ম্যালেরিয়া নিরাময় খুঁজতে লোকগাথা হাতড়ে বেড়িয়েছেন নোবেলজয়ী তু

ম্যালেরিয়া রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার করে এ বছর চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল জিতেছেন চীনের বিজ্ঞানী তু ইউইউ। আর এ প্রতিষেধক তিনি খুঁজে পেয়েছেন চীনের প্রাচীন লোকসাহিত্যে। বছরের পর বছর ধরে তার এ নিরলস গবেষণার গল্প উঠে এসেছে সিএনএনের একটি প্রতিবেদনে। প্রাচীন যুগ থেকেই চিকিৎসা ভুবনে চীন দেশের সুনাম ও খ্যাতির কথা কমবেশি সবারই জানা। চীন-সভ্যতা আদি যুগ থেকেই নিজেদের বিভিন্ন সম্পদ ও কবিরাজি সমাধান নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে এসেছে। চীনের বিভিন্ন লোকগাথা এবং সনাতন প্রবাদেও লুকিয়ে আছে প্রাচীন চিকিৎসকদের নানা ওষুধ ও তৈরির নিয়মাবলি। এই চির জানা সত্য আরেকবার প্রমাণ করে নোবেল পুরস্কার জিতে নিলেন তু ইউইউ। তিনি চীনের লোকগাথা ও সনাতন প্রবাদ বিশ্লেষণ করে এমন একটি ওষুধ তৈরি করেছেন, যা কিনা ম্যালেরিয়ার আরোগ্য দিতে ১০০ ভাগ সফল। বিজ্ঞানী তু ইউইউ তার এ গবেষণার জন্য মেডিসিন জগতের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি নোবেল পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন। গবেষণার মাধ্যমে তিনি যে ওষুধটি তৈরি করেছেন তার নাম আরটেমিসিনিন। তিনি বলেন, এ আবিষ্কারটি শুধু একটি অর্জন। এ ধরনের আরও অনেক উপহার লুকিয়ে আছে চীন দেশের লোকগাথা এবং সনাতন প্রবাদে। এ ওষুধটির খোঁজ করার উদ্দেশ্যে তিনি চীনের প্রতিটি শহরে ঘুরে ঘুরে নানা ধরনের আদি আঞ্চলিক প্রবাদ ও লোকগাথা সংগ্রহ করে বেড়িয়েছেন। সেগুলোর বিভিন্ন চিকিৎসাভিত্তিক অর্থ অনুবাদ করে তদানুযায়ী পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে গেছেন বছরের পর বছর। সব মিলিয়ে ২ হাজার সম্ভাব্য নিরাময় সংগ্রহ করেন তিনি। সেখান থেকে ৩৮০টি সম্ভাব্য পদ্ধতি বেছে নেন। সেগুলো পরীক্ষা করেন ইঁদুরের ওপর। এ ৩৮০টি পদ্ধতির একটিতে ব্যবহৃত উপাদান ইঁদুরের রক্তে ম্যালেরিয়া জীবাণুর সংখ্যা কমিয়ে আনে। এ ওষুধটি ব্যবহারের ইঙ্গিত ছিল ১৬০০ বছর পুরনো একটি লোকগাথায়। এতে সোমরাজ গাছের রস পান করার ব্যাপারে লেখা ছিল।
ম্যালেরিয়া প্রতিষেধক খোঁজ করার জন্য তু প্রথম মরিয়া হয়ে ওঠেন ১৯৬৭ সালে আরম্ভ হওয়া প্রজেক্ট ৫২৩-এর অংশগ্রহণ করার পর। এ প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল মশার কামড়ে মৃতের সংখ্যা কমানোর জন্য। প্রকল্পটির সভাপতি ছিলেন মাও যিদং। তিনি ভিয়েতনামের জঙ্গলে যুদ্ধরত সৈনিকদের নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলেন। কারণ বুলেটের চেয়ে মশার কামড়জনিত রোগেই তাদের মৃত্যু বেশি হচ্ছিল। আরটেমিসিনিন প্রসঙ্গে প্রথম গবেষণা প্রকাশ হয় ১৯৭৭ সালে। আর ইংরেজি ভাষায় প্রথম গবেষণা প্রকাশ হয় ১৯৮২ সালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যশিনাল ইনস্টিটিউট অব এলারজি অ্যান্ড ইনফেকশস ডিজিজের বিজ্ঞানী লুইস মিলার নোবেলজয়ী তুকে নিয়ে বলেন, ‘অন্য যে কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা বিজ্ঞানী এত ধৈর্য পরীক্ষা দিতে পারতেন না। যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি ওষুধের ১০০ ভাগ কার্যকারিতা নিয়ে নিশ্চিত হননি ততক্ষণ তার চেষ্টা ছিল অটুট।’ প্রতি বছর মশার কামড়জনিত নানা রোগে মৃত্যু হয় প্রায় ৪,৫০,০০০ লোকের। তাই, তুর এ কৃতিত্ব একবিংশ শতাব্দীতেও বেশ আলোড়ন সৃষ্টিকারী। আজকের বিশ্বে আরটেমিসিনিন ম্যালেরিয়া চিকিৎসার মূল চাবিকাঠি। তবে এ ছাড়া নানা ধরনের রোগের নিরাময়ের জন্য এর ব্যবহার দেখা যায়। চিনের হং কং ব্যাপ্টিস্ট ইউনিভার্সিটির চায়নিজ মেডিসিন বিভাগের ডিন লু এইপিং চীন এবং অন্য দেশগুলোর হারবাল ওষুধ এবং হৃদরোগ নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন ব্যক্ত করে এ বিষয়ের সম্ভাবনার ওপর গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন জানিয়েছেন। লু কিছুদিন তুর সঙ্গে কাজ করেছেন বেইজিং শহরে। সহকর্মীর সম্পর্কে লু জানান, তু ইউইউ বেশ মনোযোগী প্রকৃতির মানুষ, তাকে অবশ্যই সহজ এবং সাধারণ বলা চলবে না। বিশিষ্ট নিউরোলজিস্ট রাও জিনি তু-এর সঙ্গেই ৫২৩ প্রজেক্টে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তু-এর সাফল্য সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা আশা করি যে এ ঘটনার পর চীনের লোকরা তাকে নায়করূপে পুজ্য করে তুলবে না, তাদের কখনোই ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে এ সাফল্যে অন্যদেরও অবদান রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.