সৃজনশীল কি সৃজনশীল থাকছে? by- প্রতীক বর্ধন



দেশে এখন সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠদান করা হচ্ছে, এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে এর উল্টোটাই ঘটছে। আবার এ পদ্ধতিতে গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরশীলতা কমার কথা থাকলেও বৈপরীত্যমূলক ব্যাপার হচ্ছে, গাইডের ওপর নির্ভরশীলতা আরও বেড়েছে। এ ব্যাপারে অভিভাবকেরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই লেখায় হাত দেওয়া।
জাতিসংঘের ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটসের ২৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘সবারই শিক্ষা লাভের অধিকার আছে।’ মানবিক উন্নয়নের জন্য শিক্ষার বিকল্প নেই। আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু শিক্ষার মানোন্নয়ন করতে না পারলে আমরা বিশ্বায়িত পৃথিবীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারব না। এ লক্ষ্যেই সৃজনশীল পদ্ধতি প্রণয়ন করা হয়েছে।
সৃজনশীল পদ্ধতির মাজেজা হচ্ছে শিক্ষণ, পরীক্ষা নয়। এ পদ্ধতির লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করার মতো নিদারুণ ও নিষ্ফলা পরিশ্রমের হাত থেকে রেহাই দেওয়া। ফলে এ পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে জনপ্রিয় হওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবে সেটা তেমন জনপ্রিয় হচ্ছে না। তার কারণ হলো, সেটা করার জন্য আমাদের যে প্রস্তুতি প্রয়োজন, আমরা সেটা নিতে পারিনি। এই পদ্ধতিতে শ্রেণিকক্ষেই শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন হওয়ার কথা। কিন্তু সে ব্যবস্থা করা আমাদের দেশে কবে সম্ভব হবে, তা বলা মুশকিল। ফলে এখনো পাবলিক পরীক্ষার মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
সৃজনশীল প্রশ্নকে চারটি অংশে ভাগ করা হয়েছে: জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতা। এই চারটি অংশের উত্তর থেকে ছাত্রছাত্রীদের স্মৃতিশক্তি ও চিন্তাক্ষমতার বিভিন্ন স্তর যাচাই করা সম্ভব। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাইয়ীদের মতে, ‘প্রশ্নের চতুর্থ অংশে যাচাই করে দেখা হয় ওই অংশের সঙ্গে সম্পর্কিত পাঠ্যবইয়ের জায়গাটুকু ও উদ্দীপকের ভেতরকার ভাবনাচিন্তা, অনুভূতি-কল্পনাশক্তি, গভীরতা-ব্যাপকতা ইত্যাদিকে ছাত্রছাত্রীরা তুলনা করে বুঝতে পারছে কি না; এদের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য, উচিত-অনুচিত, ভালো-মন্দ ইত্যাদি বিচার-বিবেচনা করে তার নিজস্ব মতামত গড়ে তুলতে পারছে কি না।’
ইংরেজি আমাদের মাতৃভাষা নয়, বিদেশি ভাষা। প্রাথমিক স্তরে বিদেশি ভাষা শেখানোর প্রয়োজনীয়তা কতটুকু, সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। ফলে ইংরেজির সৃজনশীল প্রশ্ন কেমন হবে, তা নিয়ে আমাদের বিস্তর চিন্তার অবকাশ আছে। কিন্তু সেটা না করে সমাপনীর নম্বর বিন্যাস করা হয়েছে এভাবে: সিন ৫০, আনসিন ৫০। ভাবখানা এমন, যেন ইংরেজি আমাদের মাতৃভাষা। রাজধানী বা বড় শহরের সচ্ছল বাবা-মায়ের সন্তানেরা ভালো স্কুলে পড়ে, সেখানে ভালো শিক্ষকও আছেন। আবার তাদের প্রাইভেট টিউটরও আছে। ফলে তারা হয়তো এই ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে, কিন্তু মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলের গরিব মানুষের সন্তানদের কী হবে, সেটা কি আমরা ভেবে দেখেছি? প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভাষ্য হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের কাছে ইংরেজি আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে অনেক শিক্ষকই বলছেন, গণিত ও ইংরেজিকে সৃজনশীল পদ্ধতির বাইরে রাখা উচিত। কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হলো, এত কিছুর পরও কিন্তু পরীক্ষার ফল খারাপ হচ্ছে না। তার মানে কি ভূতটা সর্ষেতেই আছে?
আবার কমিউনিকেটিভ ইংরেজির নামে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ব্যাকরণ পড়ানো হচ্ছে না, এমনকি সাহিত্যও নয়। সাহিত্য না পড়লে কি ভাষা শেখা সম্ভব?
