সন্ত্রাসের চক্রে জড়িয়ে পড়া কার স্বার্থে? by-আবুল মোমেন

একটি সন্ত্রাসী হামলা পাল্টা সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কাই তৈরি করে। প্রতিটি সন্ত্রাসের ঘটনা নৃশংসতার প্রবণতা আরও বাড়িয়ে দেয়। সন্ত্রাস আরও সন্ত্রাস, নৃশংসতা আরও নৃশংসতার জন্ম দেয়। প্যারিসে গত শুক্রবার রাতের নৃশংস সন্ত্রাসের পরপর ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় ‘নৃশংস প্রতিশোধের’ প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় ফ্রান্সের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এই হামলা থেকে রাজনৈতিক ফায়দা লুটবে উগ্র জাতীয়তাবাদী বিদেশিবিদ্বেষী মারিন লো পেনের ন্যাশনাল ফ্রন্ট। প্রতিশোধেরই প্রতিজ্ঞা থেকে আইএস আত্মঘাতের মাধ্যমে পশ্চিমের সাংস্কৃতিক রাজধানী প্যারিসে হামলা চালিয়েছে। প্রতিশোধ ও জিঘাংসা প্রতিশোধ ও জিঘাংসারই জন্ম দিয়েছে। যুদ্ধের মাধ্যমে যুদ্ধ থামানো যায় না—এই উপলব্ধি থেকেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমাপ্তির পর বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছিলেন, যুদ্ধকে জয় করা গেছে, শান্তিকে নয়। তাঁর বাণী সত্য হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী ৫০ বছরে সারা বিশ্বে ছোটখাটো যুদ্ধে মহাযুদ্ধের চেয়েও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।
তারপরও এ কথা মনে রাখতে হবে, হিংসা বা সন্ত্রাস কখনো ঐক্যের ভিত্তি হতে পারে না। ফলে মুসলিম বিশ্ব, বিশেষত আরবের দেশগুলো তাদের অনৈক্য ও বিভেদের পথেই চলবে। কিন্তু আক্রান্তরা মতপার্থক্য ভুলে সব সময়ই দ্রুত ঐক্যবদ্ধ হয়। বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না, পশ্চিম দ্রুত বৃহত্তর কার্যকর ঐক্য গড়ে তুলবে এবং প্রতিপক্ষের ওপর দ্বিগুণ শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে। প্রশ্ন হলো, তখন তাদের বিশ্বস্ত বান্ধব সৌদি রাজতন্ত্র কি পক্ষ বদল করবে? উত্তরটা আমাদের জানা আছে।
বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, সমাজে হানাহানি, বিভ্রান্তি ও অশান্তি যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে চলতে থাকে, তখনই শান্তির বাণী নিয়ে নানান ধর্মের আবির্ভাব ও বিভিন্ন ভাবান্দোলনের সূচনা হয়েছে। ইসলাম এ রকমই এক অরাজক অবস্থায় নাজিল হয়েছে—এ কথা বিশেষভাবে বলা হয়ে থাকে। ধর্মের তাৎপর্য এবং সাফল্য নির্ভর করে মানুষের মধ্যে শান্তি, সমঝোতা ও সম্প্রীতির বাতাবরণ তৈরির সামর্থ্যের ওপর। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ধর্মের নামেই পৃথিবীতে হানাহানি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ঐতিহাসিকেরা বলেন, রাজ্য জয় বা রাজনৈতিক কারণে যত যুদ্ধ ও প্রাণহানি ঘটেছে, তার চেয়ে বেশি হয়েছে ধর্মের নামে। কেন এমনটা ঘটেছে বা ঘটে থাকে, তা ঘটনাগুলো তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে।
