ক্ষমা করবেন, আনিস স্যার’by- সোহরাব হাসান

ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আমাদের, আমাদের আগের ও পরের কয়েক প্রজন্মের শিক্ষক। তিনি এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেন। যদি না-ও নিতেন, তিনি শিক্ষকই থাকতেন। তিনি কেবল শিক্ষার্থীদের শিক্ষক নন, শিক্ষার্থীদের যাঁরা শিক্ষক, তাঁদেরও শিক্ষক। বাংলাদেশে যাঁরা শুভবোধ ও চিন্তাকে এগিয়ে নেন, যাঁরা সত্যিকার শিক্ষা, জ্ঞান ও রুচির সাধনা করেন, তাঁদের সবার প্রিয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। শিক্ষা ও কর্মজীবনে যাঁরা এই মহান শিক্ষকের সান্নিধ্যে এসেছেন, তাঁর কাছ থেকে তাঁরা কিছু না কিছু পেয়েছেন। যে নির্মোহ ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি বাংলাদেশের সমাজকে পর্যবেক্ষণ করেছেন, এখনো করছেন, তার সমান্তরাল উদাহরণ নেই বললেই চলে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক হয়েও তিনি বেশি কাজ করেছেন বাংলাদেশের সমাজ নিয়ে।
মাত্র ২২ বছর বয়সে লেখা আনিসুজ্জামানের প্রথম বই মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য গবেষণা সাহিত্যে অনন্য উদাহরণ হয়ে আছে। তাঁর আরেকটি মূল্যবান গ্রন্থ পুরোনো বাংলা গদ্য। এর আগে ভাবা হতো, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির হাত ধরে বাংলা গদ্যের উদ্ভব। কিন্তু তিনি ব্রিটিশ লাইব্রেরির দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে প্রমাণ করেন যে ঔপনিবেশিক শক্তি এ দেশে আসার অনেক আগেই বাংলা গদ্য চালু ছিল। পরবর্তী সময়েও দেখেছি, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক ভেদ পেছনে ফেলে কীভাবে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারে, সেটাই তাঁর গবেষণা ও সাধনার কেন্দ্রবিন্দু।
আমাদের সমাজটি যখন নানা স্বার্থ ও দ্বন্দ্বে বিভাজিত, রাজনীতিতে যখন এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘৃণা ও বিদ্বেষে নিয়ত রক্তাক্ত করছে, তখন যে গুটি কয়েক মানুষ প্রীতি ও ঔদার্যের সঙ্গে সবাইকে কাছে টানেন, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য আনিসুজ্জামান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় শিক্ষক, পরিশ্রমী গবেষক—এসব তথ্য যতটা আমাদের আন্দোলিত করে, তার চেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা জাগায় মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি তাঁর দৃঢ় অবস্থান। তিনি মৃদুভাষী, বিনয়ী কিন্তু সত্য উচ্চারণে দ্বিধাহীন; এমনকি সেই সত্য যদি সহযাত্রী কিংবা সহমতের মানুষদের বিরুদ্ধেও যায়। আমাদের অধিকাংশ লেখক-বুদ্ধিজীবী যখন দল ও গোষ্ঠীর বিচারে শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করেন, আনিসুজ্জামান তখন নির্মোহ দৃষ্টিতে সমাজ ও মানুষকে বোঝার চেষ্টা করেন। শুভবোধ জাগ্রত করার সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।
মনে আছে, ১৯৯২ সালে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গোলাম আযমের বিচারের দাবিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে গণ-আদালত গঠিত হয়েছিল, সেই আদালতে আসামির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ পেশ করেছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। এই গণ-আদালতকে কেন্দ্র করে তৎকালীন বিএনপি সরকার যে ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করেছিল, তাঁদেরও একজন ছিলেন তিনি। