ভিন্ন আমেরিকা! by-হাসান ফেরদৌস

রিতা হেওয়ার্থের কথা নিশ্চয় মনে আছে আপনাদের। হলিউডের নির্বাক যুগের ডাকসাইটে অভিনেত্রী, একসময় আগা খান সম্প্রদায়ের নেতা প্রিন্স আলী খানকে বিয়ে করে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিলেন। রিতা আর আলীকে সন্ধি করে মুজতবা আলী তাঁদের নাম দিয়েছিলেন ঋতালি। তো, এই হেওয়ার্থ তাঁর শেষ বয়সে এসে আক্ষেপ করেছিলেন, পুরুষেরা বড় আহ্লাদে আমার সঙ্গে নিশি যাপনে আসে। রাতে আমার মুখে থাকে রুজ-লিপস্টিক। তা দেখে সবাই ভাবে, আহা, এ নিশ্চয় মানবী নয়, দেবী। আর সকালে, সেই রুজ-লিপস্টিক উঠে গেলে, তারা তাকিয়ে দেখে, ওমা, দেবী কোথায়! এ তো আস্ত এক বুড়ি পেতনি।
আজকের আমেরিকাকে দেখে আমার এই হেওয়ার্থের কথা মনে পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থেকে পাড়ার পাদরি—সবাই দেশটাকে স্বর্গ হিসেবে বর্ণনা করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। আমেরিকার সবকিছু ভালো, এত ভালো যে সে যখন খারাপ কিছু করে, সেটাও নাকি আসলে অন্যের ভালোর জন্যই করে। যেমন ভিনদেশ আক্রমণ। যারা আক্রান্ত, তারা ঠিক বোঝে না, এটা তাদের ভালোর জন্যই করা হয়েছে।
তো, এই আমেরিকার একদল মানুষের খুব কদর্য একটা রূপ বেরিয়ে এসেছে। যাঁদের কথা বলছি, তাঁরা সবাই নামজাদা রাজনীতিবিদ, তাঁদের কেউ কেউ আবার দেশের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হতে চান। প্যারিসে ইসলামিক স্টেট (আইএস) নামের সন্ত্রাসী সংগঠনের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর এঁরা চেঁচানো শুরু করেছেন, এ দেশে মুসলমানদের নজরদারি বাড়াতে হবে। সিরিয়া থেকে যেসব উদ্বাস্তু ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে, তাদের মধ্যে বেছে বেছে শুধু খ্রিষ্টানদের ঢুকতে দেওয়া হবে, মুসলমান হলে তার জন্য দরজা বন্ধ। ৩০টির মতো অঙ্গরাজ্যের গভর্নররা বলেছেন, তাঁরা কেউ কোনো সিরীয় উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেবেন না। এঁদের মধ্যে নিউ জার্সির গভর্নর ক্রিস ক্রিস্টি বলেছেন, এমনকি তিন বছরের বাচ্চাও যদি এসে বলে, প্লিজ, ঢুকতে দাও, তিনি তাকে ঢুকতে দেবেন না।
সিরীয় মুসলমানদের কেন ঢুকতে দেওয়া হবে না, তার যুক্তি হিসেবে রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বেন কারসন বলেছেন, আপনার ঘরের আশপাশে যদি কোনো পাগলা কুকুর থাকে, তো আপনি কী করবেন, তাকে আদর করে ঘরে ডেকে নেবেন? তিনি যে সব সিরীয়কে কুকুরের সঙ্গে তুলনা করছেন না, তা বোঝানোর জন্য ব্যাখ্যা করে বলেছেন, না, সব কুকুরের কথা বলছি না, শুধু যেগুলো রোগগ্রস্ত ও পাগল, সেগুলোর কথা বলছি।
সবাইকে টেক্কা দিয়েছেন রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি প্রস্তাব করেছেন, এ দেশে যারা মুসলমান, তাদের ওপর নজরদারির জন্য একটি তালিকা বানাতে হবে, মসজিদে মসজিদে পাহারা বসাতে হবে, দরকার পড়লে মসজিদ বন্ধ করে দিতে হবে। তাদের জন্য আলাদা পরিচয়পত্র দিতে হবে, এমন এক প্রস্তাবও তঁার কাছ থেকে এসেছে। ব্যাপারটা অনেকটা তিরিশ দশকে হিটলারের জার্মানিতে ইহুদিদের সঙ্গে যেমন করা হতো। তিনি সত্যি এমন প্রস্তাব করছেন কি না, এক সাংবাদিক
তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলে ট্রাম্প পাল্টা প্রশ্ন করেন, তোমার কী মনে হয়? (পরে, সমালোচনার মুখে, ট্রাম্প অবশ্য দাবি করেছেন, মুসলমানদের পরিচয়পত্র দেওয়ার কথা তিনি বলেননি, এক সাংবাদিক তাঁর কথার অপব্যাখ্যা করেছেন।)
মার্কো রুবিও নামের আরেক রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ট্রাম্পকেও এক মাত্রা ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি দাবি করেছেন, না, শুধু মসজিদের ওপর নজরদারি করলে চলবে না, মুসলমানরা একসঙ্গে জড়ো হয়, এমন যেকোনো স্থানের ওপর নজরদারি করতে হবে। ক্যাফে, রেস্তোরাঁ বা ইন্টারনেট ক্যাফে, যেখানেই মুসলমানরা মিলিত হয় ও ঘোঁট পাকায়—এমন সব জায়গা বন্ধ করে দিতে হবে।
এঁদের কথা শুনে আমার সকালে ঘুম থেকে উঠে বসা লোলচর্মবিশিষ্ট এই হেওয়ার্থের কথা মনে হয়েছে। এই আমেরিকার বাইরের চেহারাটা যত আলো-ঝলমলে, তার ভেতরে ঠিক ততটা অন্ধকার।
আমাদের সৌভাগ্য, আমেরিকার সেটাই একমাত্র রূপ নয়। যেমন প্রেসিডেন্ট ওবামা সক্রোধে বলেছেন, সিরীয় উদ্বাস্তুদের যাঁরা ধর্মীয় পরীক্ষা দিয়ে পাস করার পর এ দেশে প্রবেশের প্রস্তাব রেখেছেন, তাঁরা আমেরিকান মূল্যবোধের কথা ভুলে গেছেন। আমেরিকা বরাবর সব ধরনের মানুষের জন্য দরজা খোলা রেখেছে, জাত-পাত-ধর্ম-বর্ণকে অগ্রাধিকার দেয়নি। ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিলারি ক্লিনটনও যেকোনো ‘ধর্ম পরীক্ষা’র বিরোধিতা করেছেন। আমাদের যুদ্ধ ইসলামের সঙ্গে নয়, একদল সন্ত্রাসীর সঙ্গে, যারা ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করছে মাত্র, তিনি বলেছেন।
প্যারিস হামলার চার দিনের মাথায় ওলাঁদ ঘোষণা করেছেন, তার দেশ ৩০ হাজার সিরীয় উদ্বাস্তু গ্রহণের যে অঙ্গীকার করেছে, তা রক্ষা করবে। ওলাঁদ বলেছেন, আমরা যেসব সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে লড়ছি, তারা একে দুই সভ্যতার লড়াই হিসেবে দাঁড় করাতে চায়। ‘কিন্তু আমাদের লড়াই কোনো এক সভ্যতার বিরুদ্ধে নয়। আমাদের লড়াই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে, যারা সব সভ্যতার বিরুদ্ধে’
এই মুহূর্তে অবশ্য ওবামা বা হিলারি আমেরিকায় সংখ্যালঘুদের দলে। গত সপ্তাহে মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদ বিপুল ভোটাধিক্যে এক প্রস্তাব পাস করেছে, যা গৃহীত হলে এ দেশে সিরীয় উদ্বাস্তুদের আশ্রয় পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। বস্তুত, সিরীয় উদ্বাস্তুদের আশ্রয়দানের বিরোধিতা করে—এমন মার্কিনির সংখ্যা ৫৪ শতাংশ। এই ভোটে সে কথারই প্রতিফলন মিলেছে।
প্যারিস হামলা আমেরিকান ও ইউরোপিয়ানদের মনে ভয়ের সঞ্চার করেছে, এ কথায় কোনো ভুল নেই। পরিকল্পিত ও সমন্বিত আক্রমণে যেভাবে নিরীহ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে, তাতে সবার মনেই অনিশ্চয়তা জন্মেছে। আক্রমণকারীদের মধ্যে অন্ততপক্ষে একজন সিরীয় উদ্বাস্তু ছিল, সে কথা জানার পর সেখান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের ব্যাপারে সংশয় জাগবে, সেটাও অস্বীকার করা যায় না।
