১৬৮৯ এবং অ্যাক্টস অফ সেটেলমেন্ট ১৭০১ দ্বারা সীমিত। তাই ইংল্যান্ডকে সীমিত রাজতন্ত্রও বলা যায়। রাজা বা রানীর ক্ষমতা সীমিত করার ইতিহাস অবশ্য আরও অতীতে, ১২১৫ সালের ম্যাগনা কার্টায়। বিপ্লবে সাধারণ মানুষের বৈপ্লবিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায় সংবিধান ও আইনে রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র (Constitution) হিসেবে রূপ নেয়। গঠনতন্ত্র ‘ইংলিশম্যান’কে মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দান করে। আধুনিক পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলোতে রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্ম বা গির্জার সম্পর্ক নিয়েও বাংলাদেশে বিস্তর বিভ্রান্তি আছে। ইংল্যান্ডে চার্চ অফ ইংল্যান্ডকে বলা হয় ‘প্রতিষ্ঠিত গির্জা’ (Established Church), রাষ্ট্রের মধ্যেই তার প্রতিষ্ঠা। এখানে ধর্ম রাষ্ট্র থেকে আলাদা বলার সুযোগ নাই, কারণ আইনের চোখে গির্জা রাষ্ট্রের বাইরে নিছক সামাজিক বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়। পার্লামেন্টে বিশপ গির্জার প্রতিনিধিত্ব করেন। যে কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লিখিত গঠনতন্ত্রের প্রথম সংশোধনীতে পরিষ্কার উল্লেখ করা রয়েছে যে, ‘কংগ্রেস ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো আইন করবে না, কিংবা স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনে কাউকে বাধাও দেবে না...’, ইত্যাদি। মার্কিন আদালত একে সাধারণত ব্যাখ্যা করে- রাষ্ট্র সব সরকারি কর্মকাণ্ডে, স্কুলে বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে ধর্মকে আলাদা রাখবে কিংবা ধর্ম থেকে বিযুক্ত থাকবে, কিন্তু একইসঙ্গে সমাজে ধর্ম চর্চার স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। অন্যান্য আধুনিক সেকুলার রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো রাষ্ট্র ও ধর্মের বিযুক্তির ব্যাপারে এত কড়া নয়। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ধর্মীয় চরিত্রের দিক থেকে অতিশয় ধর্মীয় সমাজগুলোর অন্যতম। এই ঐতিহাসিক পার্থক্যগুলো মনে রাখলে সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক বিপ্লব বা গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলতে বোঝায় : সামন্ততন্ত্র বা প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক ক্ষমতা সম্পর্কের খোল-নলচে বদলে দেয়া, এর বিশেষ অর্থ হচ্ছে সামন্তশ্রেণী ও রাজরাজড়ার বিপরীতে ‘সার্বভৌম ক্ষমতা’র দাবি নিয়ে জয়ী ‘জনগণ’-এর ঐতিহাসিক আবির্ভাব। ‘জনগণ’ নিছকই একটি অক্ষর বা শব্দ নয়, অতএব একে আক্ষরিকভাবে বোঝার সুযোগ নাই। তাহলে ‘বিপ্লব’ কথাটা বুঝতে হলে জনগণের ঐতিহাসিক আবির্ভাব কথাটিকে ঐতিহাসিকভাবেই বুঝতে হবে। ইংরেজিতে ‘উই দ্য পিপল’ কথাটা একদিকে রাজনৈতিক ইতিহাস ও জনগণের লড়াই সংগ্রামের প্রেক্ষাপট যেমন বর্ণনা করে, একইভাবে জনগণের ঐতিহাসিক বিজয়ও ধারণ করে। এ ঘোষণা নিজেদের রক্ত, বর্ণ, ধর্ম, সম্প্রদায়, পরিচয় ইত্যাদি সব ধরনের সামাজিক বৈচিত্র্যের ঊর্ধে নিজেদের একটি একক ও অখণ্ড রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে হাজির করে। রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সামাজিক বৈচিত্র্য ও পরিচয় মুখ্য নয়, কারণ তা ঐক্য ও অখণ্ডতার বিপরীত। অন্যদিকে সমাজে এই বৈচিত্র্য, পার্থক্য ও পরিচয় ভেদ আছে বলেই জনগণকে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের পার্থক্য ঘোষণা করতে হয়। অর্থাৎ ঘোষণা দিতে হয় রক্ত, বর্ণ, ধর্ম,
