প্রস্তাবিত বিল সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক by- ডেনিস দিলীপ দত্ত

গত ১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে তিনটি বিল উত্থাপিত হয়েছে। এই তিনটি বিলের অন্যতম ছিল বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম) রেগুলেশন বিল, ২০১৫। বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী। ইতিমধ্যে বৈদেশিক সাহায্য (স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম) রেগুলেশন অধ্যাদেশ, ১৯৮৭ এবং বৈদেশিক অনুদান (রেগুলেশন) অধ্যাদেশ, ১৯৮২ নামক দুটি অধ্যাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বাতিল ঘোষণা করেছেন। কারণ, এই দুটি অর্ডিন্যাস (অধ্যাদেশ) দেশে তখনকার সামরিক সরকার জারি করেছিল। কারণ, সামরিক সরকার প্রদত্ত অধ্যাদেশ/আইন অসাংবিধানিক। বর্তমানে একটি শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে এবং তা পূরণের জন্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নতুন একটি আইন প্রণয়ন করার। ফলে ‘বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম) রেগুলেশন আইন, ২০১৫’ নামে একটি বিল সংসদে উত্থাপিত হয়েছে এবং সংসদীয় প্রথা অনুযায়ী বিলটি আইন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়েছে।
এই নতুন বৈদেশিক অনুদান সম্পর্কিত বিলটি নিয়ে আপত্তি তুলেছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বা এনজিও। তাদের মতে, এনজিও ব্যুরোর ক্ষমতা অহেতুক বাড়ানো হয়েছে। এনজিও/বেসরকারি সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা গত ৩০ সেপ্টেম্বর আইন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং লিখিতভাবে ‘অভিযোগ’ করেছেন। তাঁরা এই বিলে যেসব অসংগতি রয়েছে, সেগুলো এবং কার্যক্রম পরিচালনা করতে যেসব বাধার সৃষ্টি হবে, তা ব্যাখ্যা করেছেন। সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘কমিটি সবার সঙ্গে পরামর্শ করে বিলটি চূড়ান্ত করবে। তবে সবাইকে মনে রাখতে হবে, এ দেশ সার্বভৌম; কারও নির্দেশে চলবে না।’ (প্রথম আলো, অক্টোবর ১, ২০১৫)। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের শেষের বক্তব্যে দেশের সার্বভৌমত্বের বিষয়টি অবশ্যই চিন্তার বিষয়। কিন্তু তাঁকে ও এনজিও ব্যুরোকে প্রশ্ন করি, দেশের বেসরকারি সংস্থাসমূহ অতীতে দেশের সার্বভৌমত্বের বিপক্ষে কি কোনো কিছু করেছে? বেসরকারি সাহায্য সংস্থাগুলো তো সরকারের পরিপূরক, প্রতিবন্ধক নয়। তাহলে সার্বভৌমের প্রশ্ন কেন আসছে?
এনজিওগুলোর প্রতিনিধিরা বলেছেন, ‘এনজিও ব্যুরোর ক্ষমতা অহেতুক বাড়ানো হয়েছে।’ এনজিও ব্যুরোর কাজ হচ্ছে, এনজিওগুলোকে মনিটরিং করা, কন্ট্রোল করা নয়। এনজিও ব্যুরোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তো দেশেরই মানুষ। এনজিওগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও তাই। সবাই মিলে দেশ গড়বেন। এখানে তাঁরা অহেতুক ক্ষমতা বাড়ানো এবং গ্রহণের চেষ্টা কেন হবে? এনজিওগুলোর অবদান কি সরকার ও দেশের মানুষ অস্বীকার করতে পারেন?
তবে হ্যাঁ, অধিকারভিত্তিক (রাইট বেজড) এনজিওগুলোর প্রতিবেদনগুলোর কারণে মাঝে মাঝে সরকার বিব্রত বোধ করেছে। অনেক সময় দেখা যায়, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিবেদন সরকার ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। সেটি না করে এসব প্রতিবেদন বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত। যদি সততার অভাব থাকে, তবে তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার অধিকার তো সরকারের রয়েছে।
সামরিক সরকারের সময়ে প্রণয়ন করার কারণে যেহেতু অধ্যাদেশ দুটি (বৈদেশিক সাহায্য অধ্যাদেশ, ১৯৭৮ এবং বৈদেশিক অনুদান অধ্যাদেশ, ১৯৮২) বাতিল করা হয়েছে, সেই একই কারণে তো সামরিক সরকারের আমলে প্রণীত রিলিজিয়াস ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট-১৯৮৩ বাতিল হওয়া উচিত। অথচ রিলিজিয়াস ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট দ্বারা সরকার ধর্মকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছে। রিলিজিয়াস ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের সদস্যরা সরকার কর্তৃক মনোনীত। সাধারণত ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা এ মনোনয়ন পেয়ে থাকেন। ট্রাস্ট কম্পোজিশনে/বোর্ড তৈরির ক্ষেত্রে যে নিয়মাবলি রয়েছে, তা অবমাননাকর। বিশেষ করে ৫/৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সরকার যেকোনো সময় কোনো কারণ না দর্শিয়ে যেকোনো ট্রাস্টির সদস্যকে বহিষ্কার করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে কোনো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি ট্রাস্টে যোগ দেবেন না।
