ঘোরাঘুরি নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য by-এ কে এম জাকারিয়া

ভ্রমণ নিয়ে জ্ঞানী-গুণীরা যুগে যুগে কত কথাই না বলে গেছেন। জাপানের পঞ্চদশ শতকের কবি মাৎসু বাসো সেই কবে বলে গেছেন, ভ্রমণই হচ্ছে আমার বাড়িঘর। ফরাসি ঔপন্যাসিক গুস্তাভ ফ্লামবার্টের কথায়: ‘ভ্রমণ একজনকে বিনয়ী করে। কারণ, আপনি বুঝতে পারবেন যে এই পৃথিবীতে আপনি কত ছোট জায়গা দখল করে আছেন।’ নোবেল বিজয়ী কবি-লেখক ডেরেক ওয়ালকট ভ্রমণের মাহাত্ম্য নিয়ে বলেছেন, ‘আমি পড়ি, আমি ভ্রমণ করি, আমি আমিতে পরিণত হই।’ ভ্রমণ অনেকের কাছে একটি নেশা, এই নেশা যাঁকে পেয়ে বসে, তাঁর পক্ষে থামা কঠিন। তবে আধুনিক যুগে ভ্রমণ ভোগবাদিতারও একটি অংশ। আপনি বছরে কয়বার বিদেশে যান, তার সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামাজিক মানমর্যাদার সম্পর্ক রয়েছে। যা কিছু মানুষের নেশার মধ্যে আছে, যা ভোগবাদিতার মধ্যে পড়ে, তা নিয়ে বাণিজ্য জমে উঠবে, এটাই স্বাভাবিক। মানুষের ভ্রমণের চাহিদা মেটাতে গিয়ে পর্যটন নামের শিল্প আজ বিশ্ব অর্থনীতির এক বড় অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সারা দুনিয়ায় পর্যটকের সংখ্যা ১০০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে বলা হচ্ছে, আগামী বছরগুলোতে সবচেয়ে দ্রুত বিকাশ হবে এমন শিল্পের একটি হচ্ছে পর্যটন। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল ও ট্যুরিজম কাউন্সিল ২০১২ সালের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে যে হিসাব দিয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে শিল্প-কলকারখানা, খুচরা ব্যবসা, আর্থিক সেবা ও যোগাযোগ খাতের ব্যবসার তুলনায় পর্যটন খাতের ব্যবসার বিকাশ ছিল দ্রুত। বিশ্ব জিডিপিতে এই খাতের অবদান দাঁড়িয়েছে ৩ শতাংশে। ২০১২ সালে সারা দুনিয়ায় যে ২৬ কোটি কর্মসংস্থান হয়েছে, তার মধ্যে ৫০ লাখই হয়েছে পর্যটনশিল্পে। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, প্রতি ১১টি চাকরির মধ্যে একটি কোনো না কোনোভাবে পর্যটনসংশ্লিষ্ট।
পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আমাদিউস অক্সফোর্ডের কিছু অর্থনীতিবিদকে দিয়ে পর্যটনশিল্পের সামনের সম্ভাবনা বিষয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করিয়েছে। তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে, আগামী ১০ বছর ধরে প্রতিবছর পর্যটন খাতে প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ হারে। এতে দুনিয়াজুড়ে পর্যটনশিল্পে কর্মসংস্থানের বিরাট সুযোগ তৈরি হবে। পর্যটন এমনই এক ব্যতিক্রমী বাণিজ্য, যাতে নিজ দেশে লোক নিয়ে এসে বিদেশি মুদ্রা আয় করা যায়। বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতির বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি বড় খাত হচ্ছে পর্যটন।
যে শিল্প বিশ্ব অর্থনীতিতে এত বড় জায়গা দখল করে নিয়েছে, সামনে আরও বাড়বে বলে ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে, সেই শিল্পের প্রতি বাড়তি মনোযোগী না হয়ে উপায় নেই। বাংলাদেশ সরকার ২০১৬ সালকে পর্যটনবর্ষ ঘোষণা করেছে। একটি লক্ষ্যও ঠিক হয়েছে। আগামী বছর ১০ লাখ পর্যটক আনতে চায় বাংলাদেশ। দেশে দেশে এ ধরনের পর্যটন বছর ঘোষণার রেওয়াজ রয়েছে। পর্যটক আনতে তখন দেশগুলো বাড়তি অর্থ খরচ করে, তবে যা খরচ হয়, তার বহুগুণ ফিরে আসে। পর্যটন বছরে বাড়তি পর্যটক আনতে তারা কী কী করেছে, কোনগুলো কাজে দিয়েছে, তা আমরা বিবেচনায় নিতে পারি আমাদের পর্যটনবর্ষকে সফল করতে।
