সিলেটে পুলিশের সোর্স রুবেলকে গণপিটুনি by ওয়েছ খছরু

অস্থির রাজনৈতিক সময়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন সিলেটে পুলিশের কথিত ‘সোর্স’ বলে দাবিদার রুবেল আহমদ। নিজেকে পরিচয় দেন সিলেটের কোতোয়ালি থানার সাবেক সহকারী কমিশনার (এসি) একেএম সাজ্জাদুল হকের ‘সোর্স’ হিসেবে। দাম্ভিকতার সঙ্গে বলেন, ‘আমি বললে পুলিশ ধরবে। নতুবা শান্তিতে থাকতে পারবা না।’ এই দম্ভ দেখিয়ে সিলেট নগরীর কলাপাড়া, ঘাষিটুলা, বেতেরবাজার, মোল্লাপাড়া, নবাব রোড ও মজুমদারপাড়া এলাকায় একতরফা আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন। হাতে বিরোধীজোট বিএনপি, জামায়াতচক্রের নেতাদের তালিকা। ওই তালিকা তিনি নিজেই তৈরি করেন। হাতে থাকা তালিকা নিয়ে শুরু করেন অপারেশন। লামাবাজার ফাঁড়ির পুলিশের সঙ্গে রয়েছে বিশেষ সংখ্য। এ কারণে পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে তিনি মহড়া দেন এলাকায়। আর সেই থেকে রুবেল শুরু করেন টাকা কামাইয়ের ধান্ধা। ৬টি এলাকায় কম হলেও শতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে সোর্স পরিচয়ে রুবেল হাতিয়ে নিয়েছে লাখ লাখ টাকা। পুলিশের ধরপাকড়ের ভয় দেখিয়ে সে ওই টাকা লুটে নেয়। এতেও ক্ষান্ত হয়নি রুবেল। হাতা ভ্যান গাড়িওয়ালা, রিকশাওয়ালাসহ এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ইয়াবা দিয়ে ধরিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে পকেটস্থ করেছে টাকা। রুবেলের যন্ত্রণায় রীতিমত অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন এলাকাবাসী। পরিচিত পুলিশদের দিয়ে ধরপাকড়ের ভয় দেখিয়ে টাকা নেয়ার ঘটনায় তার বিরুদ্ধে রীতিমত ক্ষোভ বিরাজ করছে এলাকায়। এখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ স্বাভাবিক। রুবেলের নিয়ন্ত্রিত ওই সব এলাকায় নেই কোন অস্বাভাবিক অবস্থা। এরপরও রুবেলের বহুরূপী কর্মকাণ্ড থেমে না যাওয়ায় রোববার রাতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এলাকার মানুষ। ওই সময় তারা স্থানীয় ঘাষিটুলা গোরস্থানের সামনে তাকে গণধোলাই দিয়েছেন। গণধোলাইয়ের ঘটনার পর দুদিন ছিল সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। কিছুটা সুস্থ এখন। তার ওপর হামলাকারীদের তালিকা প্রস্তুত করেছে সে। আর ওই তালিকায় থাকা এলাকাবাসীকে আসামি করে মামলা দায়ের করতে পুলিশের পরিচিত কর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। এ নিয়ে নতুন করে ক্ষোভ বাড়ছে এলাকায়। রুবেলের আদি বাড়ি সিলেটের বাইরে। ময়মনসিংহ এলাকায়। কাজের সন্ধানে আসা পরিবারের সঙ্গে রুবেলের পূর্বের বসতি ছিল সিলেট নগরীর কুয়ারপাড় এলাকায়। ওই এলাকায় রুবেলের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন স্থানীয়রা। এ কারণে এক সময় রুবেলকে তাড়িয়ে দেয়া হয় নগরীর এলাকা থেকে। এরপর রুবেল তার পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস শুরু করে নগরীর কলাপাড়া এলাকায়। বর্তমানে রুবেল কলাপাড়া দুর্বার ৭০-১ আসাকি এলাকার বাসিন্দা। কলাপাড়া, ঘাষিটুলা, বেতেরবাজার, মোল্লাপাড়া, নবাব রোড ও মজুমদারপাড়া এলাকার বাসিন্দারা জানান, প্রায় ১০ বছর ধরে রুবেল ওই এলাকায় বাস করছে। প্রথমে টুকটাক কাজ করলেও গেল কয়েক বছর ধরে সে নিজেকে পুলিশের ‘সোর্স’ বলে