তিক্ত বিভক্তি by মোহাম্মদ আবুল হোসেন

প্রায় ৫ মাস আগের কথা। বারাক ওবামাকে বিদায় জানিয়েছিলেন নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। হেলিকপ্টারে করে হোয়াইট হাউস থেকে বিদায় নিয়েছিলেন তার ওই পূর্বসূরি। ট্রাম্প তখন হাত নাড়ছিলেন। এই চিত্র আস্তে আস্তে ম্লান হয়ে আসছে। তারপর থেকে তাদের মধ্যে আর কোনো কথা হয়নি।
হোয়াইট হাউসে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাইরের অনেকের পরামর্শ নিয়েছেন ট্রাম্প। তিনি পরামর্শ নিয়েছেন পুরনো বন্ধুবান্ধব, ব্যবসায়ী নির্বাহী এমনকি বিদেশি নেতাদের। কিন্তু তার এ পদে যারা এর আগে দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের কারো পরামর্শ তিনি নেননি। নেননি কোনো উপদেশ। ওবামা-ট্রাম্প শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়ে যাওয়ার পর দু’জনের মধ্যে সম্পর্কের কোনো উন্নতি হয়নি। তারা এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন। এ কথা বলেছেন, হোয়াইট হাউসের উপদেষ্টারা ও সাবেক প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তাদের সহযোগীদের জানামতে তারা ফোনে একে অন্যের সঙ্গে কথাও বলেননি। নিউ ইয়র্কে ট্রাম্প টাওয়ারে ফোনে আড়িপাতার অভিযোগ আনা হয়েছিল বারাক ওবামার বিরুদ্ধে। সেখান থেকে তাদের মধ্যে একত্রিত হওয়ার বাস্তবসম্মত কোনো লক্ষণও দেখা যায় নি। সম্ভবত এটা হলো এ দু’জন মানুষের দীর্ঘ ও তিক্ততার ইতিহাস। তাদের মধ্যে যে গভীর শত্রুতার শিকড় গেঁথে আছে তা নীতি ও স্টাইলের বাইরে বিস্তৃত। প্রেসিডেন্ট হিসেবে বারাক ওবামার দায়িত্বের প্রথম বছরে তার সিনিয়র উপদেষ্টা ছিলেন ডেভিড অ্যাক্সেলরড। তিনি বলেছেন, আমরা মনে হয় না এ দু’জন ব্যক্তির মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে। ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়কালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার পক্ষে যতটা সম্ভব তিনি চেষ্টা করেছেন। এমন কিছু ইস্যু সামনে এসেছে যেটাতে হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন ছিল। তবে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে সম্পর্ক এমন ঘোলাটে ছিল না। উত্তরসূরির জন্য একটি সুযোগ ছেড়ে দেয়ার জন্য চেষ্টা করেছিলেন বারাক ওবামা। এক্ষেত্রে তিনি ব্যক্তিগত বিরোধকে পিছনে ফেলেছিলেন। নভেম্বরে নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয়ের পর তারা ওভাল অফিসে এক ঘন্টারও বেশি সময় আলোচনা করেন। এরপর ট্রাম্প ঘোষণা করেন, তারা উষ্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। কিন্তু সম্পর্কে ফাটল ধরেছিল তারও অনেক আগে। ইসরাইলের বসতি স্থাপন ইস্যুতে বিতর্কিতভাবে হস্তক্ষেপ করেছিলেন ট্রাম্প। পরে তিনি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে টুইটারে বার বার ঘায়েল করে পোস্ট দিতে থাকেন। ২০শে জানুয়ারি শপথ গ্রহণের দিনে সে সব ঝেড়ে ফেলে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা হোয়াইট হাউজে কফি চক্রে আপ্যায়ন করেন। এ সময় ওবামা ও মিশেলকে দেখা গেছে উল্লসিত। এরপর ট্রাম্প যখন ক্ষমতায় এলেন তখন থেকেই তীব্র গতিতে এ সম্পর্ক তিক্ত হতে থাকে। বিশেষ করে ট্রাম্প টাওয়ারে বারাক ওবামা ফোনে আড়ি পাতার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে মার্চ মাসে টুইট করেন ট্রাম্প। এতে সম্পর্কে ফাটল আরো একটু বাড়ে। কিন্তু ট্রাম্পের এ আক্রমণ ভিত্তিহীন। ওবামা এ অভিযোগকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এতে ওবামা ক্ষিপ্ত হয়েছেন। সম্পর্ক জোড়াতালি দেয়ার জন্য চেষ্টা হয়েছে। আলোচনায় বসেছেন ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজের চিফ অব স্টাফ রেইনস প্রিবাস এবং হোয়াইট হাউজে ওবামার সাবেক চিফ অব স্টাফ ডেনিস ম্যাকডোনা। এ আলোচনার ফলে যা হয়েছে তাহলো, বর্তমান ও সাবেক দু’প্রেসিডেন্ট শুধু ফোন কল করেছেন। কিন্তু ওবামার বিরুদ্ধে অভিযোগ থেকে সরে আসেননি ট্রাম্প। উল্টো তাকে অব্যাহতভাবে আক্রমণ করতে থাকেন। মে মাসের শুরুর দিকে তারই প্রতিধ্বনি শোনা যায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কণ্ঠে। তিনি সিবিএস নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে ওবামাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আমার সঙ্গে যখন কথা বলার সময় তিনি চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি খুব ভাল মানুষ। তারপর থেকে আমাদের মধ্যে জটিলতা রয়েছে। এরপর থেকে আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই।