পর্যটনশিল্পে বাজার নিতে হলে শুধু একটি বছরকে পর্যটন বছর ঘোষণাই যথেষ্ট নয়। সেই বছরটি নিয়ে কাজের কাজ কিছু হয় এমন পরিকল্পনা ও কৌশল নিতে হবে। যেসব দেশ থেকে বাংলাদেশে পর্যটক আসার সম্ভাবনা বেশি, সেগুলো চিহ্নিত করে সেখানকার বাংলাদেশ মিশনগুলোকে প্রচার-প্রচারণার মিশনে নামতে হবে

পর্যটনশিল্পে আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে। বাংলাদেশ পর্যটন বছর ঘোষণা করে যেখানে আগামী বছর ১০ লাখ পর্যটক আনার লক্ষ্য ঠিক করেছে, সেখানে শ্রীলঙ্কার এ বছরের লক্ষ্য ছিল ২০ লাখ পর্যটক নিয়ে আসা। ভারতের কথা বাদ থাক, দীর্ঘদিন অনেকটা নিষিদ্ধ দেশ হিসেবে ছিল যে মিয়ানমার, সেটিও এখন এ অঞ্চলে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। ২০১৩ সালে প্রায় ৭৬ লাখ পর্যটক ভিয়েতনাম সফর করেছেন। কম্বোডিয়া সফর করেছেন ৪২ লাখের বেশি পর্যটক। এসব পরিসংখ্যান থেকে বাংলাদেশের পর্যটন এবং এই শিল্পের অবস্থা সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশে বছরে কত পর্যটক আসেন, তার কোনো বস্তুনিষ্ঠ তথ্য বা পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) পরিচালক তৌফিক রহমানকে দীর্ঘদিন ধরে জানি। বলা ভালো যে তাঁর সংগ্রামের কথা জানি। বিদেশ থেকে নিয়মিত পর্যটক বাংলাদেশে আনতে গিয়ে কত ঝক্কি-ঝামেলায় পড়েন, তা তাঁর মুখে বহুবার শুনেছি।
‘আমাদের দেশে সভা-সেমিনারে অনেক কর্তাব্যক্তির মুখেই লাখ লাখ পর্যটক নিয়ে আসার কথা শুনি। অথচ আমরা নিজেরাই জানি না যে গত পাঁচ বছরে দেশে কী পরিমাণ পর্যটক এসেছেন। সংখ্যার দিক দিয়ে কোন দেশগুলোর পর্যটকেরা প্রথম ১০টি বা ৫টি দেশের মধ্যে রয়েছেন। কী কারণে তাঁরা বাংলাদেশে আসেন, গড়ে কত দিন বাংলাদেশে থাকেন, কত খরচ করেন কিংবা বাংলাদেশে এসে তাঁরা কী কী দেখতে চান—এ ধরনের কোনো গবেষণালব্ধ তথ্য আমাদের কাছে নেই।’ এই আক্ষেপ তাঁর মুখে শুনেছি গত বিশ্ব পর্যটন দিবসের (২৭ সেপ্টেম্বর) আগে। বোঝা যায়, পর্যটনশিল্প এগিয়ে নিতে কাজের কাজ কিছু করার চেয়ে আমরা অনেক পিছিয়ে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব পর্যটন ব্যবসায় জায়গা করে নিতে হলে গবেষণা ও তথ্য-উপাত্ত খুবই জরুরি। এসবের ওপর ভিত্তি করেই কোন কোন ক্ষেত্রে বা কোন কোন দেশের পর্যটকদের প্রতি বাড়তি নজর দেওয়া দরকার অথবা কোথায় কী সম্ভাবনা রয়েছে, তা নির্ধারণ করা সম্ভব।
এই যে আগামী বছর পর্যটন বছর ঘোষণা ও ১০ লাখ পর্যটক আনার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে কোন কোন দেশের পর্যটকদের আকর্ষণের চেষ্টা করা হবে বা কিসের ভিত্তিতে তা করা হবে, সে রকম কিছু কি আদৌ ঠিক করা হয়েছে? বাংলাদেশে সাধারণত কোন কোন দেশের পর্যটক আসেন, তার একটি ধারণা পাওয়া যায় সেই বছর আটেক আগে ২০০৭ সালে প্রকাশিত পর্যটন করপোরেশনের একটি পরিসংখ্যানে (ওই বছর ২ লাখ ৯০ হাজারের মতো পর্যটক এসেছিলেন)। ধারাবাহিকভাবে দেশগুলো হচ্ছে ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও চীন। ধারণা করা যায় যে এই দেশগুলোর মধ্যে প্রথম চারটি দেশ থেকে যে পর্যটকেরা এসেছেন, তাঁদের মধ্যে একটি বড় অংশ হচ্ছে বাংলা ভাষাভাষী বা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লোকজন। সেদিক থেকে দেখলে চীন থেকে আসা ভ্রমণকারীরা বাংলাদেশে আসেন শুধুই ভ্রমণ বা একটি নতুন দেশ দেখা বা অন্য কোনো তাগিদ থেকে। পর্যটনবর্ষে পর্যটক আকর্ষণে চীন হতে পারে আমাদের এক গুরুত্বপূর্ণ টার্গেট।