পরিচয় দিচ্ছে। এলাকায় কোন ঘটনা ঘটলেই রুবেল গিয়ে হাজির। পুলিশি ঝামেলায় সহায়তা করার জন্য এগিয়ে দেয় হাত। বিবদমান দুইপক্ষকে মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে টাকা আত্মসাত করাই তার মুখ্য উদ্দেশ্য। এভাবে বেশ কয়েকটি ঘটনার জন্ম দিয়েছে সোর্স রুবেল। এরই মধ্যে ২০১৩ সালে এলো রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়। রুবেল হয়ে ওঠে সক্রিয়। ওই সময় লামাবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জের সঙ্গে ভাল সংখ্য গড়ে তোলে। ইনচার্জের কথামতো রুবেল এলাকায় থাকা বিএনপি ও জামায়াতের কর্মী, সমর্থকদের তালিকা প্রস্তুত করে। আর এই তালিকা নিয়ে রাতে আঁধারে বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের বাসাবাড়িতে শুরু করে অভিযান। এলাকার লোকজন জানান, প্রতিটি অভিযানে পুলিশের সঙ্গে রুবেল উপস্থিত থাকতো। পুলিশকে দিয়ে অভিযান চালিয়ে রুবেল ফিরে আসতো। এরপর শুরু হতো টাকা নিয়ে দেনদরবার। এভাবে রুবেল এলাকায় বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের ঘরে ঘরে অভিযান চালায় আর লুটে নেয় টাকা। এ কারণে রুবেলের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে অনেক সমর্থক এলাকা ছাড়া হয়েছিলেন। এরপর চলতি বছরের শুরুর দিকেও রুবেল একইভাবে শুরু করে সোর্সগিরি। আর তখন সে পরিচয় দিতো সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ কোতোয়ালি থানার এসি একেএম সাজ্জাদুল হকের। বলতো, ‘সাজ্জাদুল হক তার ঘনিষ্ঠজন। এসি সাজ্জাদ তালিকা প্রস্তুত করে তার হাতে দিয়েছেন। এখন তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।’ স্থানীয়রা জানান, সোর্স রুবেল ওই তালিকা নিজেই প্রস্তুত করেছিল। ওই তালিকায় শুধু বিএনপি ও জামায়াতের কর্মীদের নামই ছিল না, ছিল অনেক আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থকদের নামও। আর গ্রেপ্তার এড়াতে ওই সময় রুবেল ১০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ গ্রহণ করে। আর ওই টাকার ভাগবাটোয়ার পুলিশের অনেক মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা শরিক হয়েছেন। ওই সময় রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে এলাকার অর্ধশতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। গতকাল এলাকায় খবর নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে রুবেল এলাকার হাজী মতিন মিয়া, বদুরী মিয়া, হাজী লায়েক মিয়া, রকিব মিয়ার কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়েছে। এছাড়া জসিম নামে একজনের কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকা, জুমনের কাছ কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা, আপ্তাব উদ্দিনের কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা, ভাঙ্গারি ব্যবসায়ী লাবুর কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা, আছাব আলীর কাছ থেকে ১৫ হাজারসহ এলাকার অনেকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সোর্স রুবেল গণপিটুনি খাওয়ার পর থেকে তার এসব অপকর্মের ঘটনাবলী মানুষের মুখে মুখে রটছে। এর মধ্যে ভাঙ্গারি ব্যবসায়ী লাবুকে ইয়াবা দিয়ে পুলিশে ধরিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়। এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা কমে যাওয়ার পর এখন ইয়াবা নিয়ে নতুন করে টাকার ধান্ধায় মেতে উঠেছিলো রুবেল। সে নিজেও ইয়াবা বিক্রি করতো। তার মাধ্যমেই ওই সব এলাকায় ইয়াবার প্রভাব বিস্তার করে। লাবুকে একইভাবে ইয়াবা দিয়ে ধরিয়ে দিতে চেয়েছিল। আর এই ভয়ে লাবু তাকে টাকা দিয়ে রেহাই পায়। স্থানীয় লোকজনকে নানাভাবে ব্ল্যাকমেইলের ফাঁদে ফেলে টাকা কামাই করতো সোর্স রুবেল। এলাকার পুতুল নামে এক যুবকের সঙ্গে সংখ্য গড়ে তোলে রুবেল। পরে অসামাজিক কাজে নিয়োজিত এক মহিলাকে দিয়ে পুতুলকে বশে আনে রুবেল। একপর্যায়ে রুবেল ওই মহিলার সঙ্গে পুতুলের ছবি তুলে ছড়িয়ে দেয় ইন্টারনেটে। এসব দৃশ্য পুতুলকে দেখিয়ে সে তাকে ব্ল্যাকমেইল শুরু করে। এভাবে পুতুলের কাছ থেকেও রুবেল প্রায় ৫০ হাজার টাকা লুটে নিয়েছে। মানসম্মানের ভয়ে পুতুল তাকে টাকা দিয়ে যাচ্ছেন। পুতুলের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছেন, ওই মহিলা ছিল রুবেলের পরিচিত। রুবেল মহিলাকে দিয়ে পুতুলকে ফাঁদে ফেলেই টাকা লুটের ধান্ধা শুরু করে। পশ্চিম শেখঘাট এলাকায় মাছবাজার থাকাকালীন সময়ে ওই এলাকার স্থানীয় যুবক মিনহাজের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে রুবেল। কয়েক মাস আগে মিনহাজ ও সহযোগীদের হামলার শিকার হয় রুবেল। কয়েক বছর আগে সিএনজি চালক বদরুলকে ব্ল্যাকমেইল করতে গিয়ে গণরোষে পড়েছিল রুবেল। ওই সময় সে আহতও হয়েছিল। এতসব বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে রুবেল এলাকার মানুষের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছে। এবারের গণপিটুনির ঘটনা ঘটে গত রোববার রাতে। রুবেল কলাপাড়া এলাকার গোরস্তানের পাশে একটি দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো। এ সময় এলাকার মানুষ তার ওপর ক্ষেপে ওঠেন। সে নিজেকে পুলিশের সোর্স পরিচয় দিয়ে বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করায় এলাকার লোকজন তাকে ধরে গণপিটুনি দেন। এতে আহত হয় রুবেল। পরে তাকে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দুদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর রুবেল ফিরেছে এলাকায়। এখন এলাকার যুবকদের একটি তালিকা হাতে নিয়ে কোতোয়ালি থানা, লামাবাজার ফাঁড়ির পুলিশের দ্বারে-দ্বারে ঘুরছে রুবেল। কিন্তু তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের নানা খবর ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে পুলিশেও। এ কারণে পুলিশের কোন কর্মকর্তাই তাকে সায় দিচ্ছেন না। এ ব্যাপারে ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহিম মানবজমিনকে জানিয়েছেন, এলাকার লোকজন তার ওপর বিক্ষুব্ধ হয়ে গণপিটুনি দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। ফলে ক্ষুব্ধ মানুষের রোষানলে পড়ে সে আহত হয়। এখন এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানান তিনি। ১০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র-১ অ্যাডভোকেট সালেহ আহমদ জানিয়েছেন, এলাকার মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে মারধর করেছেন বলে তিনি শুনেছেন। তবে, এলাকায় কেউ কাউকে যন্ত্রণা দিক, পুলিশের ভয় দেখাক, সেটি কোন সুস্থ মানুষ আশা করে না বলে জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.