সিরিয়ার শান্তি–প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে কি? by- প্রতীক বর্ধন

তুরস্কের বিমানবাহিনী যে রাশিয়ার এসইউ-২৪ যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করল, তার ভুল-শুদ্ধ যা-ই হোক না কেন, এ রকম কিছু আসলে ঘটার অপেক্ষায় ছিল। মস্কো যখন সিদ্ধান্ত নিল যে তারা সিরিয়ায় হামলা চালাবে, তখনই বোঝা গিয়েছিল, এ রকম ঝুঁকি আছে।
একটি ঝুঁকি ছিল এ রকম যে রাশিয়া ও সিরিয়ার আকাশে অভিযান চালানোরত অন্যান্য শক্তির মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের কারণে এমন অঘটন ঘটতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিমান ভূপাতিত করতে পারে কিংবা তার উল্টোটাও হতে পারে। যদিও দেশ দুটি বলছে, তারা এক অভিন্ন শত্রু—ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে লড়াই করছে। বস্তুত, দুই দেশের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা দ্রুত একত্র হয়ে কিছু নিয়মকানুন প্রণয়ন করেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে, তারা সেটা মেনেও চলছে। তবে এই ব্যাপারটি দ্বিপক্ষীয় বিষয় হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় আমরা একরকম বেঁচে গেছি, এর কোনো জোটগত তাৎপর্য খুঁজে বের করার চেষ্টা হয়নি। অন্য কথায়, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এটাকে প্রথম ন্যাটো-রাশিয়া দ্বৈরথ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়নি।
মার্কিন ভাষ্যমতে, রাশিয়ার লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করার ক্ষেত্রে উচ্চপর্যায়ের নির্ভুলত্ব না থাকায় এবং যে এলাকায় তারা হামলা চালাচ্ছে, তাতে এমন ঝুঁকি ছিল যে তারা সিরিয়ার আকাশপথে না থেকে ভুল পথে চলে যেতে পারে অথবা বিপুলসংখ্যক বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করতে পারে। এর আগে রাশিয়া সিরিয়ায় বোমা হামলা চালানোর আগে তুরস্ক অভিযোগ করেছিল, রাশিয়ার বিমান তাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। সেবার তারা রাশিয়াকে সতর্ক করে দিয়েছিল, এরপরও এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে পাইলটকে গুলি করা হবে। আর এবার ঠিক সেটাই ঘটল।
আগের ঘটনার মতো এবারও বিমান কোথায় উড়ছে, সে বিষয়ে কোনো সমন্বয় হয়নি। আর বিশেষ করে সীমান্ত লঙ্ঘন করা হয়েছে। তুরস্ক বলেছে, তারা কয়েকবার সতর্কসংকেত দিয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও বিমানটি তাদের আকাশসীমায় ঢুকে পড়ায় তাদের পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া উপায়ান্তর ছিল না।
রাশিয়া সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছে, বিমানটি তুরস্কের আকাশসীমায় ঢোকেনি। তারা জোর দিয়ে বলেছে, বিমানটি পুরো সময় সিরিয়ার আকাশসীমার এক কিলোমিটার ভেতরেই ছিল। ওদিকে সিরিয়ার মধ্যেও কিন্তু বিমানটির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। ধারণা করা হয়, বিমানটি মাটিতে আছড়ে পড়ার আগেই একজন পাইলট মারা গেছেন, আর আরেকজন গ্রেপ্তার হতেও পারেন, আবার না–ও হতে পারেন—সৌভাগ্যবশত, সেই পাইলট ধরা পড়লেও আইএসের হাতে ধরা পড়েননি, স্থানীয় কোনো তুর্কি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছেন।
কথা হচ্ছে, সত্য যা-ই হোক না কেন, এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে তা সিরিয়া-বিষয়ক যে শান্তি আলোচনা হচ্ছে, তার জন্য ক্ষতিকর হবে, যেখানে রাশিয়া ও তুরস্ক উভয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আর তদন্ত যা হচ্ছে, তা এখনো কাদা-ছোড়াছুড়ির পর্যায়েই রয়েছে।
এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে তা সিরিয়া-বিষয়ক যে শান্তি আলোচনা হচ্ছে, তার জন্য ক্ষতিকর হবে, যেখানে রাশিয়া ও তুরস্ক উভয়েই খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে

যদিও তুরস্ক ও রাশিয়া সম্প্রতি খুবই বাস্তবসম্মত সম্পর্ক সৃষ্টি করেছে, তা সত্ত্বেও দুই দেশই যেন কিছু উত্তেজনা জিইয়ে রাখছে, এ ব্যাপারে তারা এককাট্টা। স্নায়ুযুদ্ধের সময় বার্লিনের সীমান্তের মতোই সোভিয়েত-তুরস্ক সীমান্ত পাহারা দেওয়া হয়েছে, সে সময় যারা আর্মেনিয়া থেকে ট্রেনে জর্জিয়া গিয়েছে, তারা সেটা জানে। নতুন ও পুরোনো নানা কারণেই সেই সতর্কতার পরিবেশ এখনো রয়েছে, এটা যেন বদ্ধমূল হয়ে গেছে।
সিরিয়ার যুদ্ধ ও সেখানে রাশিয়ার অংশগ্রহণের কারণে এই সম্পর্ক আরও জটিল হয়ে গেছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে রাশিয়া ও তুরস্ক এখন একই সঙ্গে এক পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করছে, আবার একে অপরের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো তুরস্ক বাশার আল-আসাদকে সরানোর ব্যাপারে আগ্রহী ছিল, বা তাদের চেয়ে আরও বেশি আগ্রহী ছিল, তবে এই ঘটনা তাকে সেই লক্ষ্য থেকে সরাতে পারেনি। এই ক্ষেত্রে তার লক্ষ্য রাশিয়ার বিপরীত। দুটি দেশই আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বদ্ধপরিকর, যদিও তুরস্ক বিমান হামলা চালিয়েছে মূলত কুর্দি বিদ্রোহীদের ওপর, অন্যদিকে রাশিয়া যেমন বাশারের বিরোধীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে, তেমনি আইএসের শক্তিশালী ঘাঁটিতেও হামলা করছে।
তুরস্কের এই রহস্যময় অবস্থানের কারণে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট খেপে গিয়ে বলেছেন, এই বিমান ভূপাতিত করার ঘটনা ‘সন্ত্রাসের সহযোগীদের দ্বারা আমাদের পিঠে ছুরি মারার মতো’। তাঁকে অবশ্যই অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোও আমলে নিতে হবে। রাশিয়ার এই যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হলো এমন এক সময়, যখন তার মাত্র তিন সপ্তাহ আগে তাদের এক বাণিজ্যিক বিমান ভূপাতিত হয়েছিল। পুতিন ক্রিমিয়া অধিগ্রহণের পর যে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, এই দুটি ঘটনা তাতে চিড় ধরাতে পারে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সিরিয়া-বিষয়ক যে আলোচনা চলছে, সেটাও কিন্তু পুতিনের জন্য একই রকম উদ্বেগের কারণ, যদিও সেটা শান্তি–প্রক্রিয়ার মানদণ্ড তেমন একটা পূরণ করছে না। এগুলো অবশ্যই ভালো হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। আর এটা বলাও ন্যায্য যে সিরিয়ার যুদ্ধে রাশিয়ার অংশগ্রহণ এবং বাশার ও কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর পেছনের দরজার সম্পর্কের কারণে আলোচনা শুরু করার ক্ষেত্রে সে এক অনন্য অবস্থানে ছিল।
কিন্তু মস্কো ও ব্যক্তিগতভাবে পুতিন শান্তি আলোচনার চেয়ে ভিয়েনার আলোচনায় বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। ক্রিমিয়ার বিষয়ে পশ্চিম ক্রেমলিনকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু ওই কারণে রাশিয়া পশ্চিমের এই প্রচেষ্টাকে পাশ কাটিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে আবারও শ্রদ্ধার জায়গা ফিরে পেতে পারে। যেকোনো চুক্তিতে তুরস্কের সই অন্য কারও সইয়ের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। এই অর্থে রাশিয়ার জ্বলন্ত বিমানের ভূপাতিত হওয়ার দৃশ্য সিরিয়ার শান্তি আলোচনার তাৎক্ষণিক সম্ভাবনার রূপক হিসেবে দেখা যায়, বা রাশিয়াকে বৈশ্বিক কূটনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পুতিনের আশাবাদের রূপক হিসেবেও এটাকে দেখা যায়।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
ম্যারি দাইয়েফস্কি: সাংবাদিক ও লেখক।

No comments

Powered by Blogger.