প্যারিস হামলার পর সাধারণ মার্কিন নাগরিকদের মনে মুসলমানদের ব্যাপারে যে সন্দেহ জেগেছে, রাজনীতিবিদেরা তাকে নিজেদের রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহার করতে চান। তাঁরা হিসাব কষে দেখেছেন, যে যত বেশি নিজেদের আক্রমণাত্মক প্রমাণ করবেন, যত বেশি সামরিক শক্তির পক্ষে ঢাক বাজাবেন, জনপ্রিয়তার নিক্তিতে তত ওপরে উঠবেন তিনি। এই রাজনৈতিক অঙ্ক মাথায় রেখে প্রত্যেক রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী নির্বাচিত হলে কীভাবে এক চাপড়ে আইএস বা আল-কায়েদা উপড়ে ফেলবেন, সে কথা প্রমাণে ব্যস্ত। সিনেটর লিন্ডসি গ্রাহাম, যিনি মোটের ওপর বাস্তববাদী বলে পরিচিত, তিনি পর্যন্ত হুমকি দিয়েছেন, শুধু সিরিয়া বা ইরাকে নয়, পৃথিবীর যেখানে ইসলামি সন্ত্রাসীর খোঁজ মিলবে, সেখানেই বোমা ফেলে তাদের নিশ্চিহ্ন করতে হবে। ‘কোনো সীমানাগত নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, কত দিন এই অভিযান চলবে, তারও কোনো সময়সীমা থাকবে না।’ গ্রাহামের মতো আরও অনেকেই আইএস দমনে মার্কিন স্থলবাহিনী প্রেরণের পক্ষে।
সম্ভবত, ঠিক এই ধরনের একটি প্রতিক্রিয়াই আইএস প্রত্যাশা করেছিল। আমেরিকা, তথা পশ্চিমা সভ্যতা ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের সঙ্গে সব মুসলমানের পরিচয় গুলিয়ে ফেললে তাদের পক্ষে বলা সহজ হবে, আমেরিকা ও ইউরোপে সব মানুষ মুসলমানদের বিপক্ষে। অর্থাৎ, এই যুদ্ধটা দুই সভ্যতার বিরুদ্ধে, যার একদিকে জিহাদি, অন্যদিকে ক্রুসেডার। এসব সন্ত্রাসী সবচেয়ে বেশি খুশি হবে, যদি আমেরিকা ও তার পশ্চিমা মিত্ররা ইরাক অভিযানের মতো আরেক যুদ্ধ বাধিয়ে বসে। অধিকাংশ সুস্থির মস্তিষ্কের সব মানুষ বলেছেন, আইএসের জন্মের প্রধান কারণ ইরাকে আমেরিকার হামলা। প্রেসিডেন্ট ওবামা সেসব মানুষের একজন। এখন সেই ইরাকে—ও প্রতিবেশী সিরিয়াতে—যদি পুরোদস্তুর আরেক যুদ্ধ শুরু হয়, তাতে আইএসের পক্ষে নতুন জিহাদি সেনা সংগ্রহে মস্ত সুবিধা হবে। মার্কিন সাপ্তাহিক নেশন এক বিশেষ সম্পাদকীয়তে তাই মন্তব্য করেছে, আইএস চায় আমরা—অর্থাৎ আমেরিকানরা—মুসলমানদের ঘৃণা করি। আমাদের ঘৃণার মাত্রা যত বাড়বে, তাদের তত পোয়াবারো।
এসব মার্কিন রাজনীতিকের পাশে যদি ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদের সিদ্ধান্ত তুলনা করি, তাহলে শুধু তাদের স্বার্থপরতাই নয়, ভীরুতাও স্পষ্ট হয়। প্যারিস হামলার চার দিনের মাথায় ওলাঁদ ঘোষণা করেছেন, তঁার দেশ ৩০ হাজার সিরীয় উদ্বাস্তু গ্রহণের যে অঙ্গীকার করেছে, তা রক্ষা করবে। ওলাঁদ বলেছেন, ‘আমরা যেসব সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে লড়ছি, তারা একে দুই সভ্যতার লড়াই
হিসেবে দাঁড় করাতে চায়। কিন্তু আমাদের লড়াই কোনো এক সভ্যতার বিরুদ্ধে নয়। আমাদের লড়াই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে, যারা সব সভ্যতার বিরুদ্ধে।’
সাংবাদিক ও লেখক টিমথি ইগান ঠিকই মন্তব্য করেছেন, একমাত্র সংকটের সময়েই প্রমাণিত হয় প্রকৃত রাষ্ট্রনায়ক কে, আর কে ভীরু-কাপুরুষ। তিন বছরের শিশুকে শুধু মুসলমান এই কারণে যে তার মুখের ওপর ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়, সে কেবল কাপুরুষই নয়, সভ্য মানুষ—এই দাবিরও অযোগ্য। মানব ইতিহাসে এমন কাপুরুষের অভাব কোনোকালেই ছিল না। ১৯৩৯ সালে, ইহুদি এই কারণে জার্মানি থেকে আশ্রয়ের সন্ধানে আসা মানুষবোঝাই একটি জাহাজ ফ্লোরিডার উপকূল থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
আমাদের আশা, সেই একই ভুলের পুনরাবৃত্তি আর হবে না।
নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.