সম্প্রদায়, পরিচয় ইত্যাদি সব ধরনের সামাজিক বৈচিত্র্য ও পার্থক্য সত্ত্বেও আমরা রাজনৈতিকভাবে এক ও অখণ্ড সত্তা এবং বিশ্বের অন্যান্য রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা। এই ঐক্য ও অখণ্ডতা বজায় ও রক্ষার জন্য একটি গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্রের (Constitution) ভিত্তিতে আমরা নিজেদের আবির্ভাব ঘোষণা করছি এবং একটি মূর্ত রাষ্ট্রের রূপ ও অস্তিত্ব নিয়ে হাজির হয়েছি। রাজনৈতিকভাবে এক ও অখণ্ড রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে হাজির হওয়ার এই রাজনৈতিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ই হচ্ছে রাষ্ট্রের ন্যায্যতা ও সিদ্ধতা যা গঠনতন্ত্রে বিধৃত থাকে। উই দ্য পিপ্ল বা বাংলাদেশের সংবিধানের ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ...’ কথাটার একটা অর্থ দাঁড়ায়। তাহলে দেখা যাচ্ছে জনগণের বিজয়ী গণঅভ্যুত্থানের রাজনৈতিক অর্থ হচ্ছে (ক) নিজেদের এক ও অখণ্ড রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিগঠন; (খ) গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র প্রণয়ন এবং (গ) গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন। দ্বিতীয়ত, জনগণের ঐতিহাসিক আবির্ভাব বা জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার মানে দাঁড়ায় ধর্মের নামে বা ঈশ্বরের নামে ধরায় ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে গির্জা বা পুরোহিত শ্রেণী যে সার্বভৌম ক্ষমতা ভোগ করত তার অবসান। জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ছাড়া অন্য কোনো অজুহাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা আর দাবি করা যায় না। ইংল্যান্ডে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার রূপ হচ্ছে ভোটে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত ব্রিটিশ পার্লামেন্ট। যে কারণে পার্লামেন্টই ‘সার্বভৌম’ বলে একটা কথার চল আছে। যা নিয়ে আমাদের দেশেও তর্ক চলে। এখান থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে ‘সার্বভৌমত্ব’ মূলত রাষ্ট্রক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনার তর্ক। খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বে ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। আধুনিক পাশ্চাত্য রাষ্ট্রের ‘সার্বভৌমত্ব’ খ্রিস্টীয় ধর্মতাত্ত্বিক ধারণারই ইহলৌকিক বিকার কিনা সেটি একালে খুবই গুরুত্বপূর্ণ তর্ক। ‘সার্বভৌমত্ব’ বা ‘সার্বভৌম ক্ষমতা’র বিচার একালে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তৃতীয়ত, বিপ্লব একটি প্রক্রিয়া; হঠাৎ একদিনের, এক মাসের বা দুই এক বছরের ব্যাপার নয়। ‘বিপ্লব’ ধারণার এটা হচ্ছে আরেকটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ দিক। হঠাৎ হাতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাজার প্রাসাদ দখল করা নয়। এর জন্য সমাজেরও বিপুল বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তুতির দরকার হয়। বিপ্লবী বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতাকে ন্যায্য ও সিদ্ধ প্রমাণ করার নীতি ও কৌশলের অন্তর্গত। লেনিন যে কারণে বিপ্লবী তত্ত্বচর্চা ও প্রচারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। এ ছাড়া বিপ্লবের সফলতা অসম্ভব। রাজা, পুরোহিত ও চার্চের ক্ষমতা ঈশ্বরের দৈব ক্ষমতারই ইহলৌকিক রূপ। এই দৈব উৎস ও চরিত্রই সার্বভৌম ক্ষমতার ন্যায্যতা হিসেবে জনগণের কাছে স্বীকৃত এবং দৈবগুণেই সিদ্ধ। তাহলে জনগণের ক্ষমতাকে ন্যায্য ও সিদ্ধ করার জন্য নতুন বিপ্লবী বয়ান বিপ্লবীদের করতে হয়েছে। সামন্ত শ্রেণী, রাজা ও গির্জার ক্ষমতার বিরোধী হলেও বিপ্লবী বয়ানে ধর্মকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন হয়েছে। যার ফলে ধর্মের নানা ফেরকা, মজহাব ও তরিকারও উদ্ভব ঘটেছে। দেশ ও রাষ্ট্রভেদে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই ও সংগ্রামে ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের এবং ধর্মের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিরও নানান রূপান্তর ঘটেছে। ধর্মতত্ত্বেরও বিবর্তন ঘটেছে। চতুর্থত, দেশ, কাল ও পাত্রভেদে বিপ্লব ইউরোপের ফটোকপি হবে তার কোনো যুক্তি নাই। সেই দিক থেকে পাশ্চাত্য চিন্তার পরিমণ্ডলে থেকে বলশেভিক বিপ্লব বা চিনা বিপ্লবের বয়ান সেই দেশের পরিস্থিতি অনুযায়ী যেমন হয়েছে, তেমনি ইরানের বিপ্লব সেই দেশের ধর্ম, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের চরিত্র থেকে ভিন্ন কিছু হয়নি। হওয়া আশা করাটাই বাতুলতা। ইরানের বিপ্লব বিপ্লবের ইতিহাসে নতুন কী যুক্ত করল সেটি একালে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। উপেক্ষা করার উপায় নাই।