বিশ্বের বড় সব ধর্মই বিস্তার লাভ করেছে শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে। ইসলামের প্রথম যুগে মুসলিম সমাজে খলিফাই ছিলেন শাসক। আদি খ্রিষ্টান সমাজে কিছুকাল রাজা ও ধর্মগুরু একই ব্যক্তি হলেও, রাজার পাশাপাশি পোপ এবং শক্তিশালী যাজক সম্প্রদায়ের উত্থান হলেও ফরাসি বিপ্লবের পরে রাষ্ট্র ও চার্চ পৃথক হয়ে যায়। কিন্তু কেবল রাজ্য বিস্তারের মাধ্যমেই তো ধর্মের বিস্তার ঘটেনি, খ্রিষ্টানদের যেমন মিশনারি, মুসলমানদের তেমনি পীর-দরবেশ, জ্ঞানী-গুণী, ফকির-সাধুদের মাধ্যমে ধর্ম নতুন নতুন দেশ ও সমাজে বিস্তৃতি লাভ করেছে। এটি শাসকদের জন্য নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছিল। আব্বাসীয় খলিফাদের আমল পর্যন্ত বৃহত্তর পারস্য সাম্রাজ্য, ভারতবর্ষ, উত্তর আফ্রিকা ও স্পেনে ইসলামের বিস্তার ঘটেছে। এ সময়ে আরবি ও ফারসি ভাষার মাধ্যমে ইসলামি মনীষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। আন্দালুসিয়ার মুসলিম মনীষীরা ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষা শিখেছিলেন এবং প্রাচীন গ্রিক ও রোমান জ্ঞানভান্ডার থেকে বহু মূল্যবান বই অনুবাদ করেছিলেন। মুসলিম দার্শনিক, বিজ্ঞানী, কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীদের তখন বিশ্বজয়ী অবস্থান।
প্রাচীন গ্রিক, রোমান ও পারস্যের সমৃদ্ধ সভ্যতা ও সংস্কৃতির মূল্যবান অনেক কিছুই আত্তীকরণের মাধ্যমে মুসলিম সভ্যতার অবিস্মরণীয় অগ্রগতি ঘটেছিল। এর ফলে সমঝোতা, সমন্বয় ও গভীর প্রজ্ঞার পথ খুলে গিয়েছিল। মনে রাখা দরকার, প্রাচীন পারস্য সভ্যতা কেবল বর্তমান ইরানে সীমাবদ্ধ ছিল না, তার বিস্তার ছিল মধ্য এশিয়া পর্যন্ত, প্রভাব ছিল আরও ব্যাপক। ইসলামের প্রভাব এই সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভেতর থেকে কেবল মরমি সুফিবাদ নয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় অসামান্য সব অবদান সৃষ্টি করেছে। পারস্য থেকে মরক্কো হয়ে স্পেন অবধি বিস্তৃত ছিল সম্পন্ন মুসলিম সভ্যতা, যার অবদানই ইউরোপীয় রেনেসাঁস ও এনলাইটেনমেন্ট বা আলোকায়নের পেছনে বড় ভূমিকা পালন করেছে।
মুসলিমদের এই সমৃদ্ধ সভ্যতা ও সংস্কৃতিকেই মধ্য এশিয়া থেকে মোগলরা ভারতবর্ষে নিয়ে এসেছিল এবং এর প্রভাবে সমৃদ্ধ প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতায় ও সংস্কৃতিতে স্থায়ী রূপান্তর ঘটেছে। এই অবদান ও এই সত্য কেউই অস্বীকার করতে পারবে না। নরেন্দ্র মোদি বা তাঁর দলবল যতই ‘ঘর ওয়াপসির’ ধুয়া তুলুক, তাতে ভারতীয় সংস্কৃতি থেকে মুসলিম প্রভাব মুছে ফেলা যাবে না।
বিশুদ্ধতাবাদীরা আদি ইসলামের কথা বলে ইতিহাসকে—অর্থাৎ ইসলামের অগ্রযাত্রার ইতিহাসকেই—অস্বীকার করতে চাইছেন। ইতিহাসের যাত্রাপথ একরৈখিক নয়, মসৃণ নয়। বারবার কঠিন সব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে, সেসব মোকাবিলা করে তবেই এগোতে হয়। লক্ষ করব, শাসকদের দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার সহযোগিতায় ইসলামি বিশ্বের—তীর্থ ঠিক থাকলেও—রাজধানী বা জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র বদল হয়েছে। মদিনা, দামেস্ক, বাগদাদ, কর্দোভায় তা স্থানান্তরিত হয়েছে। অটোমান সাম্রাজ্যে ইস্তাম্বুলই ছিল কেন্দ্র, যদিও তখন বৃহত্তর পারস্যে অনেক উপকেন্দ্র ছাড়াও ভারতবর্ষে মুসলিম সমাজের সমৃদ্ধি ও অবদান বাড়ছিল। এসবই তো মুসলমানদের কীর্তি, এসবকে অস্বীকার করলে কি মুসলিম সভ্যতার ইতিহাসই অস্বীকার করা হয় না? কিংবা তাতে মুসলমানদের গৌরব বাড়ে, না দৈন্য বাড়ে?
নিরস্ত্র মানুষকে গলায় ছুরি চালিয়ে হত্যা করা যেমন, তেমনি ড্রোন হামলা চালিয়ে বাছবিচারহীন হত্যাকাণ্ডও নিকৃষ্ট অপরাধ। কিন্তু আরব জনগণ কি নিজেদের দেশে পশ্চিমের তাঁবেদার শাসকদের টিকিয়ে রেখে তাদের সহযোগিতা করছে না?