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দর্শন বিভাগের রেফারেন্স থেকে পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর নেতা মাওলানা আবুল আলা মওদুদীর বই সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিলে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে আনিসুজ্জামান তার প্রতিবাদ করেছিলেন। তাঁর যুক্তি, মওদুদীর দর্শন যে এ যুগে অচল, সেটি শিক্ষার্থীদের জানতে দেওয়া উচিত। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৎকালীন অধ্যাপক আফতাব আহমদের শেষের দিকের রাজনৈতিক পথ ও মতের বিপরীতে ছিল তাঁর অবস্থান। ধর্মাশ্রয়ী জাতীয়তাবাদের সমর্থক আফতাব যখন জাতীয় সংগীত নিয়ে প্রশ্ন তুললেন, আরও অনেকের সঙ্গে আনিসুজ্জামানও প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু এই অভিযোগে একদল ছাত্র আফতাব আহমদের কক্ষে আগুন দিলে তিনি সেটি মানতে পারেননি। তখন সংবাদ-এ ‘ড. আফতাবের অপরাধ কতটা গুরুতর?’ শিরোনামে আমি একটি লেখা লিখলে তিনি লিখিত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন, আমরা আফতাবের মতের বিরোধিতা করতে পারি, কিন্তু তাঁর কক্ষে আগুন দিতে পারি না।’
১৯৯৯ সালে বিবিসির জরিপে ২০ জন শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকার এক নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং দুই নম্বরে রবীন্দ্রনাথকে স্থান দেওয়া হয়েছিল। তখন আনিসুজ্জামান তাঁর ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের স্থান এক নম্বরে দেখতে পেলেই তিনি খুশি হতেন। সে সময় এ বক্তব্য নিয়ে তাঁকে অনেক বিরূপ মন্তব্য শুনতে হয়েছে, হয়তো এখনো হচ্ছে। কিন্তু তিনি তাঁর অবস্থানে অনড়।
কারা হত্যার হুমকি দিচ্ছে, কেন দিচ্ছে, তার চেয়েও গভীর উদ্বেগের বিষয় হলো, ক্রমাগত এই হুমকি ও হামলার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। জনগণের মধ্য থেকেও তেমন জোরালো প্রতিবাদ লক্ষ করছি না

২০১৩ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার প্রথম রায় প্রকাশের পর অনেকে প্রতিবাদে ফেটে পড়লেন সর্বোচ্চ শাস্তি না পাওয়ায়। হয়তো তাঁদের সেই প্রতিবাদ যথার্থ ছিল। কিন্তু অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সেদিন বেশ জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘বিচার চেয়েছি, বিচার পেয়েছি। আবার যখন আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার প্রয়োজন হলো, তিনি পিছপা হননি।
মুক্তচিন্তার মানুষ হয়েও দলবিশেষের প্রতি অন্ধ আনুগত্য না দেখানো এবং অপ্রিয় সত্য কথা বলার কারণে আনিসুজ্জামানকে পেশাগত জীবনে একাধিকবার বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছে। স্বাধীনতার আগে ১৯৬৯ সালে বাংলা বিভাগে রিডারের পদে তিনি সবচেয়ে উপযুক্ত প্রার্থী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর স্থলে অন্য একজন শিক্ষককে নেওয়া হয়। ফলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নবীনতর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে স্বাধীনতার প্রস্তুতি পর্বে তাঁর ও সহকর্মীদের ভূমিকার কিছু বিবরণ আমরা পাই তাঁর আমার একাত্তর-এ। মুক্তিযুদ্ধের সময় শিক্ষক নেতা হিসেবে তিনি সারা ভারতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার পাশাপাশি মুজিবনগর সরকার গঠিত পরিকল্পনা সেলের (পরবর্তীকালে পরিকল্পনা কমিশন) সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপকের একটি পদ শূন্য হলে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের আগ্রহে তিনি আবেদন করেন। কিন্তু ক্ষমতার আশীর্বাদপুষ্ট ব্যক্তিরা চাইছিলেন না আনিসুজ্জামান ঢাকায় আসুন। সে সময় এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় নানা রকম লেখালেখি হলে আনিসুজ্জামান নিজেই প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি এলেন আরও প্রায় দেড় দশক পরে। ইঁদুর