প্রাথমিক শিক্ষার হার বেড়েছে—শুধু এ নিয়ে আমাদের এখন আর গর্ব করার অবকাশ নেই। সময় এসেছে, সামনে এগোতে হবে, শিক্ষার মানোন্নয়নে মনোযোগ দিতে হবে, শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তি ও যুক্তিবোধ শাণিত করতে হবে

সমস্যা হচ্ছে, সৃজনশীল পদ্ধতি প্রয়োগ করার আগে আমাদের যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া দরকার ছিল, সেটা আমরা নিতে পারিনি। সব শিক্ষককে এখন পর্যন্ত প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। আবার যাঁরা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তাঁরা যে প্রশিক্ষণলব্ধ শিক্ষা শ্রেণিকক্ষে প্রয়োগ করছেন, সেটাই বা কে দেখছে। আগের পদ্ধতির সঙ্গে যে এ পদ্ধতির মৌলিক তফাত রয়েছে, সেটা ভুলে গেলে চলবে না। সৃজনশীলের মূল কথা হচ্ছে শিক্ষণ। ফলে পুরো প্রস্তুতি না নিয়ে হুট করে এই পদ্ধতি চালু করে দেওয়া কতটা যৌক্তিক, সে প্রশ্ন তোলার সময় হয়েছে।
মোদ্দা কথা হলো, সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষকদের সবচেয়ে বেশি সৃজনশীল হতে হবে। সেটা নিশ্চিত না করে এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করলে তো হবে না। শিক্ষকেরা যাতে সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্ন নিজে প্রণয়ন করতে পারেন, সে লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করেছে। আবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, বাজার অথবা গাইড থেকে নমুনা প্রশ্ন নিয়ে পাবলিক কিংবা স্কুলের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার প্রশ্ন করা যাবে না। অথচ খোদ এসএসসি পরীক্ষাতেই গাইড বই থেকে হুবহু প্রশ্ন তুলে দেওয়া হয়েছে। প্রয়োগের এই ঘাটতির কারণে গাইড বই ও কোচিং সেন্টারের আরও বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। তার চেয়েও বড় চিন্তার কারণ হচ্ছে প্রশ্নপত্র ফাঁস। অভিযোগ উঠেছে, এই ফাঁসের সঙ্গে কোচিং সেন্টারগুলো জড়িত। ওদিকে ভালো ছাত্রদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করার মতো সরকার তো কিছু করছেই না, উল্টো অষ্টম পে–স্কেলে সরকার শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন করেছে।
আরেকটি ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। একদিকে আমরা শিক্ষণকে মূল মন্ত্র বলব, আরেক দিকে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অযাচিত পরীক্ষার চাপে ফেলব, তা হতে পারে না। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার কথা ছিল না, কিন্তু আমরা তাতে কর্ণপাত না করে শিক্ষার্থীদের জীবনে আরেকটি পাবলিক পরীক্ষা যোগ করেছি, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সারা দিন দৌড়ের ওপর রাখার ব্যবস্থা করেছি। তবে এতে আর কেউ লাভবান না হলেও কোচিং সেন্টারগুলো লাভবান হচ্ছে; কারণ স্কুলে পড়াশোনা হয় না, তাই কোচিং সেন্টারে না গেলে পড়া হবে কী করে? অনেক বাবা-মায়েরই তো পড়ানোর সময় নেই। এই অযাচিত চাপে পড়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে, সেটা কি আমরা ভেবে দেখছি? তবে আশার কথা হচ্ছে, শিক্ষামন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, ২০১৮ সাল থেকে প্রাথমিক সমাপণী পরীক্ষা থাকবে না। মন্ত্রীর এ বক্তব্য যেন কথার কথা না হয়।
প্রাথমিক শিক্ষার হার বেড়েছে—শুধু এ নিয়ে আমাদের এখন আর গর্ব করার অবকাশ নেই। সময় এসেছে, সামনে এগোতে হবে, শিক্ষার মানোন্নয়নে মনোযোগ দিতে হবে, শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তি ও যুক্তিবোধ শাণিত করতে হবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত আজ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সিইও সরবরাহকারী দেশ। অর্থাৎ পৃথিবীর বহুজাতিক কোম্পানিগুলোতে যাঁরা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও হিসেবে কাজ করছেন, তাঁদের সিংহভাগই ভারতীয়। আর আমরা এখনো বিদেশে শ্রমশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে শুধু সংখ্যা নিয়ে গর্ব করছি। আবার সেই শ্রমিকেরা ইংরেজি না জানার কারণে বিদেশে নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই হচ্ছে আমাদের শিক্ষার হাল!
তবে এত কিছু বলার মানে কিন্তু এই নয় যে সৃজনশীল পদ্ধতি বাদ দিতে হবে। কথা হচ্ছে, সৃজনশীল পদ্ধতিকে আরও কার্যকর করার জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে, স্ববিরোধগুলো দূর করতে হবে।
প্রতীক বর্ধন: অনুবাদক, সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.