আতঙ্কে বিদেশীরা

রেস্তরাঁগুলো ফাঁকা। অতিথিদের আলাপচারিতায় মুখর চিরাচরিত হোটেলের লবিগুলো নীরব হয়ে গেছে। উঁচু দেয়ালবেষ্টিত দূতাবাস প্রাঙ্গণগুলোতে নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে আরও কঠোরভাবে। সম্প্রতি বাংলাদেশে দুই বিদেশী নাগরিক হত্যার ঘটনায় আতঙ্কে রয়েছেন বিদেশী পর্যটক আর অভিবাসীরা। দক্ষিণ এশিয়ার ধর্মনিরপেক্ষ দেশটিতে উগ্রপন্থিরা শক্ত অবস্থান অর্জন করছে কিনা আর বিদেশীরা নিরাপদ কিনা তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বার্তা সংস্থা এপি’র এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়। ‘এক্সপ্যাটস স্পুক্‌ড আফটার টু ফরেইনার্স গানড ডাউন ইন বাংলাদেশ’- শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, একজন ইতালিয়ান ও একজন জাপানিজ নাগরিক- উভয় হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তাদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে। তারা বরং দোষারোপ করছে বিরোধীদের। তাদের অভিযোগ দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার ষড়যন্ত্রে সমর্থন রয়েছে বিরোধীদের। এমন অভিযোগ বিরোধীরা  প্রত্যাখ্যান করেছে। নিরাপত্তায় আস্থা কমে গেলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। দেশটির অর্থনীতি অনেকাংশে বিদেশী সহায়তা এবং বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীল। ইতিমধ্যে হোটেল আর বিদেশী সম্প্রদায়ের জন্য খাদ্য সরবরাহকারী দোকানগুলো লোকসান দেখা শুরু করেছে। ঢাকার একটি পাঁচ তারকা হোটেলের ব্যবস্থাপক বলেন, ‘এসব হত্যাকাণ্ড আমাদের ব্যবসায় প্রভাব ফেলছে। আমাদের কিছু বুকিং বাতিল করতে হয়েছে।’ ব্যবসায় আরও ক্ষতি হতে পারে সে আশঙ্কায় নিজের পরিচয় ও হোটেলের নাম গোপন রাখার অনুরোধ করেন তিনি। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে আরেকটি হোটেলে ব্যবস্থাপক জানান, তারা নিরাপত্তা কর্মী এবং ভিডিও নজরদারি বাড়িয়েছেন। তিনি বলেন, ‘কোন সন্দেহমূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে, আমাদের নিরাপত্তা কর্মীরা হোটেলে বাইরে সাদা পোশাকে দায়িত্ব পালন করছেন।’ গত সপ্তাহে একই রকম কায়দায় ইতালির নাগরিক সিজার তাভেলা ও জাপানের কুনিয়ো হোশিকে হত্যা করা হয়। হামলাকারীরা মোটরসাইকেলে এসে গুলি করে চলে যায়। দরিদ্রদের সহায়তার লক্ষ্যে কাজ করা কৃষি প্রকল্পে নিয়োজিত দুই বিদেশীকে টার্গেট করে হত্যার ঘটনায় বাংলাদেশে অনেকে স্তব্ধ হয়ে গেছেন। বাংলাদেশে বসবাসরত ২ লাখ ২৪ হাজার বিদেশী নাগরিকের বেশির ভাগই দূতাবাস, সহায়তা সংস্থা বা আন্তর্জাতিক পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করেন। এসব পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের ২৫০০ কোটি সমমূল্যের গার্মেন্ট শিল্পের অংশ। আর এ শিল্প দেশের অর্থনীতির একটি স্তম্ভ। যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস ও স্পেনসহ কয়েকটি দেশ তাদের দূতাবাস কর্মীদের জনবহুল এলাকা থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছে। এছাড়া চলাফেরার ক্ষেত্রে তাদের গাড়ি ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ সপ্তাহে বার্তা সংস্থা এপি ১২ জন বিদেশী নাগরিকের কাছে মন্তব্য চেয়েছিল। কিন্তু প্রত্যেকেই তাদের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ এড়াতে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। বাংলাদেশী একজন ব্যবসা পরামর্শদাতা শোয়েব আজিব বলেন, তার জাপানি স্ত্রী জাপান থেকে ফেরার বিষয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে। আর জাপানি নানা প্রতিষ্ঠানসহ তার অনেক বিদেশী মক্কেল বাংলাদেশে পূর্ব-পরিকল্পিত সফরসূচি পিছিয়ে দিয়েছেন। মি. শোয়েব জানান, তাদের এখানে কারখানা রয়েছে। কিন্তু তারা অপেক্ষা করছেন আর সময়সূচি পাল্টাচ্ছেন। মেডিক্যাল সরঞ্জাম আমদানিকারক নূর মোহাম্মদ কাজের সুবাদে প্রায়ই বিদেশি ক্লাবগুলোতে যাতায়াত করেন। এর মধ্যে রয়েছে মার্কিন দূতাবাসের আমেরিকান ক্লাব। মি. নূর জানান, ‘সন্ধ্যার আগেই বিদেশীরা ঘরে ফিরে যাচ্ছেন। কাজেই তাদের কাজ শেষ হয়ে যাচ্ছে আগে ভাগে।’