দৌড়ে অভ্যস্ত সমাজে এই ঔদার্য সবার থাকে না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে, যা আমাদের ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। আমরা জানি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানটি বাংলায় রচিত। কিন্তু এটি প্রথম ইংরেজি ভাষায় লেখা হয়েছিল। ড. কামাল হোসেন তখন আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী। তিনি ইংরেজিতে সংবিধানের খসড়া করেন, আর আনিসুজ্জামান সেটি বাংলা ভাষায় রূপ দেন। দ্বিতীয়ত, ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশনের অন্যতম সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
বাংলাদেশের বিদ্বৎসমাজের যে কজন মানুষকে বহির্বিশ্ব জানে বা চেনে, নিঃসন্দেহে আনিসুজ্জামান তাঁদের অগ্রগণ্য। ভারতের রাষ্ট্রীয় পদক পদ্মভূষণ তাঁকেই কেবল সম্মানিত করেনি, গৌরবান্বিত করেছে বাংলাদেশকেও। ইউরোপ-আমেরিকায়ও তাঁর গবেষণা সমাদৃত। পুব-পশ্চিমের লেখক–বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে কীভাবে তাঁর সংযোগ তৈরি হয়, সেসবের কিছু বিবরণ আমরা পাই তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই বিপুলা পৃথিবী ও কাল নিরবধিতে। দুটিই প্রথম আলোয় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল।
কিন্তু আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি যে এই সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষকও আমাদের এই সমাজে নিরাপদ নন। সম্প্রতি টেলিফোনের খুদে বার্তায় তাঁকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। এর আগেও অনেক লেখক-বুদ্ধিজীবী হামলা ও হুমকির শিকার হয়েছেন। শুনেছি তালিকা দীর্ঘতর হচ্ছে। কে কখন এই তালিকাভুক্ত হবেন, বলা কঠিন।
কারা হত্যার হুমকি দিচ্ছে, কেন দিচ্ছে, তার চেয়েও গভীর উদ্বেগের বিষয় হলো, ক্রমাগত এই হুমকি ও হামলার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। জনগণের মধ্য থেকেও তেমন জোরালো প্রতিবাদ লক্ষ করছি না। এ কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, যিনি আনিসুজ্জামানের ছাত্র ও সহকর্মী, সন্ত্রাসীদের হাতে সন্তান নিহত হওয়ার পর তাঁকে খেদের সঙ্গে বলতে শোনা যায়, ‘আমি বিচার চাই না। মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।’ শুভবুদ্ধির উদয় যে হয়নি, তার প্রমাণ কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হককেও হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। আর কত হামলা ও হুমকির শিকার হবে বাংলাদেশ?
যারা প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যা করেছে, যারা অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হককে হত্যার হুমকি দিচ্ছে, তারা অন্ধকারের জীব। কিন্তু এই অপশক্তিকে রুখে দেওয়ার জন্য যে বলিষ্ঠ উচ্চারণ, আইনের শাসনে বলবান রাষ্ট্রযন্ত্র প্রয়োজন, তার উপস্থিতি লক্ষ করছি না কোথাও। আমরা সবাই পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি। ভাবছি, আঘাতটি তো আমার ওপর আসেনি। আমার ওপর আঘাত এলে দেখা যাবে।
একের পর এক অঘটন ঘটছে, বেঘোরে মানুষ মারা যাচ্ছে, কিন্তু প্রতিকার পাচ্ছে না। কোথাও আশা দেখছে না। সবশেষে আশার স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছিল গণজাগরণ মঞ্চে। কিন্তু আমরা সেটিও নানা কৌশলে নির্বাপিত করে দিয়েছি। যে যার মতো কাজে লাগিয়েছি।
সংকীর্ণতা দিয়ে মহত্ত্ব অর্জন করা যায় না। বুকে হিংসা পুষে হিংসার বিরুদ্ধে লড়াই করা যায় না। এ জন্য চাই সমাজের ও রাজনীতির সর্বস্তরে শুভবোধের জাগরণ। সেই সুদিনের অপেক্ষায়।
ক্ষমা করবেন, আনিস স্যার।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.