দীনতার অহংকারের দাপটের কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন। চিত্তের দৈন্য যেমন, আত্মিক দৈন্যও তেমনি ভয়াবহ—ভয়ংকর এর পরিণতি, কারণ এটা প্রায়ই আত্মঘাতী পরিণতির তোয়াক্কা করে না। আত্মঘাতী হওয়াটা ইসলামসম্মত নয় জেনেও যাঁরা তরুণদের আত্মঘাতী হওয়ার প্রেরণা দিচ্ছেন, তাঁরা কাদের অস্বীকার করছেন? আল্লামা রুমি, আবদুল কাদের জিলানি (রা.), খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (রা.) কিংবা ইবনে সিনা, ইবনে খালদুন, আল বিরুনি—এসব দার্শনিক, সুফিসাধক ও বিজ্ঞানীদের কি অস্বীকার করতে হবে? হাফিজ, ফেরদৌসী, খৈয়ামের মতো মহাকবিদের? কিংবা নজরুলকে? একেই বলে অন্ধতা, ধর্মান্ধতা।
পশ্চিমের স্বার্থবুদ্ধির কূটচালগুলো যেমন মতান্ধবিলাসী শাসকেরা—যেমন সৌদি বাদশাহ—বুঝতে অপারগ, তেমনি বুঝতে পারে না ধর্মান্ধ আত্মঘাতী মানুষ, যেমন আইএস। অথচ পশ্চিম বারবার প্রাচ্য ও আফ্রিকাকে পর্যুদস্ত করতে পারছে, তার কারণ ক্রুসেড যুদ্ধে পরাজয়ের পর মুসলমানরা যখন দিশেহারা, তখন তাদেরই মনীষীদের চর্চিত জ্ঞান ও বিজ্ঞানের সহায়তায় পশ্চিম এগিয়ে গেছে। প্রাচীন ভারতের হিন্দু জ্ঞান ও বিজ্ঞান একসময় সবচেয়ে এগিয়ে ছিল, তাদের গতি থামার পেছনে ধর্মান্ধতা বড় কারণ। তারপর চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম মনীষীরা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় সবচেয়ে অগ্রসর ছিলেন, কিন্তু তারও যে গতি রুদ্ধ হলো, তার পেছনে যত কারণই থাক, তা কাটিয়ে উঠতে না পারার কারণ কিন্তু ধর্মান্ধতা।
ধর্ম কি পিছুটান হয়েই থাকবে? পেছনে যাওয়ার প্রেরণা দেবে, না সামনে এগিয়ে চলার? আত্মঘাতী হয়ে সামনে এগোনো যায় না, হয়তো প্রতিশোধ নেওয়া যায়, জিঘাংসা চরিতার্থ করা যায়। কিন্তু তাতে জড়িয়ে পড়তে হয় হিংসা-সন্ত্রাসের ক্রমবর্ধমান বিষাক্ত এক চক্রে। এই পরিণতিকে সুফল বলব না বলব হিংসার খেসারত?
আরব বিশ্বের প্রতি পশ্চিম অবশ্যই অবিচার করছে। নিরস্ত্র মানুষকে গলায় ছুরি চালিয়ে হত্যা করা যেমন, তেমনি ড্রোন হামলা চালিয়ে বাছবিচারহীন হত্যাকাণ্ডও নিকৃষ্ট অপরাধ। কিন্তু আরব জনগণ কি নিজেদের দেশে পশ্চিমের তাঁবেদার শাসকদের টিকিয়ে রেখে তাদের সহযোগিতা করছে না? অথবা অন্য কথায়, নিজেদের প্রতি একই অবিচার করছে না? নিজের দুর্বলতা রেখে কোনো প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেই বিজয়ী হওয়া যায় না। নিজেদের দেশে দেশে শক্তিশালী বিভীষণদের ক্ষমতায় বসিয়ে রেখে প্যারিস বা বার্লিনে, নিউইয়র্ক বা ক্যানবেরায় রক্তবন্যা বইয়ে দেওয়া যাবে, কিন্তু তাতে পরিস্থিতি পাল্টাবে না। দেশে দেশে মুসলিম সমাজ আরও বিভ্রান্ত হবে, হয়তো হানাহানিতে, ভ্রাতৃঘাতী ও আত্মঘাতী সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে। এ মর্মান্তিক পরিণতি হয়তো পশ্চিমের জন্য তামাশার বেশি হবে না।
ইসলামের গৌরব অনুভব করতে হবে, গৌরবময় ইতিহাস উপলব্ধি করতে হবে। তেমনি ধর্ম-বর্ণ-অঞ্চলনির্বিশেষে মানবসভ্যতার অর্জনগুলোর উত্তরাধিকার স্বীকার করতে হবে। সত্যকে বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে বাস্তবকে পাল্টানোর কাজে সফল হওয়া যায় না। অন্ধতা সত্য ও বাস্তব, দুটিরই উপলব্ধির পথ বন্ধ করে দেয়, অনুভূতি দেয় ভোঁতা করে, এবং মানুষের মানবিক সত্তাকে দুর্বল করে দেয়। অমানবিকতা নয়, মনুষ্যত্বের পথ ধর্মের। এ নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়া কি মানুষের শোভা পায়?
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.