সরকারের দাবি পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কূটনীতিকদের আশ্বস্ত করতে সরকার কর্মকর্তাদের পাঠিয়েছেন। আরও জোরালো নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর প্রতিশ্রুতির ওপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সুনাম প্রতিষ্ঠা করেছে। তার সরকার কট্টরপন্থি ছয়টি জঙ্গি গোষ্ঠীকে নিষিদ্ধ করেছে। আর পুলিশ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সন্তেহভাজক কয়েক ডজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। সরকার ধর্মনিরপেক্ষ আর ঐতিহ্যগতভাবে উদারপন্থি হলেও, ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর আবির্ভাবে উদারমনা আর উগ্রমনাদের মধ্যে স্পষ্ট বিভক্তি সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিক অস্থীতিশীলতায় তা অবদান রেখেছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্নিকাট এ সপ্তাহে বলেছেন, সরকারের আশ্বাসের পর দূতাবাস কর্মীরা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ বোধ করছেন। তিনি সন্ত্রাসবাদ নিয়ে হাসিনার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির প্রশংসা করেন। বাংলাদেশ সম্প্রতি উগ্রপন্থি ইসলামের উত্থান নিয়ে লড়াই করছে। এ বছর কমপক্ষে ৪ জন ব্লগার ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্টকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নিষিদ্ধঘোষিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে সম্পৃক্ত দলগুলো এসব হামলার দায় স্বীকার করেছে। এ সপ্তাহে একজন খ্রীষ্টান যাজক ছুরিকাঘাতের পর অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছেন। এ হামলাকেও উগ্রপন্থি জঙ্গিদের হামলা বলে অভিযোগ করা হচ্ছে।
ইসলামপন্থি উগ্রপন্থার লালনভূমি হওয়ার সুযোগ বাংলাদেশের নেই। দেশটির অর্থনীতি গার্মেন্ট শিল্পের ওপর নির্ভরশীল যা আন্তর্জাতিক ক্লোদিং ব্র্যান্ডগুলোকে পণ্য সরবরাহ করে। অল্প অবকাঠামো আর সীমিত সম্পদের কারণে অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে দেশটিকে বেগ পেতে হয়েছে। ঢাকা ভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ’-এর গবেষণা পরিচালক ফাহমিদা খাতুন স্থানীয় একটি ইংরেজি পত্রিকায় লেখা মতামত কলামে বলেন, বিদেশীদের হত্যাকাণ্ড পরিস্থিতিকে আরও অবনতির দিকে নিয়ে যাবে। কেননা, অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ভাবমূর্তি একটি গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গত বছরে শেখ হাসিনা বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা প্রতিষ্ঠার জন্য কয়েকটি বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন জাপান, চীন ও ভারতের সঙ্গে। দেশগুলো কয়েক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে এবং এতে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা বেগবান হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র এসআর মাসুম বলেন, ‘এটা উদ্বেগজনক। এসব হত্যাকাণ্ড বিদেশীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কি হচ্ছে মানুষ তা জানতে চায়। আমরা স্বস্তিতে নেই।’

No comments

Powered by Blogger.