চীন এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পর্যটক জোগান দেওয়া দেশ। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আমাদিউসের গবেষণা প্রতিবেদনের কথা আগেই বলেছি। সেই প্রতিবেদন বলছে, ২০২৩ সালের মধ্যে বিশ্বের পর্যটকদের ২০ ভাগই হবে চীনের নাগরিক। কারণ, এই সময়ের মধ্যে অন্তত ২২ কোটি চীনা নাগরিক বছরে দুবারেরও বেশি বিদেশ ভ্রমণ করার মতো অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করবেন। চীনের বাইরে রাশিয়া, ব্রাজিল, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্কের মতো দেশগুলোর নাগরিকেরাও সম্পদ বৃদ্ধি ও ভোগবাদিতার ধরন পরিবর্তনের কারণে বিদেশ ভ্রমণ ও পর্যটনের দিকে ঝুঁকবে। আগামী ১০ বছরে এসব দেশ থেকে বিদেশে যেতে আগ্রহী পর্যটকের সংখ্যা প্রতিবছর ৫ শতাংশ করে বাড়তে থাকবে।
চীনের পরে পর্যটক জোগান দেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারত। ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান বলছে, ওই বছর দেশটির প্রায় দেড় কোটি পর্যটক বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। বাংলাদেশে পর্যটন ব্যবসায় সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে ভারতীয় পর্যটকদের। স্থলপথে বাংলাদেশে আসার সুযোগ থাকায় খুবই সহজ ও সাশ্রয়ী ভ্রমণেরও সুযোগ নিতে পারেন অনেক ভারতীয় পর্যটক। আবার ভারত একই সঙ্গে সারা দুনিয়া থেকে অসংখ্য পর্যটকও আকর্ষণ করে। ভারতে আসা এই পর্যটকেরাও হতে পারেন সম্ভাব্য বাংলাদেশ ভ্রমণকারী। সে ক্ষেত্রে ভারত ভ্রমণের আগে-পরে সেই পর্যটকেরা যাতে বাংলাদেশ ঘুরে যেতে আগ্রহী হন, সে ধরনের কিছু উদ্যোগ ও কৌশল নেওয়ার বিষয়টি চিন্তাভাবনা করতে হবে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পর্যটক জোগান দেওয়া দুটি দেশই ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের কাছাকাছি—এর চেয়ে বড় সুযোগ আর একটি দেশের পর্যটনশিল্পের জন্য কী হতে পারে!
চীনের বৌদ্ধ ধর্মগুরু, পণ্ডিত ও পরিব্রাজক হিউয়েন সাং সেই সপ্তম শতকে ভারত এমনকি এই বাংলাও সফর করে গেছেন। হিউয়েন সাংয়ের সেই দিন এখন আর নেই। পর্যটকেরা এখন আর এভাবে অজানার পথে বেরিয়ে পড়েন না। তাঁদের নিয়ে আসতে হয়,
আকৃষ্ট করতে হয়। এবং সে জন্য নানা অবকাঠামো, সুযোগ-সুবিধা, নীতি ও পর্যটকবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হয়। আবার সেই বিষয়গুলোকে প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে ছড়িয়েও দিতে হয়।
পর্যটনশিল্পে বাজার নিতে হলে শুধু একটি বছরকে পর্যটন বছর ঘোষণাই যথেষ্ট নয়। সেই বছরটি নিয়ে কাজের কাজ কিছু হয় এমন পরিকল্পনা ও কৌশল নিতে হবে। যেসব দেশ থেকে বাংলাদেশে পর্যটক আসার সম্ভাবনা বেশি, সেগুলো চিহ্নিত করে সেখানকার বাংলাদেশ মিশনগুলোকে প্রচার-প্রচারণার মিশনে নামতে হবে। বিশেষ কিছু অনুষ্ঠান হাতে নিতে হবে। পর্যটক বছর শুরুর আগেই পর্যটকবান্ধব কিছু বিধিবিধান ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তও নিতে হবে। বিশেষ করে ভিসা-ব্যবস্থা সহজ করা, অনলাইনের মাধ্যমে ভিসা আবেদনের সুযোগ, বিশ্বের যে ৬৩টি দেশের নাগরিকেরা অন-অ্যারাইভাল ভিসা পান, তা স্থলসীমান্তের ক্ষেত্রে কার্যকর করা—এসব বিষয় ভাবা যেতে পারে। তবে এ জন্য পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা করলে নানা পরামর্শ পাওয়া যাবে। কারণ, সমস্যা ও বাধাগুলো তাঁরাই সবচেয়ে ভালো জানেন।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.