দুই. বিপ্লবী রাজনীতি সম্পর্কে বাংলাদেশে প্রচলিত ধারণা হচ্ছে যারা বিপ্লবের কথা বলেন তারা সশস্ত্র ও সহিংস কায়দায় তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করেন। বাস্তবে সশস্ত্রতা ও সহিংসতার চর্চা শুধু বিপ্লবী রাজনীতি করে, সেটিও ঠিক নয়। তবে ওপরের কথাগুলো মনে রাখলে আমরা বুঝব সশস্ত্রতা বা সহিংসতা বিপ্লবী রাজনীতির অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য বা নীতি নয়। একই ধারণার বশবর্তী হয়ে অনেকে সেনা অভ্যুত্থানকেও ‘বিপ্লব’ বলে থাকেন। ক্ষমতাসীনদের একাংশকে বল প্রয়োগ করে উৎখাত করে সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেয়। সমাজে ক্ষমতাসীন শ্রেণীরই একটি অংশ বা গোষ্ঠী যখন তাদের প্রতিযোগী বিরুদ্ধ গোষ্ঠী বা অংশকে সশস্ত্র কায়দায় ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে সেটি মোটেও ‘বিপ্লব’ নয়। কারণ সেটি এক শ্রেণীর দ্বারা অন্য শ্রেণীকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত, রাষ্ট্রের গাঠনিক ও রাজনৈতিক রূপের কোনো মৌলিক পরিবর্তন নয়। রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে অস্ত্রের জোরে কোনো গোষ্ঠী বা দল কাকে অস্ত্রের জোরে বা নির্বাচনের মাধ্যমে সরাল, বৈপ্লবিক রূপান্তরের দিক থেকে তাতে কিছুই বিশেষ আসে যায় না। বড়জোর সেটি সমাজের ক্ষমতাসীন শ্রেণীর বিভিন্ন অংশের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্ব এবং সেই দ্বন্দ্ব পরস্পরের মধ্যে মীমাংসার ব্যর্থতা হতে পারে। ক্ষমতাবান শ্রেণীর পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্ব শ্রমিক, কৃষক ও নিপীড়িত শ্রেণীকেও বিভক্ত করে এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করতে পারে। সেই ক্ষেত্রে যারা নিপীড়িত শ্রেণীর পক্ষে রাজনীতি করেন তাদের কাজ হচ্ছে দ্বন্দ্বের চরিত্র ভালোভাবে বোঝা। দ্বন্দ্বের উৎপত্তি সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কারণে ঘটে। সমাজে ক্ষমতাসীন শ্রেণীর বিভিন্ন অংশ সব সবসময়ই পরস্পরের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ও সহিংস আক্রমণ জারি রাখে। সেটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার দিকে তাকালেই আমরা বুঝব। সশস্ত্রতা ও সহিংসতা চর্চার একচেটিয়া ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতে থাকে। ক্ষমতাসীন শ্রেণীর বিভিন্ন অংশ সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব, আইন আদালত ইত্যাদি। অর্থাৎ বল প্রয়োগের রাষ্ট্রীয় হাতিয়ারগুলো ব্যবহারের জন্য নিরন্তর নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। রাষ্ট্রের কেন্দ্রীভূত সশস্ত্র শক্তির সমর্থন ছাড়া বাংলাদেশের মতো দেশে ক্ষমতায় যাওয়ার অন্য কোনো বিকল্প নাই। ফরাসি বিপ্লব বৈপ্লবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের যে মানে তৈরি করেছে, বিপ্লব কথাটার যে অর্থ তৈরি করেছে- সেটি নিছক সশস্ত্র ও সহিংস কায়দায় ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে সেনাবাহিনী কিংবা অন্য কারও ক্ষমতা দখল নয়। যে দিকগুলো ইউরোপের বিপ্লব প্রসঙ্গে এখানে আমরা আলোচনা করতে পারিনি, তার মধ্যে রয়েছে বিপ্লবসংক্রান্ত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা ও শ্রেণির প্রশ্ন। বিভিন্ন অর্থনৈতিক শ্রেণি এবং আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার নিরিখে তাদের সম্ভাব্য রাজনৈতিক ভূমিকা। মার্কস, লেনিন, মাও জে দং প্রমুখের দিক থেকে বিপ্লবের একটা আর্থ-সামাজিক মানে আছে। সমাজে উৎপাদন সম্পর্ক যখন অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে, দ্রুত ও ত্বরান্বিত বিকাশ অসম্ভব হয়ে ওঠে, তখন প্রতিবন্ধতা সৃষ্টিকারী শ্রেণীকে উৎখাত করবার নামই বিপ্লব। ফরাসি দেশে সামন্ত শ্রেণি ও তাদের ক্ষমতার রাজনৈতিক রূপ ‘রাজতন্ত্র’ সমাজের বিকাশের জন্য বাধা হয়ে উঠেছিল, রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে তাদের উৎখাত করে রাষ্ট্র ও রাজনীতির নতুন গণতান্ত্রিক বিন্যাস জরুরি হয়ে পড়েছিল। প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে যারা আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকে গতিশীল করবার নেতৃত্ব দিচ্ছিল তারা ছিল ‘বুর্জোয়া’ শ্রেণী। সামন্ত শ্রেণীর শাসন-শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য শ্রমিক, কৃষক ও মজলুম জনগণ এই শ্রেণীকে সমর্থন দিয়েছিল। ফরাসি বিপ্লবের সামন্ত শ্রেণীর পরাজয় ঘটে এবং বুর্জোয়া শ্রেণী রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে ‘গণতন্ত্র’ কায়েম করে। অপরদিকে সামন্ততান্ত্রিক আর্থ-সামাজিক সম্পর্ক উৎখাত করে ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতির বিকাশ নিশ্চিত করে। যেহেতু বুর্জোয়া শ্রেণীর কাজ পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম ও গতিশীল করা, এ জন্য ‘বুর্জোয়া’ বলতে আমরা সাধারণত ধনী শ্রেণী বুঝি। কিন্তু ‘বুর্জোয়া’ কথাটা বিপ্লবী রাজনীতির পরিভাষা হিসেবে শুধু অর্থনৈতিক বর্গ নয়,
মূলত রাজনৈতিক বর্গ। অর্থাৎ এই পরিভাষাটিকে বুঝতে হবে তাদের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ভূমিকার দিক থেকেও। এই বর্গের মধ্যে অর্থনৈতিক অবস্থা ও রাজনৈতিক চেতনা কীভাবে সম্বন্ধযুক্ত? নাকি তারা আলাদা? অর্থনৈতিক শ্রেণী এবং তাদের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক চেতনার সম্পর্ক পুরনো একটি তর্ক। সেই তর্কের এখনও মীমাংসা হয়নি। সেই আলোচনাও এখানে করা হয়নি। এই তর্কটা বিভিন্নভাবে নানান দিক থেকে আজকাল করা হচ্ছে। যারা ‘বৈপ্লবিক’ পরিবর্তনে আগ্রহী ও বিপ্লবী রাজনীতির পুনর্গঠনে আন্তরিক, তর্কগুলোর সঙ্গে তাদের পরিচিত হয়ে ওঠা জরুরি। যেমন, বিপ্লবের এজেন্ট বা কর্তাসত্তা নির্ণয়ের উপায় কী? কাজটা কি শহরের শ্রমিকরাই করবেন? তাহলে কি গণতান্ত্রিক বিপ্লবে ‘উই দ্য পিপল...’ কথাটার আর কোনো তাৎপর্য বা ভূমিকা নাই? থাকলে সেটি কী? পরিবর্তন যারা ঘটাবেন সেই ‘জনগণ’ কারা? বিপ্লবের এজেন্সি বা কর্তাসত্তা নির্মাণের ক্ষেত্রে শুধু অর্থনৈতিক অবস্থানই কি একমাত্র বিবেচ্য, নাকি ধর্মচিন্তাসহ মতাদর্শ, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি সব কিছুই আমলে নেয়া জরুরি। বলাবাহুল্য বাস্তবে বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার দ্বন্দ্ব- সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির মধ্যে কীভাবে প্রকাশিত হচ্ছে, তাকে বাস্তবিকভাবে বোঝাটাই প্রাথমিক কাজ। বাংলাদেশে সেই দ্বন্দ্ব ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম ইসলামপন্থা হিসেবে হাজির হল কেন? এর উত্তর আগাম মাথায় তৈয়ার করে রাখা মতাদর্শের খোপে ফেলে বোঝা যায় না। তার জন্য বাস্তবে কী ঘটছে তাকে বাস্তবোচিতভাবেই বুঝতে হবে। তবে রাজনীতি শেষাবধি ক্ষমতা ও রাষ্ট্রের ধারণার সঙ্গে যুক্ত। এ কালে ক্ষমতা, সার্বভৌমত্ব ইত্যাদি ধ্যান-ধারণার বোঝাবুঝির ক্ষেত্রে বিপুল পরিবর্তন ঘটেছে। বিপ্লবের পুরনো চিন্তা দিয়ে যা আর বুঝার উপায় নাই বললেই চলে। এখানে বা অন্য কোথাও আগামী কোনো লেখালিখিতে সে বিষয় নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা রাখি। ১৬ জুন, ২০১৭, শ্যামলী

No comments

Powered by Blogger.