তিনি এ সব মন্তব্য করার পর ওবামা জনসমক্ষে চলে আসেন। গত মাসে দু’নেতাই ইউরোপে ছিলেন। সেখানে জার্মানির বার্লিনে চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মারকেলের সঙ্গে সাক্ষাত করেন বারাক ওবামা। ট্রাম্প যান বিদেশী সব রাষ্ট্রপ্রধানদের বৈঠকে। ব্রাসেলসে ন্যাটো সদর দফতরে প্রথম ভাষণ দেন ট্রাম্প। তার নির্ধারিত ভাষণের সময় পরিবর্তন করা হয়। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মারকেলের সঙ্গে বারাক ওবামার বৈঠকে সময় করিয়ে দেয়ার জন্য তার এ ভাষণের সময় নির্ধারণ করা হয় বিকালে। এই সপ্তাহে মন্ট্রিলে ভাষণ দেয়ার পর কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন ওবামা। সেখানে ট্রাম্পের বিষয়ে তীর্যক মন্তব্য করা হয়েছে বলে মনে করা হয়। গত মাসে জি-৭ এর বৈঠকে মারকেল ও ট্রুডো অংশগ্রহণ করেন। সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যুতে ট্রাম্প ছিলেন এক রকম একপেশে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ রিপাবলিকানরা বরছেন, বিদেশী নেতাদের সঙ্গে নিজস্ব সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন বারাক ওবামা এ বিষয়েটি নজরে পড়েছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের। প্রিন্সটনের প্রেসিডেন্সিয়াল ইতিহাস বিশারদ জুলিয়ান জেলিজার বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটাকে ভাল চোখে নাও দেখে থাকতে পারেন। ওবামা সেখানে বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে এটা ট্রাম্পের জন্য সহায়ক হতে পারে। এক্ষেত্রে ওবামা একটি কূটনৈতিক ভূমিকা দেখাতে পারেন, যেটা এই প্রশাসন পূর্ণ করতে পারছে না। কথা এখানেই শেষ নয়। দীর্ঘদিন পূর্বসুরির ওপর নির্ভরতা করার একটি রীতি আছে প্রেসিডেন্টদের। এ জন্য মাঝেমধ্যে তারা তথাকথিত প্রেসিডেন্টস ক্লাবের সদস্যদের কল করে থাকেন। তাদের কাছ থেকে বুদ্ধি পরামর্শ নেন, যা হবে যুক্তরাষ্ট্রের অনুকূলে। কিন্তু এখন ট্রাম্প ও ওবামার মধ্যে যে পরিমাণ সম্পর্ক ছেদ ঘটেছে তা কয়েক দশকের মধ্যে দেখা যায় নি। পূর্বসুরির সঙ্গে সব রকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট। ২০০১ সালের জুনের শুরুর দিকে বস্টনে এক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় পূর্ব সুরি বিল ক্লিনটনের সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাত হয় জর্জ ডব্লিউ বুশের। তারা দু’জন বিল ক্লিনটনের ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর’কে সঙ্গে নিয়ে সেন্ট ব্রিজিড চার্চে একই আসনে বসে যান। প্রেসিডেন্ট বুশ ও ক্লিনটন তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। তারা নিয়মিত একে অন্যকে ফোন করতেন। শপথ নেয়ার কয়েকদিন আগে বারাক ওবামা প্রেসিডেন্সি কেমন হবে এ বিষয়ে পরামর্শ নিতে জীবিত সব প্রেসিডেন্টদের এক সভা আহ্বান করেন। নিজের ব্যক্তিগত ডাইনিং রুমে এর আয়োজক ছিলেন বুশ। ইতিহাসবেত্তারা বলেন, হোয়াইট হাউজে ওটাই ছিল জীবিত সব প্রেসিডেন্টদের প্রথম বৈঠক। এর এক মাস পরে তখনকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা অস্বাভাবিক একটি ফোন করেন তার পূর্বসুরি জর্জ ডব্লিউ বুশকে। তাকে তিনি ওই ফোনকলে জানান, তিনি ইরাক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়ার পরিকল্পনা করছেন। ওবামার এ ফোনকলকে সৌজন্যতা বলে আখ্যায়িত করেছেন ওবামার সহযোগূরা। কিন্তু তেমন সৌজন্যতা দেখান নি ট্রাম্প। গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত জানান। এতে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়- তিনি কি এ বিষয়ে পূর্বসুরি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে অবহিত করেছিলেন! পক্ষান্তরে তিনি উল্টো ওবামাকে দোষারোপ করেন। বলেন, অপমানজনক এক চুক্তি করেছেন ওবামা। এতে বিদেশি নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে হেঁসেছেন। ক্রমশ এ দু’নেতার মধ্যে বাড়ছে তিক্ত বিভক্তি। (সূত্র সিএনএন)

No comments

Powered by Blogger.