শুধু আমাদের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়নি, জাতিসংঘ প্রণীত ‘মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র’-এর ১৮ অনুচ্ছেদে যে ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তাও এই প্রস্তাবিত বিলে হরণ করা হয়েছে
প্রস্তাবিত বিলটিতে কিছু অসংগতি দেখা যাচ্ছে। যেমন- ১. বিলটির নামকরণ করা হয়েছে ‘বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম) রেগুলেশন আইন, ২০১৫’। এই আইনের আওতায় ‘ধর্মীয়’ কার্যক্রমকে স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম বলে অভিহিত করা হয়েছে। কোনো ধর্মীয় কার্যক্রম কখনোই স্বেচ্ছাসেবামূলক নয় বরং বাধ্যতামূলক। নামাজ, পূজা, প্রার্থনা এবং উপাসনার বাইরেও কিছু ধর্মীয় ক্রিয়াকর্ম রয়েছে, যা ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মসজিদ, মন্দির, চার্চ, প্যাগোডা রক্ষণাবেক্ষণ; মক্তব, মাদ্রাসা, সেমিনারি, টোল, এতিমখানা প্রভৃতি পরিচালনা ধর্মীয় কর্ম। এই সমস্ত কর্মকাণ্ড সাধারণভাবে স্বেচ্ছামূলক কাজ নয়। অপরদিকে স্বেচ্ছাসেবকমূলক কাজ হচ্ছে স্বেচ্ছায় কাজ করা।
বাংলাদেশের প্রতিটি ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একই ধর্মীয় জনগোষ্ঠী সুগভীর ধর্মীয় বন্ধনে আবদ্ধ। এই বন্ধনের কারণে একই ধর্মীয় বিশ্বাসীরা অন্য দেশে অবস্থিত সমধর্মীয় বিশ্বাসীদের সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকে। বাংলাদেশসহ প্রতিটি দেশে প্রতিটি ধর্মে এই সহযোগিতার আদর্শ পালিত হয়ে আসছে। এই সাহায্য গ্রহণের জন্য নিবন্ধনের প্রয়োজন বাধ্যতামূলক হলে তা ধর্মীয় স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করতে পারে। এসব সাহায্য-সহযোগিতা শুধু ধর্মকর্মে ব্যবহৃত না হয়ে যদি অন্য কোনো ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, তবে সরকারের প্রশাসন উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
২. আমাদের সংবিধানের ধারা ৪১-এ বলা হয়েছে, ‘(১) আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের যেকোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে; (খ) প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপসম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রহিয়াছে।’ কিন্তু প্রস্তাবটিতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার ওপর কঠোর বাধানিষেধ আরোপ করা হয়েছে, যা সাংবিধানিক অধিকারে হস্তক্ষেপের শামিল হবে।
শুধু আমাদের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়নি, জাতিসংঘ প্রণীত ‘মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র’-এর ১৮ অনুচ্ছেদে যে ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তাও এই প্রস্তাবিত বিলে হরণ করা হয়েছে বলে মনে করি।
৩. আমাদের দেশে আইন কমিশন রয়েছে। বোধ করি প্রতিটি নতুন আইন পাস করার আগে আইন কমিশনের অভিমত গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। এই বিলটি আশা করি আইন কমিশন পর্যালোচনার সুযোগ পেয়েছে অথবা প্রদান করা হয়েছে। বিলটি জাতীয় সংসদে অনুমোদনের আগে সংসদীয় কমিটিকে এনজিওগুলোর অবদানকে স্মরণ রেখে এবং ধর্মীয় স্বাধীনতাকে রক্ষণ করে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে বিলের ভাষা ও ভাবনাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে গ্রহণ করা উচিত হবে। এ প্রসঙ্গে ধর্মীয় নেতাদের চিন্তা-চেতনাকেও অনুধাবন করতে হবে।
ডেনিস দিলীপ দত্ত: সমাজকর্মী, বেসরকারি সংস্থার সাবেক কর্মকর্তা।

No comments

Powered by Blogger.